logo
আপডেট : ২৭ মে, ২০২২ ১০:৪৭
৭২ ঘণ্টার মধ্যে বন্ধ করতে হবে অনিবন্ধিত চিকিৎসাপ্রতিষ্ঠান
নিখিল মানখিন

৭২ ঘণ্টার মধ্যে বন্ধ করতে হবে অনিবন্ধিত চিকিৎসাপ্রতিষ্ঠান

অনিবন্ধিত হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক নিয়ন্ত্রণে কঠোর নির্দেশনা দিয়েছে সরকার। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সভায় অনিবন্ধিত সব চিকিৎসাপ্রতিষ্ঠান ৭২ ঘণ্টার মধ্যে বন্ধ করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছে। অর্থাৎ আগামী ২৮মের মধ্যে বন্ধ করতে হবে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অবৈধ চিকিৎসাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ করতে এ ধরনের নির্দেশনা বহুবার দিয়েছে অধিদপ্তর। কিন্তু তাদের গৃহীত সিদ্ধান্তসমূহ বাস্তবায়নে হতাশ হয়েছে দেশবাসী।

-সাইনবোর্ডসর্বস্ব প্রতিষ্ঠানে নিয়মনীতির বালাই নেই

- হাতিয়ে নিচ্ছে কোটি কোটি টাকা

-বিগত সময়ে কঠোর নির্দেশনা দিয়েই দায়িত্ব শেষ করেন সংশ্লিষ্টরা

নির্দেশনা দিয়েই দায়িত্ব শেষ করেন সংশ্লিষ্টরা। বছরের পর বছর ধরে অনিবন্ধিত অসংখ্য চিকিৎসাপ্রতিষ্ঠান মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকে। তাই স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের এমন নির্দেশনার ওপর দেশবাসী আস্থা রাখতে পারছে না বলে আশঙ্কা করেন বিশেষজ্ঞরা।

জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সারাদেশে অলিগলিতে চিকিৎসা সেবার নামে অবাধে অবৈধ ব্যবসা করে যাচ্ছে অসংখ্য অনিবন্ধিত হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার। এসব অবৈধ প্রতিষ্ঠানে সরকারি নিয়ন্ত্রণ থাকে না।

বিভিন্ন সময় দায়িত্বপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা ও অবৈধ চিকিৎসাপ্রতিষ্ঠানের মালিকদের যোগসাজশ ও লেনদেনের অভিযোগ পাওয়া গেছে। কোথাও কোথাও ডায়াগনস্টিক সেন্টারের অনুমোদন নিয়ে সাজিয়ে বসেছে হাসপাতাল ও ক্লিনিকের ব্যবসা। ভর্তি করা হয় রোগী। ভাড়া করে আনা হয় চিকিৎসক। মানহীন আইসিইউ সাজিয়ে চালায় রমরমা বাণিজ্য। এমন ফাঁদে পড়ে নানা হয়রানির শিকার হয়ে আসছে অনেক রোগী। সাইনবোর্ডসর্বস্ব এসব প্রতিষ্ঠানে নিয়মনীতির বালাই নেই।

জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা আরো জানান, জবাবদিহিতা না থাকায় অবৈধ ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলোতে চলে অরাজকতা। থাকে না মানবতার উপস্থিতি। এসব সেন্টারে হাতুড়ে টেকনিশিয়ান দ্বারাই চালানো হয় রোগ নির্ণয়ের যাবতীয় পরীক্ষা। তারা মনগড়া রিপোর্ট তৈরি করে ঠকাচ্ছে নিরীহ মানুষকে। একই রোগ পরীক্ষায় একেকটি ডায়াগনস্টিক সেন্টার থেকে একেক রকম রিপোর্ট পাওয়ার অনেক ঘটনা রয়েছে। রোগী মারার কারখানা হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছে অনেক ডায়াগনস্টিক সেন্টার।

এসব সেন্টার থেকে প্রাপ্ত রিপোর্ট নিয়ে রোগী ও তাদের স্বজনরা চরম বিভ্রান্তিতে পড়েন। নানা সমালোচনার মধ্যেও সরকারি হাসপাতালের একশ্রেণির ডাক্তারদের সহায়তায় ডায়াগনস্টিক সেন্টার মালিকদের যথেচ্ছ টেস্টবাণিজ্য চলছে বছরের পর বছর। ডায়াগনস্টিক প্রতারণার শিকার মানুষজন। বার বার অভিযোগ তুলেও প্রতিকার পাচ্ছেন না।

৭২ ঘণ্টার মধ্যে অনিবন্ধিত চিকিৎসাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ করতে হবে: অধিদপ্তর আগামী ৭২ ঘণ্টার মধ্যে দেশের সব অনিবন্ধিত হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার বন্ধের নির্দেশ দিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। এ সময়ের মধ্যে ক্লিনিক বন্ধ করা না হলে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়ার কথাও বলা হয়েছে। বিষয়টি ভোরের আকাশকে নিশ্চিত করেছেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক ডা. মো. বেলাল হোসেন।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, বুধবার অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক আহমেদুল কবিরের নেতৃত্বে অনুষ্ঠিত সভায় এ সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিকের সুপারভিশন ও মনিটরিং কার্যক্রম নিয়ে অনুষ্ঠিত সভায় মোট ৪টি সিদ্ধান্ত হয়। এগুলো হলো আগামী ৭২ ঘণ্টার মধ্যে দেশের অনিবন্ধিত বেসরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারসমূহ বন্ধ করতে হবে। অনিবন্ধিত বেসরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলোর বিরুদ্ধে এ কার্যক্রম চলমান থাকবে। এ কার্যক্রমে স্থানীয় প্রশাসন ও আইন প্রযোগকারী সংস্থার সঙ্গে সমন্বয় করতে হবে।

যেসব প্রতিষ্ঠান নিবন্ধন গ্রহণ করলেও নবায়ন করেনি, তাদের নিবন্ধন নবায়নের জন্য সময়সীমা প্রদান করতে হবে। নির্দিষ্ট সময়সীমার মধ্যে নবায়ন গ্রহণ না করলে, সেসব প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম বন্ধ করতে হবে।

বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিকসমূহে অপারেশনের সময় অ্যানেস্থেসিয়া প্রদান ও ওটি অ্যাসিস্ট করার ক্ষেত্রে নিবন্ধিত চিকিৎসক ছাড়া অন্যদের রাখা হলে সেসব প্রতিষ্ঠান ও জড়িত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে লাইসেন্স বাতিলসহ কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে।

যেসব প্রতিষ্ঠান নতুন নিবন্ধনের আবেদন করেছে, তাদের লাইসেন্স প্রদানের কার্যক্রম দ্রুত শেষ করতে হবে। লাইসেন্সপ্রাপ্তির আগে এসব প্রতিষ্ঠান কার্যক্রম চালাতে পারবে না বলে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সভায় সিন্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সর্বশেষ আনুষ্ঠানিক প্রতিবেদন সরকার সর্বশেষ ২০২০ সালে দেশব্যাপী হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারসমূহের নিবন্ধন এবং মেয়াদোত্তীর্ণ প্রতিষ্ঠানসমূহের লাইসেন্স নবায়ন কার্যক্রম পরিচালনা করে। বেঁধে দেওয়ার সময়ের মধ্যে আবেদন জমাদানকারীদের পরিসংখ্যানের ভিত্তিতে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের প্রতিবেদনে দেখা গেছে, হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিকের লাইসেন্স পেতে আবেদন করেননি সংশ্লিষ্ট দপ্তরে; কিন্তু দিব্যি চিকিৎসা কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে কয়েক হাজার বেসরকারি চিকিৎসাকেন্দ্র। আবার কেউ কেউ লাইসেন্সের জন্য আবেদন করে চিকিৎসা কার্যক্রম চালাচ্ছে বছরের পর বছর। সব মিলিয়ে প্রায় ১২ হাজার হাসপাতাল-ক্লিনিক স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অনুমোদন ছাড়া চিকিৎসাসেবার নামে চালিয়ে যাচ্ছে অবৈধ ব্যবসা।

দেশে অনুমোদনহীন ১১ হাজার ৯৪০টি হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারের মধ্যে ২ হাজার ৯১৬টি হাসপাতাল ও ক্লিনিক লাইসেন্সের জন্য কোনো আবেদনই করেনি। ৯ হাজার ২৪টি হাসপাতাল-ক্লিনিকের মধ্যে বেশির ভাগ লাইসেন্সের জন্য আবেদনের পর অনুমোদন ছাড়াই চিকিৎসা শুরু করেছে।

অনুমোদনহীন যেসব চিকিৎসা সেবাকেন্দ্র চিহ্নিত করা হয়েছে, তার মধ্যে ৩ হাজার ৫৩৫টি ঢাকা বিভাগে, ২ হাজার ২৩২টি চট্টগ্রাম বিভাগে, ১ হাজার ৫২৩টি খুলনা বিভাগে, ১ হাজার ৪৩৮টি রাজশাহী বিভাগে, ১ হাজার ৯৯টি রংপুর বিভাগে, ৯৬৩টি ময়মনসিংহ বিভাগে, ৬০৩টি বরিশাল বিভাগে এবং ৫৪৬টি সিলেট বিভাগে।

অবৈধ ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার উচ্ছেদকরণে সরকারের কঠোর হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন বাংলাদেশ ফার্মাসিউটিক্যালস কাউন্সিলের সাবেক সভাপতি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মেসি বিভাগের অধ্যাপক আ ব ম ফারুক। তিনি ভোরের আকাশকে বলেন, অভিযুক্তদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করা উচিত। অবৈধভাবে গড়ে ওঠা শত শত, হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার দেশের স্বাস্থ্যসেবার জন্য চরম হুমকি। ওই সব প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে অনৈতিক কাজ সম্পাদনের অভিযোগও পাওয়া যায়।

তিনি আরো বলেন, দেশের ভালো ভালো, হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক উঠিয়ে দেয়া ঠিক হবে না। তবে ওই প্রতিষ্ঠানগুলোরও উচিত চিকিৎসাসেবার দেয়ার সময় মানবিক দিক বিবেচনা করা। রোগীদের কাছে থেকে চড়া ফি আদায় করা ঠিক হবে না। দেশের ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারের মধ্যে খারাপের সংখ্যাই বেশি বলে তিনি মনে করেন।

নির্ধারিত ফি আদায়ের ব্যাপারে অধ্যাপক আ ব ম ফারুক আরো বলেন, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলো বিভিন্ন ক্যাটাগরিতে ভাগ করে ফি নির্ধারণ করা উচিত। আর বিভিন্ন ক্লিনিকে সরকারি ডাক্তারের সঙ্গে রোগী পাচারের প্রথা বন্ধ করার দাবি জানান তিনি।

স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদের(স্বাচিপ) মহাসচিব অধ্যাপক ডা. এম এ আজিজ ভোরের আকাশকে বলেন, সরকার, দেশ ও জাতির কাছে অনুমোদনহীন হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারের কোনো জবাবদিহিতা ও দায়বদ্ধতা থাকে না। অর্থ উপার্জনই তাদের মূল উদ্দেশ্য। অবৈধ চিকিৎসা প্রতিষ্ঠান বন্ধ করতে বদ্ধপরিকর সরকার।