logo
আপডেট : ৫ জুন, ২০২২ ১০:৩১
যুবলীগ নেতা মিল্কি হত্যা মামলার দ্রুতবিচার নিয়ে প্রশ্ন
৪ তলা থেকে ৩ তলায় নথি পৌঁছায়নি আড়াই মাসেও
এম বদি-উজ-জামান

৪ তলা থেকে ৩ তলায় নথি পৌঁছায়নি আড়াই মাসেও

ছবি: সংগৃহীত

চাঞ্চল্যকর ঢাকা মহানগর যুবলীগের (দক্ষিণ) সাংগঠনিক সম্পাদক রিয়াজুল হক খান মিল্কি হত্যা মামলায় অভিযোগ গঠনের মধ্য দিয়ে আসামিদের বিরুদ্ধে বিচার শুরুর পর সাড়ে তিন বছর কেটে গেছে। এ সময়ে ৭৫ সাক্ষীর মধ্যে মাত্র চারজনের সাক্ষ্যগ্রহণ করা গেছে। ফলে প্রশ্ন উঠেছে, মামলার বিচার কতদূর? তবে আশার কথা, মামলাটির দ্রুত বিচার সম্পন্ন করতে ঢাকার দ্রুতবিচার ট্রাইব্যুনাল-২ এ পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার।

মামলাটি বদলির আদেশও পাঠানো হয়েছে সংশ্লিষ্ট ঢাকার ৫ নম্বর অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ আদালত। এই সিদ্ধান্ত হয়েছে তাও আড়াই মাস আগে। অথচ এখনো মামলার নথি দ্রুতবিচার ট্রাইব্যুনাল-২-এ পৌঁছায়নি। ফলে প্রশ্ন উঠেছে ঢাকার ৫ নম্বর অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ আদালত থেকে ঢাকার দুই নম্বর দ্রুতবিচার ট্রাইব্যুনাল কতদূর? একই ভবনের চারতলায় থাকা অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ আদালত থেকে তিনতলায় থাকা ট্রাইব্যুনালে মামলার নথি না পৌঁছায় দ্রুত নিষ্পত্তিতে আন্তরিকতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।

এ বিষয়ে রাষ্ট্রপক্ষে মামলা পরিচালনার দায়িত্বে থাকা ঢাকা মহানগর পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) আবদুল্লাহ আবু ভোরের আকাশকে বলেন, দায়রা জজ আদালতে অসংখ্য মামলা। এ কারণে একেকটি মামলায় দীর্ঘদিন পরপর তারিখ পড়ে। ফলে মামলার বিচারে বিলম্ব হয়। তিনি বলেন, এ কারণে সরকার এই মামলাটির দ্রুতবিচার সম্পন্ন করতে দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে। আশা করছি, দ্রুতবিচার ট্রাইব্যুনালে মামলাটি দ্রুত নিষ্পত্তি হবে।

দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল-২-এ দায়িত্বরত সহকারী পাবলিক প্রসিকিউটর (এপিপি) অ্যাডভোকেট সাদিয়া আফরিন শিল্পী ভোরের আকাশকে বলেন, মিল্কি হত্যা মামলার নথি ট্রাইব্যুনালে এসেছে কিনা তা আমার জানা নেই। তবে নথিটি আসলে তা জানতাম। তিনি বলেন, অন্য আদালত থেকে মামলা বদলি হয়ে আমাদের ট্রাইব্যুনালে পাঠানোর আদেশ হলেও নির্ধারিত দিনের আগে (আগের আদালতের ধার্য তারিখ) সাধারণত নথি আসে না। দেখা যায়, যেদিন মামলার ধার্য তারিখ, সেদিন সকালে নথি পাঠানো হয়েছে, এটা বড় সমস্যা। দীর্ঘদিন ধরেই এ সমস্যা চলছে। তিনি বলেন, এই সমস্যার সমাধান করতে সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীলদের আরো তৎপর হতে হবে।

জানা যায়, ঢাকার ৫ নম্বর অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ আদালতে ২০১৮ সালের ৮ নভেম্বর আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠনের মধ্য দিয়ে বিচার শুরু হয়। ফলে সাড়ে তিন বছর আগে থেকেই মিল্কি হত্যা মামলাটির নথি আছে এ আদালতে। মামলাটি দ্রুতবিচারের জন্য গত ২১ মার্চ ঢাকার দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল-২-এ বদলির আদেশ দিয়েছে সরকার।

ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালত ভবনের চারতলায় অবস্থিত ৫ নম্বর অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ আদালত থেকে নথিটি যাওয়ার কথা একই ভবনের তৃতীয়তলায় অবস্থিত দ্রুতবিচার ট্রাইব্যুনাল-২-এ। মাত্র একতলা নিচে থাকা আদালতে নথি পাঠাতে আড়াই মাসেরও বেশি সময় লাগার হেতু কি তা জানা নেই কারো। মামলাটির বিচার বিলম্বিত করতেই কি নথি পাঠাতে গড়িমসি-এখন এই প্রশ্ন দেখা দিয়েছে।

২০১৩ সালের ২৯ জুলাই রাতে মাত্র ১৪ সেকেন্ডের মধ্যেই মিল্কি হত্যার ঘটনা ঘটে। হত্যার এ মর্মান্তিক দৃশ্য প্রত্যক্ষ করেন গুলশান-১ এর শপার্স ওয়ার্ল্ড মার্কেটের ক্রেতা ও পথচারীরা। মধ্যরাতের শ্বাসরুদ্ধকর এ দৃশ্যটি ধরা পড়ে শপার্স ওয়ার্ল্ডের ক্লোজ সার্কিট (সিসি) ক্যামেরায়। আলোচিত এ হত্যাকা-ের পর ৩০ জুলাই রাত ১২টার দিকে গুলশান থানায় নিহত মিল্কির ছোট ভাই মেজর রশিদুল হক খান বাদী হয়ে একটি হত্যা মামলা করেন।

মামলার এজাহারে আরেক যুবলীগ নেতা এস এম জাহিদ সিদ্দিকী তারেক (পরে ক্রসফায়ারে নিহত), জাহিদুল ইসলাম টিপু, চঞ্চল ও আরিফসহ ১১ জনের নাম উল্লেখ করা হয়। এছাড়া আরো চার থেকে পাঁচজন অজ্ঞাতনামা ব্যক্তিকে আসামি করা হয়। এ মামলায় তদন্ত শেষে ২০১৪ সালের ১৫ এপ্রিল তারেকসহ ১২ জনকে অভিযুক্ত করে আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করেন র‌্যাব-১-এর কর্মকর্তা সহকারী পুলিশ সুপার কাজেমুর রশিদ।

তবে কারাবন্দি ৯ জনকে মামলার অভিযোগ থেকে অব্যাহতির সুপারিশ করা হয়। পাশাপাশি ৩১ জুলাই র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটেলিয়ানের (র‌্যাব) সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে নিহত তারেককে মামলা থেকে অব্যাহতির আবেদন করা হয়। এ দফায় সাক্ষী করা হয় ২৬ জনকে। এই অভিযোগপত্রের বিরুদ্ধে ওই বছরের ৯ জুন আদালতে নারাজির আবেদন করেন মামলার বাদী। ঢাকা মহানগর হাকিম আদালত ২০১৪ সালের ১৭ জুন সিআইডিকে অধিকতর তদন্তের নির্দেশ দেয়। এরপর সিআইডির সহকারী পুলিশ সুপার উত্তম কুমার বিশ্বাস অধিকতর তদন্ত শেষে ২০১৫ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর অভিযোগপত্র দাখিল করেন। আগের অভিযোগপত্রে ১১ আসামির সঙ্গে আরো সাতজনকে অন্তর্ভুক্ত করে মোট ১৮ জনের বিরুদ্ধে সম্পূরক অভিযোগপত্র দাখিল করা হয়।

এছাড়া ৯ জনকে মামলার দায় থেকে অব্যাহতির সুপারিশ করা হয়। মামলায় সাক্ষী করা হয় ৭৫ জনকে। এলাকায় আধিপত্য বিস্তার, সাংগঠনিক পদ, জমি দখল ও বিভিন্ন উৎস থেকে প্রাপ্ত অর্থ ভাগ বণ্টন নিয়ে মিল্কির সঙ্গে তারেকের বিরোধের জের ধরে এ হত্যাকা- বলে অভিযোগপত্রে বলা হয়।

এরপর আইনগত প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে মামলাটি বিচারের জন্য পাঠানো হয় ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালতে। মামলাটি বদলি হয়ে ঢাকার ৫ নম্বর অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ আদালতে ২০১৮ সালের ৮ নভেম্বর আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠনের মধ্য দিয়ে বিচার শুরু হয়। সেই থেকে এ পর্যন্ত ৭৫ জন সাক্ষীর মধ্যে মাত্র চারজনের সাক্ষ্যগ্রহণ করা গেছে।

অভিযোগপত্রে বলা হয়, নিহত মিল্কি ও আসামি তারেক (পরে র‌্যাবের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে নিহত) একত্রে মতিঝিল এজিবি কলোনি এলাকায় রাজনীতি করতেন। মিল্কি ঢাকা মহানগরের (দক্ষিণ) সাংগঠনিক সম্পাদক ও তারেক যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। এলাকায় আধিপত্য বিস্তার, সাংগঠনিক পদ, জমি দখল ও বিভিন্ন উৎস থেকে প্রাপ্ত অর্থ ভাগ বণ্টন নিয়ে তাদের মধ্যে চাপা বিরোধ চলছিল। ঢাকা সিটি করপোরেশন নির্বাচনে মতিঝিল ১০ নম্বর ওয়ার্ডে নিহত মিল্কি কমিশনার পদপ্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করতে চেয়েছিলেন। এক পর্যায়ে তাদের মধ্যে বিরোধ প্রকাশ্যে রূপ নেয়।

তখন থেকে এলাকায় যেকোনো রাজনৈতিক কর্মসূচিতে নিহত মিল্কি ও তারেকের পক্ষে আলাদা আলাদা মিছিল মিটিং হতো। অন্যদিকে তারেক ও চঞ্চলের মধ্যে ব্যবসায়িক, রাজনৈতিক ও বিভিন্ন বিষয়ে অতি ঘনিষ্ঠতার কারণে তারেকের পক্ষ নিয়ে মিল্কিকে ঘায়েল করার পরিকল্পনা করতে থাকেন চঞ্চল। ওই রূপরেখা বাস্তবায়ন করতে পরিকল্পনা অনুযায়ী তারেক আগে থেকেই ঘটনাস্থলে অবস্থান নেন। ভিডিও ফুটেজ, জব্দকৃত আলামত, সাক্ষীর জবানবন্দি ও আসামিদের দেওয়া স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দির আলোকে ওই হত্যার ঘটনায় তারেকের নেতৃত্বে একই উদ্দেশে পরস্পর সহযোগিতায় আসামিরা হত্যাকাণ্ড ঘটায়।