logo
আপডেট : ৪ জুন, ২০২২ ১২:৩১
৪ জুন জাতীয় চা দিবস
চা শ্রমিকদের ভাগ্যে কোনো পরিবর্তন আসেনি
পুলক পুরকায়স্থ, মৌলভীবাজার

চা শ্রমিকদের ভাগ্যে কোনো
পরিবর্তন আসেনি

ছবি : সংগৃহীত

চা বাগান। শিল্পীর তুলির আঁচড়ের মতো সাজানো সবুজের এই রাজ্য দারুণভাবে টানে প্রকৃতিপ্রেমীসহ অনেকেই। চা-বাগানের সবুজ বুকে পাতা তোলার ছবি যতটা চোখকে মুগ্ধ করে, এই চা শিল্পের শিল্পী চা শ্রমিকদের জীবনের গল্প ততটা আনন্দদায়ক বা সৌন্দর্যে মোড়া নয়। এখানে আছে কান্না ও আর্তনাদ। ৪ জুন, শনিবার জাতীয় চা দিবস। দ্বিতীয় জাতীয় চা দিবসের এবারের প্রতিপাদ্য চা দিবসের সংকল্প, সমৃদ্ধ চা শিল্প।

মৌলভীবাজারে এবারো নানা কর্মসূচির মধ্যে দিনটি পালন করবেন চা জনগোষ্ঠীর সদস্যরা। সারা দেশে ১৬৬টি চা বাগান রয়েছে, এর মধ্যে সিলেট বিভাগে ১৩৫টি চা বাগান, যার মধ্যে শুধু মৌলভীবাজার জেলায় রয়েছে দেশের অর্ধেকেরও বেশি ৯২টি চা বাগান।

বাংলাদেশ চা বোর্ড সূত্রে জানা যায়, সঠিক ব্যবস্থাপনার ফলে করোনাকালেও ২০২১ সালে দেশের ১৬৭টি চা বাগান এবং ক্ষুদ্রায়তন চা বাগান থেকে রেকর্ড পরিমাণ ৯ কোটি ৬৫ লাখ কেজির কিছু বেশি চা উৎপাদিত হয়, যা চা শিল্পের ইতিহাসে অতীতের সব রেকর্ড ভেঙে সর্বকালের রেকর্ড করেছিল।

বাংলাদেশ চা বোর্ডের সবশেষ প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২০ সালে মহামারির প্রথম বছরে চা উৎপাদনেও ধাক্কা লেগেছিল। তখন ৮ কোটি ৬৩ লাখ কেজি চা উৎপাদিত হয়। এর আগে সর্বোচ্চ রেকর্ড ছিল ২০১৯ সালে। সেবার ৯ কোটি ৬০ লাখ কেজি চা উৎপাদিত হয়েছিল।
চা শ্রমিক ইউনিয়নের সূত্র মতে, বর্তমানে সারা দেশে ১৬৬টি চা বাগানে চা জনগোষ্ঠী রয়েছেন ৫ লক্ষাধিক। এর মধ্যে শ্রমিক রয়েছেন ১ লাখ ৪০ হাজার ১৬৪ জন। এছাড়া সিলেট বিভাগের তিন জেলায় ১৩৫টি চা বাগান রয়েছে। যেখানে ৪৬ হাজার ৪৫০ জন নিবন্ধিত শ্রমিক এবং ১৫ হাজার ১৫৩ জন অনিবন্ধিত শ্রমিক কাজ করছেন।

জানা গেছে, সপ্তাহ শেষে ৮৪০ টাকা মজুরিতে রোদে পুড়ে, বৃষ্টিতে ভিজে নারী শ্রমিকরা বিশাল বাগানের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে চায়ের পাতা তোলেন। তারা দল বেঁধে পাহাড়ের পর পাহাড়ের গাঁ বেয়ে টিলায় টিলায় এই কাজ করেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে পর্যাপ্ত খাদ্য, চিকিৎসাসহ মৌলিক অধিকারও ঠিকমতো পান না তারা। অপুষ্টি ও দরিদ্রতায় যেন নতজানু এক একটি চা শ্রমিকের পরিবার।
চা শ্রমিকরা আক্ষেপ করে জানান, চা শিল্পের উন্নতি হলেও বদলাচ্ছে না চা শ্রমিকদের জীবন। সারা দিন কাজের পর একজন চা শ্রমিকের আয় হয় ১২০ টাকা। নেই নিজস্ব জাতিগত পরিচয়, লেখাপড়ার সুযোগ নেই, নেই স্যানিটেশনও, রয়েছে চিকিৎসার অভাব।

দেওরাছড়া চা বাগানের চা শ্রমিক ব্রিটিশ ঘাটুয়াল বলেন, পাঁচ থেকে ছয় সদস্যের অনেক পরিবার আছে যেখানে একজন কাজ পাচ্ছেন আর বাকিরা এই ১২০ টাকার ওপর নির্ভর করেই দিন চালাচ্ছে। ছোট ভাঙাচোরা ঘরে থাকতে হয় গবাদি পশুসহ সন্তানদের নিয়ে। বাগান কর্তৃপক্ষের ঘর মেরামত করে দেওয়ার কথা থাকলেও তা হয় না বছরের পর বছর। নেই নিজস্ব কোনো জায়গা। বাগানে কাজ না করলে থাকার জায়গাও হারাতে হবে।

সিলেট চা জনগোষ্ঠী ছাত্র যুব কল্যাণ পরিষদের সহ-সভাপতি সুজিত বাড়াইক বলেন, ‘২০২০ সালের চুক্তি অনুসারে একজন শ্রমিককে অবসর ভাতা হিসেবে সে যত বছর কাজ করেছে তার মোট বছরের গড়ে দেড় মাসের বেতন হিসেবে পেনশন দেওয়ার কথা। কিন্তু সেটা শুধু কাগজে কলমে।’

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষার্থী, চা জনগোষ্ঠীর সদস্য, সন্তোষ রবিদাশ বলেন, ‘আমরা আমাদের অধিকারের জন্য লড়ছি। বঞ্চিত হচ্ছি বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা থেকে, আমাদের নেই কোনো নির্দিষ্ট ভূখ-, নেই কোনো চাকরিতে কোটা। চা-শ্রমিকের সন্তান হিসেবে আমাদের এখনো অনেকভাবে অপদস্ত হতে হয়।’

চা বাগানের শ্রমিকদের ভাগ্যের কোনো পরিবর্তন আসেনি জানিয়ে, চা শ্রমিক ইউনিয়নের মনু ধলাই ভ্যালির সভাপতি ধনা বাউরি বলেন, ‘উন্নয়নের ছোঁয়া লাগেনি আমাদের জীবনযাত্রায়। এমনকি মৌলিক অধিকারও ভোগ করার সুযোগ পাচ্ছি না। চা বাগানের এই জনগোষ্ঠী এখনো ব্রিটিশ সামন্তবাদ আর স্থানীয় বাবু-সাহেবদের বেড়াজাল ছিন্ন করতে পারেনি।’