নিবন্ধন কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করেনি এমন অবৈধ হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারের তালিকা নেই স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কাছে। যেসব প্রতিষ্ঠানের নিবন্ধন আছে বা নিবন্ধনের জন্য আবেদন করেছে, শুধুমাত্র সেগুলোর পরিসংখ্যান অধিদপ্তরের কাছে রয়েছে। নিবন্ধন কার্যক্রমে অংশ নিয়ে অনিবন্ধিত ও অবৈধ হিসেবে থাকা প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ১২ হাজারের বেশি। বর্তমানে এমন প্রতিষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধে চলছে অভিযান। আর যেসব প্রতিষ্ঠান কখনো নিবন্ধন কার্যক্রমে অংশ নেয়নি, সেগুলো অধিদপ্তরের নজরের বাইরে রয়ে গেছে। তালিকাভুক্ত ১২ হাজার প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে অভিযান চালাতেই হিমশিম খাচ্ছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ও সংশ্লিষ্টরা। লেনদেনের মাধ্যমেই অবৈধ চিকিৎসাপ্রতিষ্ঠানসমূহ টিকে থাকে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।
-শুধুমাত্র নিবন্ধন কার্যক্রমে অংশগ্রহণকারী প্রতিষ্ঠানের পরিসংখ্যান রয়েছে অধিদপ্তরের কাছে
-অবৈধ প্রতিষ্ঠানের প্রকৃত সংখ্যা সরকারি তালিকার কয়েক গুণ বেশি
দেশের নিবন্ধিত ও অনিবন্ধিত হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারের পূর্ণাঙ্গ তালিকার বিষয়ে গত ২৮ মে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (হাসপাতাল ও ক্লিনিক) ডা. মো. বেলাল হোসেন সাংবাদিকদের বলেন, আমাদের কাছে অনিবন্ধিত বা অবৈধ কোনো স্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠানের তালিকা নেই। তবে নিবন্ধিত বেসরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারের তালিকা রয়েছে। প্রত্যেকটি শহরে ও জেলায় একটি নির্দিষ্টসংখ্যক নিবন্ধিত ক্লিনিক ও হাসপাতাল আছে। তার তালিকা সিভিল সার্জনদের কাছে রয়েছে। এর বাইরে কোনো প্রতিষ্ঠান থাকলে তারা তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করবে এবং সেগুলোর তালিকা তৈরি করে আমাদের কাছে পাঠাবে।
তিনি আরো বলেন, আমরা ঘোষণা দিচ্ছি, যেন তারা নিজেরাই এসব প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেয়। তাহলে আমরা তাদের সাধুবাদ জানাব। আর তা না হলে আমরা নিজেরা ব্যবস্থা গ্রহণ করব। এক্ষেত্রে সিলগালা করে দেওয়াসহ কঠোর শাস্তি দেওয়া হবে বলে জানান পরিচালক।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সারাদেশে অলিগলিতে চিকিৎসাসেবার নামে অবাধে অবৈধ ব্যবসা করে যাচ্ছে অসংখ্য অনিবন্ধিত হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক। এসব অবৈধ প্রতিষ্ঠানে সরকারি নিয়ন্ত্রণ থাকে না। বিভিন্ন সময় দায়িত্বপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা ও অবৈধ চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানের মালিকদের যোগসাজশ ও লেনদেনের অভিযোগ পাওয়া গেছে। বিভিন্ন সময় অভিযান পরিচালিত হলেও এর ধারাবাহিকতা খুব একটা লক্ষ করা যায়নি। জনবলের অভাব, স্থানীয় স্বাস্থ্য কর্মকর্তাদের উদাসীনতা, অভিযানকালে নিরাপত্তার অভাব এবং রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের অসহযোগিতার কারণে মনিটরিং চরমভাবে ব্যাহত হয়ে থাকে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা ভোরের আকাশকে বলেন, বিভিন্ন সময় বেসরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারের কর্তৃপক্ষকে চাপ দেওয়া হলেও তা কাজে আসেনি। কারণ এসব প্রতিষ্ঠানের মালিকরা প্রভাবশালী। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরকে তারা পাত্তা দেয় না। ক্ষমতাসীন দলের নেতা ও এমপি-মন্ত্রীদের সঙ্গে তাদের সখ্যতা থাকে। অনেক সময় প্রশাসনের সঙ্গে আঁতাত করেই তারা তাদের রমরমা বাণিজ্য করেন। এ ছাড়া এত হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক পরিদর্শনের মতো জনবলও নেই অধিদপ্তরের।
সরকারি পরিসংখ্যানেই অবৈধ প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা প্রায় ১২ হাজার
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের প্রতিবেদন অনুযায়ী, সরকার সর্বশেষ ২০২০ সালে দেশব্যাপী হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারসমূহের নিবন্ধন এবং মেয়াদোত্তীর্ণ প্রতিষ্ঠানসমূহের লাইসেন্স নবায়ন কার্যক্রম পরিচালনা করে।
বেঁধে দেওয়ার সময়ের মধ্যে আবেদন জমাদানকারীদের পরিসংখ্যানের ভিত্তিতে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের প্রতিবেদনে দেখা গেছে, হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিকের লাইসেন্স পেতে আবেদন করেননি সংশ্লিষ্ট দপ্তরে; কিন্তু দিব্যি চিকিৎসা কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে কয়েক হাজার বেসরকারি চিকিৎসাকেন্দ্র।
আবার কেউ কেউ লাইসেন্সের জন্য আবেদন করে চিকিৎসা কার্যক্রম চালাচ্ছে বছরের পর বছর। সব মিলিয়ে প্রায় ১২ হাজার হাসপাতাল-ক্লিনিক স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অনুমোদন ছাড়া চিকিৎসাসেবার নামে চালিয়ে যাচ্ছে অবৈধ ব্যবসা।
দেশে অনুমোদনহীন ১১ হাজার ৯৪০টি হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারের মধ্যে ২ হাজার ৯১৬টি হাসপাতাল ও ক্লিনিক লাইসেন্সের জন্য কোনো আবেদনই করেনি। ৯ হাজার ২৪টি হাসপাতাল-ক্লিনিকের মধ্যে বেশির ভাগ লাইসেন্সের জন্য আবেদনের পর অনুমোদন ছাড়াই চিকিৎসা শুরু করেছে।
অবৈধ প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা পরিসংখ্যানের কয়েক গুণ বেশি সরকারি পরিসংখ্যানের কয়েক গুণ বেশি অবৈধ হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার অবাধে ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে বলে অভিযোগ রয়েছে।
বিষয়টি উত্থাপন করা হলে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (হাসপাতাল ও ক্লিনিক) ডা. মো. বেলাল হোসেন সাংবাদিকদের বলেন, আমরা অবৈধ হাসপাতাল ও ক্লিনিক নিজেদের উদ্যোগেই বন্ধ করার জন্য ৭২ ঘণ্টার সময় বেঁধে দিয়েছিলাম। সেটা শেষ হওয়ার পর সারাদেশে অভিযান শুরু হয়েছে। আমাদের এই অভিযান অব্যাহত থাকবে। অবৈধ ক্লিনিক-হাসাপাতালের সংখ্যা অনেক বেশি হতে পারে। তবে সঠিক সংখ্যা বলা সম্ভব নয়।
বাংলাদেশ বেসরকারি ক্লিনিক, হাসপাতাল ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার মালিক সমিতির সভাপতি ডা. মো. মনিরুজ্জামান সাংবাদিকদের বলেন, আমাদের সদস্যসংখ্যা ১১ হাজার। তারা সবাই লাইসেন্সপ্রাপ্ত। তবে অনেক অবৈধ প্রতিষ্ঠান আছে। তাদের বিরুদ্ধে আমরা এই অভিযানকে স্বাগত জানাই। তিনি দাবি করেন, যাদের লাইসেন্স আছে কিন্তু শর্ত পূরণ করছে না তাদের অবৈধ বলা যাবে না। তবে তাদের শর্ত পূরণের জন্য মনিটরিংয়ের আওতায় আনা দরকার।
তিনি আরো বলেন, অনেক হাসপাতাল ও ক্লিনিক আছে যাদের লাইসেন্স নাই, ডাক্তার নাই, নার্স নাই, তারা এতদিন কীভাবে টিকে আছে এই প্রশ্ন আমাদেরও।
চিকিৎসা প্রতিষ্ঠান মালিকদের অভিযোগ
নাম প্রকাশ না করার শর্তে বেসরকারি চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানের কয়েকজন মালিক অভিযোগ করেন, নিবন্ধনের জন্য স্বাস্থ্য অধিদপ্তর যেসব শর্ত দিয়েছে, যেসব শর্ত জুড়ে দিয়েছে, তা কোনো প্রতিষ্ঠানের পক্ষে পূরণ করা সম্ভব নয়। তবে উৎকোচ দিলে ঠিকই নিবন্ধন মেলে কিংবা নিবন্ধন ছাড়াই কার্যক্রম চালানো যায়। উৎকোচ ও অবাস্তব শর্ত পরস্পর সম্পর্কযুক্ত।
এ প্রক্রিয়া একটি ব্যবস্থাকে ধ্বংস করে এবং স্বাস্থ্য খাতে তাই হয়েছে। অবাস্তব শর্তের কারণে অনেক বেসরকারি হাসপাতাল যেমন লাইসেন্স নবায়ন করতে ব্যর্থ হচ্ছে, তেমনি উৎকোচের মাধ্যমে কোনো নিবন্ধনের শর্ত পূরণ ছাড়াই লাইসেন্স মিলছে, নবায়ন হচ্ছে। বেসরকারি খাতের অনেক মালিক এর সুযোগ নিচ্ছেন এবং খাতটি নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে পড়ছে।
একজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসককে দুই বা ততোধিক হাসপাতালের চিকিৎসক হিসেবে দেখানো অনৈতিক। কিন্তু অনেক বেসরকারি হাসপাতাল তাই করছে। আর স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের একশ্রেণির অসাধু কর্মকর্তা ও কর্মচারী প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন না করেই সনদ দিচ্ছেন বলে অভিযোগ করেন মালিকরা।