নিরাপদ মাতৃত্ব নিশ্চিতকরণে পিছিয়েছে বাংলাদেশ। শিশু ও মাতৃমৃত্যু হার নিম্নমুখী থাকলেও দেশে মাত্র ৫৫ শতাংশ মায়ের নিরাপদ মাতৃত্ব সুবিধা নিশ্চিত করতে পেরেছে সরকার। জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশে এখনো ৬৮ শতাংশ প্রসব বাড়িতে হয় এবং অবশিষ্ট ৩২ শতাংশ হয় প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত সেবা প্রদানকারীদের মাধ্যমে। গর্ভকালীন ১৪ শতাংশ মহিলাই নানাবিধ ঝুঁকিপূর্ণ জটিলতায় ভোগেন, যা মাতৃ মৃত্যুর জন্য বহুলাংশে দায়ী। মাত্র ৬৮ শতাংশ গর্ভবতী মহিলা একটি প্রসবপূর্ব সেবা এবং ২৬ শতাংশ মহিলা চারটি প্রসবপূর্ব সেবা গ্রহণ করে থাকেন। প্রসব পরবর্তী রক্তক্ষরণ, খিঁচুনি, গর্ভকালীন জটিলতা, ঝুঁকিপূর্ণ গর্ভাবস্থা ও পরিবারের অবহেলা মাতৃমৃত্যুর অন্যতম প্রধান কারণ। তবে ৫১ শতাংশ মৃত্যুই রক্তক্ষরণ ও খিঁচুনির কারণে হয়ে থাকে বলে বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। সরকার ঘোষিত মাতৃ মৃত্যুহার হ্র্রাসের পরিসংখ্যান ও প্রচলিত মাতৃস্বাস্থ্য সেবার কার্যক্রম নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন বিশেষজ্ঞরা।
-শতকরা ৬৮% প্রসব হয় বাড়িতে
-বন্ধ হয়নি বাল্যবিয়ে
-প্রসবসেবার ঘাটতি রয়ে গেছে
-পরিবার পরিকল্পনা মাঠকর্মীরা বাড়িতে যান না
তারা বলছেন, মাতৃ মৃত্যুহার হ্রাস পেলেও মায়েদের সার্বিক স্বাস্থ্যসেবার জন্য দেশে এখনো স্থায়ী ব্যবস্থাপনা নেই। মায়ের গর্ভকালীন, প্রসবকালীন ও প্রসব পরবর্তী যত্নের অভাব প্রকট রয়েই গেছে। দেশে প্রতি বছর প্রায় ২২ লাখ নারী মা হন। আর মায়েদের সার্বিক স্বাস্থ্যসেবার জন্য দীর্ঘমেয়াদি ব্যবস্থাপনা না থাকায় তাদের বড় একটি অংশ সব সময় ঝুঁকির মধ্যে থাকেন। মাতৃস্বাস্থ্য সেবা কার্যক্রম শুধু সন্তান প্রসবকেন্দ্রিক সেবার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকছে। সন্তান প্রসবের ৪২ দিনের মধ্যে যারা মারা যান, তাদের ধরেই এ হিসাব করা হয়। কিন্তু একই ধারাবাহিকতায় এর পরবর্তী সময়ে যারা মারা যান, তাদের হিসাব থাকে না, যা মোটেও সমীচীন নয়। তাই মাতৃমৃত্যুর হিসাব করলে সব মায়ের হিসাব করা দরকার। একইভাবে মাতৃস্বাস্থ্যসেবা বললে সব মায়ের স্বাস্থ্যসেবাকে বিবেচনায় নিতে হবে।
নিরাপদ মাতৃত্ব নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে প্রতিশ্রুতি ও মনিটরিং ব্যবস্থার দুর্বলতাকে দায়ী করেছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলেন, নিরাপদ মাতৃত্ব নিশ্চিতে সরকারের অঙ্গীকার ও টাকার অভাব নেই, অভাব আছে প্রতিশ্রুতির বাস্তবায়ন ও মনিটরিং ব্যবস্থার। তাই মনিটরিং ব্যবস্থা শক্তিশালী করার পাশাপাশি সবার কমিটমেন্ট নিয়ে এগিয়ে যাওয়া দরকার।
জাতিসংঘের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে ১ লাখ শিশুর জন্ম দিতে গিয়ে ১৯৬ জন মায়ের মৃত্যু হয়। বর্তমান সরকার জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ ও প্রসূতি মায়ের দক্ষ সেবা নিশ্চিত করার বিষয়টি অগ্রাধিকার দিয়ে বেশ কিছু কার্যক্রম হাতে নিয়েছে। টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে ২০৩০ সালের মধ্যে দেশে মাতৃমৃত্যুর হার প্রতি লাখে ৭০ জনে নামিয়ে আনার লক্ষ্যে সরকার ব্যাপক কাজ করছে। বর্তমানে দেশে মাতৃমৃত্যুর হার লাখে ১৭২ জন।
পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক সাহান আরা বানু সাংবাদিকদের বলেন, সুস্থ শিশু ও সুস্থ মা সবার কাক্সিক্ষত বিষয়। এ জন্যই নিরাপদ মাতৃত্ব ১০০ ভাগে উন্নীত করতে নানা কর্মসূচি বাস্তবায়ন করে যাচ্ছে সরকার। দেশে মাতৃ ও শিশুমৃত্যুহার হ্রাস অব্যাহত রয়েছে। তবে গড়ে তুলতে হবে সামাজিক আন্দোলন। বাল্যবিয়ে এখনো দেশের একটি সামাজিক ব্যাধি। দেশে এখনো মেয়েদের গড় বিয়ের বয়স ১৬ দশমিক ৪ এবং এক-তৃতীয়াংশ মহিলা ২০ বছর বয়স হওয়ার আগেই মা হয়ে যান। স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অধীনে পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তর পরিকল্পিত পরিবার গঠনের লক্ষ্যে পরিবার পরিকল্পনা, মা ও শিশু স্বাস্থ্য, বয়ঃসন্ধিকালীন, প্রজনন স্বাস্থ্য, নিরাপদ মাতৃত্ব, জেন্ডারবিষয়ক কার্যক্রম বাস্তবায়ন করতে নিরলস কাজ করে যাচ্ছে সরকার। দেশের সব সক্ষম দম্পতিদের যদি পরিবার পরিকল্পনা, মা-শিশুস্বাস্থ্য বিষয়ক তথ্য ও সেবা প্রাপ্তির সহজ সুযোগ সৃষ্টি করা যায়, তবে কর্মসূচিতে বিদ্যমান চ্যালেঞ্জগুলো অনেকাংশেই উত্তরণ করা সম্ভব বলে জানান মহাপরিচালক।
অবসটেট্রিক্যাল অ্যান্ড গাইনোকলিজিক্যাল সোসাইটি অব বাংলাদেশের (ওজিএসবি) জেনারেল সেক্রেটারি অধ্যাপক ডা. গুলশান আরা ভোরের আকাশকে বলেন, মা এবং বাচ্চার সুস্থতার জন্য উচ্চমানের সেবার নিমিত্তে যে ব্যবস্থা নেওয়া হয় সেটাই নিরাপদ মাতৃত্ব। এ ব্যবস্থা নেওয়ার প্রধান উদ্দেশ্য মাতৃ মৃত্যুহার কমানো এবং নবজাতকের মৃত্যু ও দীর্ঘমেয়াদি অসুস্থতা রোধ করা। তিনি বলেন, বিশ্বে প্রতিদিন প্রায় ৮৩০ জন মা মারা যান গর্ভকালীন ও প্রসবকালীন জটিলতার কারণে। ৯৯ শতাংশ এ মৃত্যু ঘটে উন্নয়নশীল দেশে। নিরাপদ মাতৃত্বের তিনটি গুরুত্বপূর্ণ তিনটি গুরুত্বপূর্ণ কৌশল হলো কমিউনিটিতে স্বাস্থ্যসেবার ব্যবস্থা, রেফারালের সুবিধা বাড়ানো এবং যোগাযোগের উন্নীতকরণ।
ডা. গুলশান আরা আরো বলেন, নিরাপদ মাতৃত্বের ছয়টি পিলার হলো
পরিবার পরিকল্পনা, গর্ভবস্থায় মায়ের সেবা, প্রসবকালীন মা ও নবজাতকের সেবা, প্রসবপরবর্তী সেবা, গর্ভপাত পরবর্তী সেবা এবং যৌনরোগ/এইচআইভি/এইডস নিয়ন্ত্রণ করা।
মাতৃমৃত্যুর প্রধান দুটি কারণ উল্লেখ করে ডা. গুলশান আরা বলেন, মাতৃমৃত্যুর প্রত্যক্ষ কারণগুলোর মধ্যে রয়েছেÑ রক্তক্ষরণ-গর্ভাবস্থায় ও প্রসব পরবর্তী গর্ভপাতের জটিলতা। অন্যান্য কারণ হলো সংক্রমণ, উচ্চরক্ত চাপ, প্রসবকালীন জটিলতা ও অনিরাপদ গর্ভপাত। আর পরোক্ষ কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে তিন পর্যায়ের বিলম্ব-সেবা গ্রহণের সিদ্ধান্ত, হাসপাতালে পৌঁছানো ও সেবা প্রদানে বিলম্ব এবং হাসপাতালে পৌঁছানোর সুবিধা না থাকা।
অবসটেট্রিক্যাল অ্যান্ড গাইনোলজিক্যাল সোসাইটি অব বাংলাদেশের সাবেক সভাপতি অধ্যাপক ডা. রওশন আরা বেগম ভোরের আকাশকে বলেন, একজন গর্ভবতী মা মনে করেন, যিনি কয়েকবার শরীর পরীক্ষা করেছেন, তিনিই প্রসব করাবেন। এ ধারণা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। প্রসবের জন্য দক্ষ মিডওয়াইফের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। প্রসবকক্ষে চারজন মিডওয়াইফ নিশ্চিত করতে হবে। তাদের ভিন্ন কোনো কাজে লাগানো যাবে না।
কোনো কোনো ক্ষেত্রে ডাক্তারদের চেয়ে মিডওয়াইফরা বেশি প্রসব করাচ্ছেন। তিনি আরো বলেন, খিঁচুনি ও গর্ভকালীন রক্তক্ষরণ বন্ধের জন্য অনেক হাসপাতালে প্রয়োজনীয় উপকরণ সরবরাহ করা হয়। কিন্তু এগুলো সংরক্ষণের সুষ্ঠু ব্যবস্থা নেই। হাসপাতালের পরিচালকদের অনুরোধ করে রক্তক্ষরণ প্রতিরোধের ব্যবস্থা করা হয়েছে। তবু অনেক হাসপাতালে এ সমস্যা থেকে গেছে। হাসপাতালে ওষুধ পাঠানো হচ্ছে কিন্তু তা সংরক্ষণ ও বিতরণের জন্য তত্ত্বাবধান করা হচ্ছে না। এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নিতে হবে।