logo
আপডেট : ২৬ মে, ২০২২ ১৫:০৬
পটুয়াখালীতে বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে পরিবেশ দূষণ, স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে স্থানীয়রা
নিজস্ব প্রতিবেদক


পটুয়াখালীতে বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে পরিবেশ দূষণ, স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে স্থানীয়রা

জাতীয় প্রেসক্লাবের তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া হলে সংবাদ সম্মেলনে বক্তারা

পটুয়াখালীর কলাপাড়ায় বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ নিয়ে পরিবেশ দূষণ স্বাস্থ্য ঝুঁকি ও দালাল চক্রের খপ্পরে পড়ছে স্থানীয়রা। বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের ফলে সেখানে কি ধরনের প্রভাব ফেলছে সে বিষয়ে প্রাথমিক এক গবেষণায় এ কথা জানানো হয়।

বৃহস্পতিবার (২৬ মে) সকাল ১১টায় জাতীয় প্রেসক্লাবের তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া হলে এক সংবাদ সম্মেলনে এসব কথা জানান বক্তারা।

বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) ও ওয়াটারকিপার্স বাংলাদেশ যৌথভাবে "নির্মাণাধীন আশুগঞ্জ বিদ্যুৎ প্রকল্পঃ একটি আর্থসামাজিক সমীক্ষা” শীর্ষক প্রতিবেদন প্রকাশ করে।

এ সময় সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন-বাপা'র যুগ্ম সম্পাদক ও ব্রতী’র প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা শারমীন মুরশিদ, বাপা'র যুগ্ম সম্পাদক ও বুড়িগঙ্গা বাঁচাও আন্দোলনের সমন্বয়ক মিহির বিশ্বাস, বাপা'র নির্বাহী সদস্য এবং অর্থ, বাণিজ্য ও টেকসই উন্নয়ন বিষয়ক কমিটির সদস্য সচিব এম এস সিদ্দিকী, বাপা'র নির্বাহী সদস্য ও নিরাপদ ডেভেলপমেন্ট ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান ইবনুল সাঈদ রানা প্রমুখ।

মূল প্রতিবেদন উপস্থাপন করেন পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের জিওমেটিক্স বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মোঃ আশিকুর রহমান।

আশিকুর রহমান বলেন, পরিকল্পিত আশুগঞ্জ পাওয়ার প্ল্যান্ট সম্পর্কে স্থানীয় নাগরিকদের দৃষ্টিভঙ্গি এবং চিন্তাভাবনা সনাক্ত করার জন্য একটি সত্য অনুসন্ধান মিশনের অংশ হিসেবে এই সংক্ষিপ্ত গবেষণাটি করা হয়েছিল। মোট ১০০টি সাক্ষাৎকার থেকে কিছু গুরুতর উদ্বেগ ও অভিযোগ পাওয়া গেছে। প্রতিবেদনে দেখা গেছে, ২০২২ সালের মার্চ পর্যন্ত কোনো উল্লেখযোগ্য কাঠামোগত উন্নয়ন শুরু হয়নি। ২০২২ সালের এপ্রিলে বালি ভরাটের কার্যক্রম শুরু হয়। ক্ষতিপূরণ ছিল সর্বনিম্ন ৬০ হাজার টাকা থেকে সর্বোচ্চ ৩৭ লাখ টাকা। ১০০ জন উত্তরদাতার মধ্যে সর্বাধিক ৮৪ শতাংশ উত্তর দিয়েছেন যে, আনুমানিক পরিমাণ প্রকৃত নয়। তাদের মধ্যে সংখ্যাগরিষ্ঠ দাবি করেছে, স্থানীয় দালাল অবৈধ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে তাদের অতিরিক্ত মূল্য দেওয়ার প্রস্তাব দিয়েছে।

তিনি বলেন, মোট পুনর্বাসনের জন্য তারা ভূমি অধিগ্রহণ অফিস, ভূমি জরিপকারী এবং ভূমি অধিগ্রহণের সাথে সম্পর্কিত অন্যান্য খাতে ঘুষ হিসাবে দালালকে সর্বনিম্ন ৪৪ হাজার ৮০০ টাকা থেকে সর্বোচ্চ ৫ লাখ টাকা পর্যন্ত প্রদান করেছে।উত্তরদাতাদের মতে, কাছাকাছি জলাভূমি দখল একটি সমস্যা হওয়া উচিত যা জলাভূমি নেটওয়ার্কের ভরাট এবং আশপাশে জলের বৈশিষ্ট্য পরিবর্তনের মধ্যে সম্পর্ক থাকতে পারে যার জন্য আরও তথ্য সংগ্রহ এবং বিশ্লেষণ প্রয়োজন। তারা সম্ভাব্য গরম/উষ্ণ/বর্জ্য জলের নিঃসরণ এবং আন্ধারমানিক ইলিশ অভয়ারণ্যের অবনতিসহ মাছের জন্ম ও বৃদ্ধির উপর নেতিবাচক প্রভাব নিয়ে উদ্বিগ্ন।

তিনি তার প্রাথমিক গবেষণায় দেখান, ১০০ শতাংশ উত্তরদাতা মতামত দিয়েছেন যে, বিভিন্ন বিরূপ প্রভাব গাছপালার উপর প্রভাব ফেলবে যার মধ্যে সেই এলাকার তরমুজ, পালং শাক এবং অন্যান্য শাকসবজি পচে এবং কালো হয়ে যাবে। মাঠ পর্যবেক্ষণে আরও বলা হয়েছে, আশপাশের মাটির স্বাস্থ্যের পরিবর্তন ও অবনতি ঘটছে। মাটির উপর সম্ভাব্য প্রভাব সম্পর্কে প্রশ্ন করার সময় মোট ৮২ শতাংশ উত্তরদাতা এই নির্মাণ কাজের কারণে মাটির দূষণ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। বায়ুর গুণমানের উপর প্রভাব সম্পর্কে সমীক্ষার ফলাফল দেখায় যে উত্তরদাতাদের প্রায় ৭৯ শতাংশ বায়ুর মানের অবনতির জন্য উদ্বেগের সাথে উত্তর দিয়েছেন।

উপকূলীয় অঞ্চলে আবহাওয়া এবং জলবায়ু পরিবর্তনের বিষয়ে তিনি বলেন, সর্বাধিক ৯৩ শতাংশ উত্তরদাতা উপকূলীয় অঞ্চলে আবহাওয়া এবং জলবায়ু পরিবর্তনের বিষয়ে উদ্বিগ্ন। তাদের ক্রমবর্ধমান উত্তর এবং মিডিয়া রিপোর্ট থেকে আরও দেখা গেছে যে ওই এলাকার মানুষ বঙ্গোপসাগর থেকে তীব্র আবহাওয়ার ধরণ, কুয়াকাটা সমুদ্র সৈকতের ব্যাপক ভাঙন, ডলফিন ও জলজ প্রাণীর মৃত্যু এবং সেইসাথে পরিবর্তিত অভিবাসন পরিস্থিতির সম্মুখীন হচ্ছে। জনসাধারণের ধারণা, প্রকল্পটি শেষ হলে জলযানের ঘনঘন চলাচল এবং দূষণ বৃদ্ধির কারণে ওই এলাকা থেকে মাছ ধরা উল্লেখযোগ্যভাবে কমে যাবে। উত্তরদাতাদের ১০০ শতাংশ উত্তর দিয়েছেন শিল্পায়নের কারণে ইলিশের উৎপাদন উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পাবে।

তিনি বলেন, প্রকল্পের নির্মাণের কারণে উত্তরদাতাদের আশঙ্কা যে তাদের এই এলাকা থেকে ৫ কিলোমিটার দূরে স্থানান্তর করতে হবে, যেখানে প্রস্তাবিত পুনর্বাসন প্রকল্পটি নির্মিত হবে। তাদের জীবিকা পরিবর্তন করতে হবে। নদী থেকে ৫-৬ কিলোমিটার দূরে থাকা অবস্থায় নদীতে মাছ ধরা সম্ভব নয় এবং তাদের জীবিকা হারানোর আশঙ্কা রয়েছে। প্রায় ৭০ শতাংশ মানুষ উত্তর দেয় যে ভবিষ্যতের জীবনমান বর্তমান পরিস্থিতির তুলনায় তুলনামূলকভাবে খারাপ হবে।

তিনি বলেন, গবেষণায় উত্তরদাতাদের প্রায় ৬০ শতাংশ সামাজিক নিরাপত্তাহীনতা সম্পর্কে উত্তর দিয়েছেন। উত্তরদাতারাও সম্ভাব্য স্বাস্থ্য সমস্যা নিয়ে চিন্তিত। সমীক্ষার ৭৯ শতাংশ উত্তর দিয়েছে যে এই প্রকল্প নির্মাণের কারণে শ্বাসকষ্টজনিত রোগ আক্রমণ করতে পারে এবং ৬৯ শতাংশ উত্তরদাতারা প্রকল্পের কারণে সম্ভাব্য গুরুতর শব্দ দূষণ সমস্যা সম্পর্কে উত্তর দিয়েছেন। এই প্রতিবেদনটি প্রস্তুতির পর্যায়ে রয়েছে এবং উপরোক্ত অভিযোগগুলি যাচাই করতে এবং ফলাফলগুলি বিশ্লেষণ করার জন্য আরও নির্ভুল তথ্য তৈরি করার জন্য অধ্যয়নের ডেটা এবং পদ্ধতিগুলি ক্রমাগত অবলম্বন করা হচ্ছে। নাগরিক প্ল্যাটফর্মে সমস্যাগুলি তুলে ধরার জন্য এবং আরও তদন্ত ও বিশ্লেষণের জন্য জনসাধারণের প্রকাশের জন্য আমরা এই সংবাদ সম্মেলনে প্রাথমিক ফলাফল উপস্থাপন করেছি।

বাপা এর যুগ্ম সম্পাদক স্টামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. কামরুজ্জামান মজুমদার বলেন, বিদ্যুৎ প্রকল্প হলে সেখানের মানুষই যে ক্ষতিগ্রস্ত হবে বিষয়টি তা নয়। আপনার ছেলে যদি ধানমন্ডি পড়ে সে-ও কিন্তু এটা দ্বারা আক্রান্ত হবে। পটুয়াখালী হলে সিলেটের মানুষও কিন্তু আক্রান্ত হবে। বাতাসের গতিবেগের কারণে এটা কিন্তু চলে আসবে। বায়ুদূষণ এখন শুধু ঢাকা না উপকূল অঞ্চলেও ছড়িয়ে পড়েছে।

বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা)'র সাধারণ সম্পাদক শরীফ জামিল বলেন, ইলিশ মাছের সাইজ ছোট হয়ে যাচ্ছে। প্রজননের পথ পরিবর্তন করে ফেলছে। এটার মূল কারণই হলো সেখানকার পরিবেশ দূষণের ফলে বাস্তুসংস্থানের যে পরিবর্তন দেখা দিয়েছে সেটার কারণেই হচ্ছে।

পটুয়াখালীর ভুক্তভোগী এক কৃষক ফরিদ তালুকদার বলেন, আমাদের এখানের অধিকাংশই তিন ফসলি জমি। প্রকল্পে যত জমি প্রয়োজন তার চেয়ে বেশি জমি অধিগ্রহণ করা হয়েছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীসহ বিশেষজ্ঞরা বলেছে কৃষি জমিতে কোনো বিদ্যুৎ নয়। প্রধানমন্ত্রী ও কৃষিবিদরা বলে একটা, চামচারা করে আরেকটা। কিছু বললে তারা করে মামলা। আর বলে সরকারি প্রজেক্ট। স্বাস্থ্যগত সমস্যা জমির ন্যায্য মূল্য না পাওয়াসহ আমরা নানা ধরনের সমস্যায় ভুগছি।