logo
আপডেট : ২৬ মে, ২০২২ ১৭:১১
গুলিস্তান শহীদ মতিউর পার্ক ইজারা কেন?
নাজমুল হাসান রাজ


গুলিস্তান শহীদ মতিউর
পার্ক ইজারা কেন?

গুলিস্তানে ‘শহীদ মতিউর রহমান পার্ক’

রাজধানীর ব্যস্ততম এলাকা গুলিস্তান। বলতে গেলে ঢাকার প্রাণ। এই এলাকাতেই সিটি করপোরেশনের ‘শহীদ মতিউর রহমান পার্ক’।

‘জল-সবুজে ঢাকা’ প্রকল্পের অধীন গুলিস্তান শহীদ মতিউর পার্কটির আধুনিকায়ন করা হয় ২০২০ সালে। তখন পার্কের চারদিকের দেয়াল সরিয়ে সর্বসাধারণের জন্য উন্মুক্ত করে দেয় ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি)।

ইটপাথরের এই ঢাকায় বুকভরে নিঃশ্বাস নিতে জনসাধারণের জন্যই উন্মুক্ত করা হয় পার্কটি। সরেজমিন গিয়ে দেখা গেছে, পার্কটি এখন আর জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত নেই!

এখন এই পার্কে ঢুকতে টাকা লাগে। টিকিট করে পার্কে প্রবেশ করতে হয়। এ ঘটনায় বিস্ময় প্রকাশ করেছে সাধারণ মানুষ।

তারা বলছেন, জনসাধারণের জন্য করা পার্ক থেকে সব ধরনের প্রকিবন্ধকতা সরিয়ে নিতে হবে। টাকা ছাড়া পার্কটি সাধারণের জন্য ব্যবস্থা করারও দাবি সবার।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, প্রায় সাড়ে তিন একর জমির ওপর গড়ে ওঠা পার্কটিতে রয়েছে আম, জাম, ঝাউ, মেহগনি, পাতাবাহার, আকাশি, ইউক্যালিপটাসসহ কয়েক প্রজাতির ফুল গাছ।

আর দক্ষিণ-পশ্চিম কোনে কাজী বশির মিলনায়তন (মহানগর নাট্যমঞ্চ)। পার্কটিতে রয়েছে তিনটি প্রবেশমুখ। দর্শণার্থীদের সবচেয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করে দুটি নাগলিঙ্গম গাছ।

পার্কের মধ্যে চারদিকের পাড় বাঁধাই করা একটি পুকুরও রয়েছে। পুকুরে আছে ওয়াটার বোটের রাইড, যেখানে নেওয়া হয় জনপ্রতি ৫০ টাকা।

এর পূর্ব পাশে বসানো হয়েছে নাগরদোলা, ট্রেনসহ অন্তত ৮টি রাইড। যে রাইডগুলোর প্রতিটিতে চড়তে খরচ পড়বে ৩০ থেকে ৫০ টাকা। চটপটি, ফুসকা, ফাস্টফুডসহ বাসনো হয়েছে বেশ কয়েকটি খাবারের দোকান।

উন্মুক্ত পার্কটির চারদিকে দেয়াল দিয়ে ভেতরে বসানো হয়েছে বেশ কয়েকটি রাইড ও খাবারের দোকান। এমনকি এক পাশে বসানো হয়েছে মৌসুমি ফলের আড়তও।

স্থানীয় লোকজনের অভিযোগ পার্কটি ইজারা দিয়ে টিকিট সিস্টেম করে জনসাধারণের প্রবেশ সংরক্ষিত করা হয়েছে। এ নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন তারা।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পার্কটি রক্ষণাবেক্ষণ এবং রাইডগুলোর তত্ত্বাবধানের জন্য ইজারা দেওয়া হয়েছে। সেই খরচ জোগাতে নেওয়া হচ্ছে টাকা।

আওয়ামী লীগের দুই নেতার কাছে ইজারা দেওয়ার কথা জানা গেছে। তারাই সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকে প্রবেশ ফি তুলছেন। নতুন নতুন রাইড এনে পরিচালনা করছেন। তবে ইজারাদাররা এ ব্যাপারে মুখ খুলতে নারাজ।

নগর পরিকল্পনাবিদরা বলছেন, এ ধরনের একটি পাবলিক পার্ককে সিটি করপোরেশন ইজারা দিয়ে প্রবেশ সংরক্ষিত করতে পারে না। এমনকি শিশুদের খেলার জন্য হালকা রাইড বসাতে পারে তবে নৈতিকভাবে এমন ভারী রাইড পার্কে বসাতে পারে না।

প্রাপ্ত তথ্য বলছে, প্রায় ৬ কোটি টাকা ব্যয়ে ‘জল-সবুজে ঢাকা’ প্রকল্পের মাধ্যমে গুলিস্তান শহীদ মতিউর পার্কটির আধুনিকায়ন করে ২০২০ সালে পার্কের চারদিকের দেয়াল সরিয়ে সর্বসাধারণের জন্য উন্মুক্ত করে দেয় দক্ষিণ সিটি।

পার্কটির নকশা অনুযায়ী, এর চারপাশ থাকবে উন্মুক্ত যাতে যেকোনো দিক দিয়ে পার্কে প্রবেশ করা যায়। এ পার্কটির নকশা করেছিল স্থাপত্য প্রতিষ্ঠান ‘সাতত্য’।

সাতত্যের প্রধান স্থপতি রফিক আজম তখন বলেছিলেন, যখনই কোনো উদ্যান বা পার্ক দেয়াল দিয়ে ঘেরাও করা হয়, তখন ভেতরে অপরাধ দানা বাঁধে।

উন্মুক্ত থাকলে সবকিছু নজরদারিতে থাকে। এজন্য পার্কটির চারদিক উন্মুক্ত রেখে এর সংস্কার করা হয়েছে।

পার্কটিতে এখন ১০ টাকার টিকিট কেটে হাঁটতে আসা রায়তান মাসুদ বলেন, পাবলিক পার্কে বাণিজ্যিক রাইড বসালে নগরবাসী নিঃশ্বাস ফেলার জায়গা কোথায় পাবে।

এভাবেই নগরের সবুজ স্থান হারিয়ে যাচ্ছে। আমরা চাই শহরে সবার জন্য উন্মুক্ত জায়গাও থাকুক আবার রাইডসহ শিশুপার্কও গড়ে উঠুক।

যাত্রাবাড়ী থেকে শিশুদের নিয়ে ঘুরতে আসা লাভলি আক্তার বলেন, আগে তো এখানে টাকা ছাড়াই প্রবেশ করে বাচ্চাদের কিছুক্ষণ ঘুরিয়ে নিয়ে যেতাম। এখন ১০ টাকার টিকিট কেটে প্রবেশ করে ছোট ছোট রাইডগুলোতেও ৩০ থেকে ৫০ টাকা দিয়ে বাচ্চাদের চড়াতে হচ্ছে। এখানকার ব্যবস্থাপনা তেমন ভালো না।

সবার জন্য উন্মুক্ত থাকার কথা থাকলেও পার্ক ইজারা দেওয়ার তথ্য স্বীকার করে ডিএসসিসির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ফরিদ আহাম্মদ বলেন, পার্কটিতে পর্যাপ্ত পরিমাণে জায়গা রয়েছে। যেখানে চাইলে শিশুরা খেলাধুলা করতে পারবে।

তবে টিকিটের বিষয়ে তিনি বলেন, নামমাত্র প্রবেশ ফি নেওয়া হয়। মাত্র ১০ টাকা। পার্কটিতে বেশ কয়েকটি রাইড রয়েছে সেগুলো দেখাশোনার জনবল সিটি করপোরেশনের নেই। তাই ইজারার ব্যবস্থা করা হয়েছে।

নগর পরিকল্পনাবিদ ইকবাল হাবিব বলেন, আগে আমাদের ঢাকার শিশুদের কথা বিবেচনায় রাখতে হবে। তারা যেন স্বাচ্ছন্দ্যে সুযোগ-সুবিধা ভোগ করতে পারে সে বিষয়ে নজর বাড়াতে হবে।

পার্কে প্রবেশ ফি না নেওয়াই ভালো। জনগণের সুবিধার কথা চিন্তা মাথায় রেখে সিটি করপোরেশনকে সেভাবেই কাজ করতে হবে।

সিটি করপোরেশন নিজেই জানে না পার্কে কী হচ্ছে, এটা সিটি করপোরেশনের ব্যর্থতাও বটে উল্লেখ করে এ নগর পরিকল্পনাবিদ বলেন, ‘সিটি করপোরেশনের অধীনে তো আর হাজার হাজার পার্ক নেই যে সেগুলো রক্ষণাবেক্ষণ করতে পারবে না।

পার্কগুলো সংরক্ষণ এবং দেখভালের সক্ষমতা আছে সিটি করপোরেশনের। পার্ক ও খেলার মাঠগুলো নগর কর্তৃপক্ষের নজরদারিতে থাকা উচিত এবং এর রক্ষণাবেক্ষণ তাদেরই করতে হবে।

উল্লেখ্য, স্বাধীনতার আগে এটি পল্টন মাঠ হিসেবে পরিচিত ছিল। পরবর্তী সময়ে গভর্নর হাউস (বঙ্গভবন) ও পল্টন স্টেডিয়াম নির্মাণের সময় পার্কটি সংরক্ষণ করা হয়।

১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থানে নিহত মতিউরের নামে ‘শহীদ মতিউর শিশু পার্ক’ নামকরণ করা হয়।