সারা দেশে চালের মজুতবিরোধী অভিযান চললেও দামে এর প্রভাব পড়ছে না। এক পক্ষ আরেক পক্ষকে দোষ দিচ্ছে।
কিন্তু জবাব মিলছে না ভর মৌসুমে নতুন চালের পরিবর্তে কেন পুরাতন চাল বিক্রি হচ্ছে। কেনই বা দাম কমার পরিবর্তে বাড়ছে!
মজুতবিরোধী অভিযান চলাকালে উত্তরাঞ্চলে সব চেয়ে বেশি জরিমানা ও গোডাউনে সিলগালার ঘটনা ঘটেছে।
চালের প্রধান মোকাম কুষ্টিয়াতে অভিযান চালালেও বড় ধরনের কোন অনিয়ম ধরা পড়েনি। বরিশাল, দেশের পূর্বাঞ্চলের কিছু জরিমানার ঘটনা ঘটেছে।
রাজধানীতে চালের প্রধান মোকাম বাদামতলীসহ দেশের কয়েক স্থানে অভিযানের খবর শুনে দোকান বন্ধ করে পালানোর ঘটনাও ঘটেছে।
কিন্তু বাজারে চালের দামে এর কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। কুষ্টিয়ার চাল মোকামের মিলমালিকরা বলছেন, ধানে অন্য বছরের তুলনায় কম চাল হওয়ার কারণে ভরা মৌসুমেও চালের দাম কমছে না।
তারা বলছেন, ভরা মৌসুমে চালের দাম না কমার পেছনে কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানগুলোর চাল মজুত করা।
সারা দেশে বাৎসরিক চালের চাহিদা চার কোটি মেট্রিক টনের নীচে। এর মধ্যে বোরো মৌসুমে উৎপাদন হয় প্রায় সোয়া দুই কোটি মেট্রিক টন।
কৃষি মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে এবারো যথারীতি ধান উৎপাদন হয়েছে।
খাদ্যমন্ত্রী সরাসরি অভিযোগ করে বলেছেন, চালের উৎপাদন কম না হলেও কর্পোরেট সাতটি প্রতিষ্ঠান যুক্ত হওয়া ও মজুতদারির কারণে ভরা মৌসুমে চালের দাম কমছে না।
এসব প্রতিষ্ঠান চাল কিনে মজুত করছে। এ কারণে বাজারে নতুন চাল আসছে না।
গত কয়েক বছর ধরে এসব প্রতিষ্ঠান চাল বাজারজাত করণে নামলেও এত বেশিভাবে প্রভাব ফেলতে পারেনি। এবারই চাল মজুত করে চালের দামে বড় ধরনের প্রভাব বিস্তার করেছে বলে মনে করছে চালকলের মালিকদের একটি অংশ।
এর কারণ হলো করোনা পরবর্তি বৈশ্বিক মহামারীর মূল্যস্ফীতিতে বড় ধরনের প্রভাব ফেলেছে।
সেই সঙ্গে ইউক্রেন যুদ্ধ, খাদ্য উৎপাদন, রপ্তানি ও সরবারহের পথে বড় ধরনের প্রতিবন্ধকতা তৈরি করেছে।
আগামীতে খুব শীঘ্রই যুদ্ধ না থামা ও খাদ্য সরবারহ স্বাভাবিক হওয়ার সম্ভাবনা না থাকাকে সামনে রেখে বড় পুঁজির কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানগুলো চাল মজুত করতে নেমেছে।
সরকারের সঙ্গে মিলে গেল চালকল মালিকদের বক্তব্য।
মজুতবিরোধী অভিযানে নেমে স্কয়ার, এসিআইয়ের মতো প্রতিষ্ঠানকে দেখা যায় খাদ্য মজুত করতে।
দক্ষিণাঞ্চলেও ভূয়া প্রতিষ্ঠানের নামে চাল প্যাকেট করে মজুত করতে দেখা গেছে। এ ছাড়া দেশের পূর্বাঞ্চলেও চালের মজুত উদ্ঘাটন করে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর।
অভিযানে ঠাকুরগাঁওয়ে সবচেয়ে বেশি নয়টি প্রতিষ্ঠান থেকে ২ লাখ ৩৫ হাজার টাকা জরিমানা আরোপ ও আদায় করা হয়েছে।
খাগড়াছড়ির লাইসেন্স না থাকা, অতিরিক্ত দাম নেওয়া এবং অতিরিক্ত চাল মজুত করায় আটটি প্রতিষ্ঠানকে এক লাখ ১২ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়েছে।
এ ছাড়া ঢাকা বিভাগের মাদারীপুরের দুটি ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করে জরিমানা আদায় হয়েছে ২০ হাজার টাকা আর ফরিদপুরের চকবাজার, মধুখালী ও সালথায় অভিযানে ৫৪ হাজার টাকা জরিমানা আদায় হয়েছে।
এ ছাড়া খুলনা বিভাগের বাগেরহাটে একটি প্রতিষ্ঠানকেই জরিমানা করা হয়েছে এক লাখ টাকা।
চট্টগ্রামের বাকলিয়া ও বন্দর এলাকায় তিনটি প্রতিষ্ঠানকে জরিমানা করা হয়েছে ১৮ হাজার টাকা, বান্দরবানের দুটি প্রতিষ্ঠানকে ১১ হাজার টাকা, খাগড়াছড়ির আটটি প্রতিষ্ঠানকে এক লাখ ১২ হাজার টাকা, ফেনীতে দুটি প্রতিষ্ঠানকে ৫ হাজার টাকা, লক্ষীপুরে দুটি প্রতিষ্ঠানকে ৬ হাজার টাকা, কুমিল্লায় তিন প্রতিষ্ঠানকে ২০ হাজার টাকা এবং ব্রাহ্মণবাড়িয়ার চারটি প্রতিষ্ঠানকে করা হয়েছে ৪৫ হাজার টাকা জরিমানা।
রাজশাহীর বগুড়ার সাবগ্রাম ও পীরগাছায় ৯টি প্রতিষ্ঠানে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনার কথা জানিয়ে প্রতিবেদনে বলা হয়, তিনটি চালের দোকানকে জরিমানা করা হয়েছে ৫৬ হাজার টাকা।
নাটোরে একটি প্রতিষ্ঠানকে জরিমানা করা হয়েছে ৫০ হাজার টাকা, চাঁপাইনবাবগঞ্জে ৩টি রাইস মিলকে ১৪ হাজার টাকা, জয়পুরহাটে ৬ খুচরা ব্যবসায়ীকে ৫৫ হাজার টাকা এবং নওগাঁওয়ে ১২টি অভিযানে মোট জরিমানা করা হয়েছে এক লাখ ৫৪ হাজার টাকা।
এগুলো চলমান মজুতবিরোধী অভিযানের খণ্ড চিত্র।
মন্ত্রীর মজুতবিরোধী অভিযান পরিচালনার আগে দৈনিক ভোরের আকাশের প্রতিবেদনে তুলে ধরা হয়েছিল মজুতদাররা চাল মজুত করছে বেশি দাম নেওয়ার জন্য।
আগে মজুত করা পুরাতন চালই এখন বাজারে আছে, নতুন চাল বাজারে নেই। আর এ কারণে চালের দাম কমছে না।
চালের বড় মোকাম কুষ্টিয়ার মিল মালিকরা বলছে, নতুন ধান থেকে চালের হার কম হচ্ছে। এতে চাল উৎপাদনে বেশি খরচ পড়ছে।
এ কারণে চালের দাম বাড়ানো হচ্ছে। ধান পাকার আগেই কাটার কারণে ধান থেকে চালের উৎপাদন কম হয়েছে বলে স্বীকার করেন কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক সুশান্ত কুমার।
তিনি বলেন, বিভিন্ন কারণে ধান থেকে চাল কম হতে পারে। এবার আগেভাগেই কৃষককে ধান কাটতে হয়েছে। এ কারণে কোনো কোনো এলাকায় ধান একেবারে পরিপুষ্ট হয়নি।
সেখান থেকে কিছুটা চাল কম হতে পারে। তাহলে নতুন চাল বাজারে এত দেরিতে এলো কেন? এর সঠিক জবাব নেই।
চাল বাজারের সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, চাল মজুতদারির সঙ্গে বৈশ্বিক খাদ্য উৎপাদন ও পরিবহনে বিঘ্ন এটা বলার অপেক্ষা রাখে না।
আর কবে পরিস্থিতি ঠিক হবে, তাও বলা কঠিন। এ কারণে ধানের উৎপাদন হলেও মানুষের কাছে পৌঁছানোর ক্ষেত্রে ব্যবস্থাপনা কতটা সুসম থাকবে তা বলা কঠিন।
আর এর উপরেই নির্ভর করছে চালের বাজার সঠিক রাখা।