logo
আপডেট : ৫ জুন, ২০২২ ১১:২৮
আলো জ্বলল পদ্মা সেতুতে
রাজন ভট্টাচার্য

আলো জ্বলল পদ্মা সেতুতে

ছবি: সংগৃহীত

দক্ষিণ জনপদের স্বপ্নের পদ্মা সেতু আগামী ২৫ জুন উদ্বোধনের দিনটিকে স্মরণীয় করে রাখতে চায় ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ। এদিন সকাল ১০টায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আনুষ্ঠানিকভাবে সেতু উদ্বোধন করবেন। উদ্বোধনী অনুষ্ঠান উপলক্ষে সেতুর দুই পাড়ে ২৯ জেলার কমপক্ষে ১০ লাখ মানুষের সমাগম ঘটানো হবে। ঢাকা উত্তর-দক্ষিণ, ঢাকা জেলা, বিভিন্ন উপজেলা আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকেও বিপুলসংখ্যক নেতাকর্মী সেখানে বাস-ট্রাকে গিয়ে যোগ দেবেন। ইতোমধ্যে সে প্রস্তুতিও চলছে। এছাড়া দেশের ৬৪ জেলায় উদ্বোধনী অনুষ্ঠান বড় পর্দায় সরাসরি সম্প্রচার করা হবে। সেতুর আলোকসজ্জার ঢেউ লাগবে রাজধানী ঢাকায়ও। হাতিরঝিলেও লেজারশো করার প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে।

* মাওয়া ও শরীয়তপুরের জাজিরায় হবে উদ্বোধনী অনুষ্ঠান

* কাঁঠালবাড়ীতে হবে জনসভা

* ৬৪ জেলায় উদ্বোধনী অনুষ্ঠান

* ঢাকা থেকে যোগ দেবেন দলের নেতাকর্মীরা

* সমাবেশে জমায়েত ১০ লাখ

* ঢাকা-মুন্সীগঞ্জ-মাদারীপুর-শরীয়তপুরসহ কয়েক জেলায় ২৫ জুন থেকে পাঁচ দিনব্যাপী অনুষ্ঠান

প্রাণঘাতী ভাইরাস করোনার সংক্রমণ শুরুর পর এখন পর্যন্ত দলীয় কোনো জনসভায় অংশ নেননি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এই প্রথম ঢাকার বাইরে সেতু উদ্বোধন উপলক্ষে কাঁঠালবাড়ীতে আয়োজিত দলীয় সমাবেশে ভাষণ দেবেন তিনি। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানসহ সমাবেশ বাংলাদেশ টেলিভিশন ও বেসরকারি টেলিভিশনগুলোয় সরাসরি সম্প্রচার করা হবে। ডিজিটাল প্রযুক্তিতেও বড় বড় পর্দায় বিভিন্ন জেলা ও উপজেলা শহরে অনুষ্ঠান সরাসরি দেখানোর ব্যবস্থা করা হয়েছে। সব মিলিয়ে পদ্মা সেতুতে উজ্জীবিত আওয়ামী লীগ। দলের নেতারা বলছেন, ২৫ জুন জাতির বহুল প্রত্যাশিত এ সেতুর উদ্বোধনের পরপরই এর সুফল মিলতে শুরু করবে।

অর্থনীতিবিদ ও বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ৬.১৫ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যরে পদ্মা সেতু দেশের ব্যষ্টিক ও সামষ্টিক অর্থনীতিতে বড় ধরনের ইতিবাচক পরিবর্তন বয়ে আনবে। দেশের সার্বিক জিডিপির পাশাপাশি পদ্মা বহুমুখী সেতু প্রকল্পের সফল বাস্তবায়নের ফলে অতিরিক্ত ১.২৩ শতাংশ জিডিপি বাড়বে।

শুধু দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জিডিপি বাড়বে ২.৩ শতাংশ। সেতুটি যোগাযোগের জন্য উন্মুক্ত হলে দেশের সমন্বিত যোগাযোগ ব্যবস্থার ব্যাপক উন্নতি হবে। এতে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ বাড়বে। পদ্মা সেতুর ইতিবাচক এসব প্রভাবকে আগামী নির্বাচনে কাজে লাগাতে ব্যাপক তৎপরতা শুরু করেছে আওয়ামী লীগ। প্রাথমিক পদক্ষেপ হিসেবে আগামী ২৫ জুন এ সেতুর উদ্বোধনকে ঘিরে দেশজুড়ে ব্যাপক আনন্দ-উৎসব আয়োজনের পরিকল্পনা চলছে। উদ্বোধনের দুদিন আগে ২৩ জুন দলের ৭৮তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী। পদ্মা সেতু ও প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর কর্মসূচির মধ্যে সমন্বয় করেই এ বর্ণাঢ্য অনুষ্ঠানমালার আয়োজন হবে।

এ লক্ষ্যে দলের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের কেন্দ্রীয় ও স্থানীয় নেতাদের অনুষ্ঠানমালা সফল করার সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চলছে। এদিকে পদ্মা সেতুতে পরীক্ষামূলক ল্যাম্পপোস্ট প্রজ¦লিত করা হয়েছে। গতকাল শনিবার বিকেল সাড়ে ৫টায় সেতুর ১২নং স্প্যানের ল্যাম্পপোস্টগুলো প্রজ¦ালন করা হয়। পদ্মা সেতুর নির্বাহী প্রকৌশলী দেওয়ান মো. আব্দুল কাদের বিষয়টি নিশ্চিত করেন। এটিই প্রথমবারের মতো সেতুর ল্যাম্পপোস্ট প্রজ¦ালন হলো।

জনসভা হবে কাঁঠালবাড়ীতে : ২৫ জুন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পদ্মা সেতুর আনুষ্ঠানিক উদ্বোধনের পর মাদারীপুরের শিবচরে পদ্মার দক্ষিণ পাড়ের কাঁঠালবাড়ীতে অনুষ্ঠেয় জনসভায় ১০ লক্ষাধিক লোকের সমাগম ঘটানোর প্রস্তুতি শুরু হয়েছে। গত বুধবার দলের উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনাও পদ্মা সেতুর উদ্বোধনের দিনটিকে স্মরণীয় করে রাখতে বর্ণাঢ্য আয়োজন বিষয়ে বিভিন্ন দিকনির্দেশনা দিয়েছেন। এর আগে-পরে দফায় দফায় বৈঠক করে সার্বিক প্রস্তুতি এগিয়ে রাখা হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী ওইদিন মাদারীপুরের শিবচর উপজেলার কাঁঠালবাড়ীতে জনসভায় অংশ নেবেন। এটি অবশ্য দলীয় সমাবেশ।

এর জন্য ইতোমধ্যে ঢাকা ও পদ্মার দুই পাড়ের জেলাগুলোর আওয়ামী লীগের নেতারা প্রস্তুতি শুরু করেছেন। সম্প্রতি বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে ঢাকা মহানগর উত্তর ও দক্ষিণ আওয়ামী লীগ এবং সব সহযোগী সংগঠনের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক এবং ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়রদের সঙ্গে কেন্দ্রীয় নেতারা যৌথসভা করেন।

বৈঠকে সভাপতিত্ব করেন দলের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহণ ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। বৈঠক সূত্র জানায়, মাদারীপুরের সমাবেশ সফল করার বিষয়ে বৈঠকে আলোচনা হয়েছে। এছাড়া বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়, ২৩ জুন আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে যেসব কর্মসূচি পালন করা হবে, এর সবকিছুতেই পদ্মা সেতুর উদ্বোধনের ছাপ থাকবে। পদ্মা সেতুর উদ্বোধনী অনুষ্ঠান সফল করতে আগামী বুধবার আওয়ামী লীগের ধানমন্ডি কার্যালয়ে দলটির কেন্দ্রীয় নেতারা বৈঠক করবেন। আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহণ ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের সাম্প্রতিক সভা-সমাবেশ ও বক্তব্য-বিবৃতিতে বলেছেন, অর্থনৈতিক উন্নয়ন-অগ্রগতি ও সফলতার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের সক্ষমতার প্রতীক পদ্মা সেতু।

সারা দেশে উদ্বোধনী অনুষ্ঠান সম্প্রচার : পদ্মা সেতু নিয়ে দেশের সব মানুষের আগ্রহের কোনো কমতি নেই। এ বিবেচনায় সারা দেশে উদ্বোধনী অনুষ্ঠান সম্প্রচার করার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। এদিন রাজধানীর হাতিরঝিলে লেজারশোয়ের আয়োজন করা হবে। ঐতিহাসিক দিনটি উদযাপন উপলক্ষে জেলায় জেলায় উৎসব করা হবে। আয়োজন করা হবে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের। এছাড়া ঢাকা, মুন্সীগঞ্জ, মাদারীপুর, শরীয়তপুরসহ কয়েকটি জেলায় এ উপলক্ষে ২৫ জুন থেকে পাঁচ দিনব্যাপী বিভিন্ন অনুষ্ঠান চলবে। এদিন ঢাকা জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে হাতিরঝিলে উদ্বোধনী অনুষ্ঠান দেখানোর পাশাপাশি লেজারশোয়ের আয়োজন করা হবে। সন্ধ্যায় থাকবে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। ২৯ জুন পর্যন্ত তাদের অনুষ্ঠান পালন করতে বলা হয়েছে। পরবর্তী দিনগুলোর অনুষ্ঠান হাতিরঝিল ছাড়াও সোহরাওয়ার্দী উদ্যান বা অন্য কোনো সুবিধাজনক জায়গায় হতে পারে।

মাওয়া প্রান্তে উদ্বোধন : সেতু বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, ২৫ জুন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মুন্সীগঞ্জের মাওয়া প্রান্ত থেকে সেতু উদ্বোধন করে সুধী সমাবেশে অংশ নেবেন। এরপর গাড়িতে চড়ে সেতু পার হয়ে শরীয়তপুরের জাজিরা প্রান্তে আরেকটি উদ্বোধনী ফলক উন্মোচন করবেন। সেতু এলাকায় নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে। গত সোমবার মন্ত্রিপরিষদের বৈঠক শেষে সংবাদ সম্মেলনে মন্ত্রিপরিষদ সচিব খোন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম বলেন, পদ্মা সেতুর উদ্বোধনী অনুষ্ঠান হবে খুবই জমকালো। মূল উদ্বোধনী অনুষ্ঠান ৬৪টি জেলায়ও দেখানোর ব্যবস্থা থাকবে। পদ্মা সেতুর উদ্বোধনী অনুষ্ঠান সফল করতে ১৮টি উপকমিটি গঠন করেছে সেতু বিভাগ। সবক’টি কমিটি প্রায় প্রতিদিনই বৈঠক করছে। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে ভিডিও প্রদর্শনী থাকবে।

অতিথিদের দেওয়া হবে উপহার-স্যুভেনির। অতিথিদের মাওয়া ও জাজিরা দুই পাড়েই আপ্যায়নের ব্যবস্থা করা হবে। এছাড়া করোনাকালে স্বাস্থ্য সুরক্ষা, প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা এবং ট্রাফিক ব্যবস্থাপনার জন্য দুই পাড়েই একাধিক কমিটি গঠন করা হয়েছে। পদ্মা সেতু দ্বিতলবিশিষ্ট। ওপর দিয়ে চলবে যানবাহন। ভেতর দিয়ে যাবে ট্রেন। ২৫ জুন যানবাহন চলাচল উদ্বোধন করা হবে। রেল চালু হবে ২০২৪ সালে। পদ্মা সেতুর (মূল সেতু) দৈর্ঘ্য ৬.১৫ কিলোমিটার। প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয়েছে ৩০ হাজার ১৯৩ কোটি টাকা। ২০১৪ সালের শেষদিকে মূল সেতু ও নদীশাসনের কাজ শুরু হয়। এর আগে সংযোগ সড়ক, টোলপ্লাজা নির্মাণসহ অন্যান্য কাজ শুরু হয় ২০১৩ সালের দিকে।

হেঁটে বা সাইকেল চালিয়ে পাড়ি দেওয়া যাবে না : সেতু উদ্বোধনের পরই যান চলাচলের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হবে। তবে দেশের সবচেয়ে বড় এ সেতুতে হেঁটে বা সাইকেল চালিয়ে পাড়ি দেওয়ার কোনো সুযোগ থাকছে না। এমনকি সিএনজিসহ তিন চাকার যানবাহন চলতে পারবে না পদ্মা সেতুতে। গতকার শনিবার বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষের প্রধান প্রকৌশলী (কারিগরি) কাজী মো. ফেরদাউস এ তথ্য নিশ্চিত করেন।

তিনি বলেন, সিএনজিসহ তিন চাকার কোনো যানবাহন পদ্মা সেতুতে চলাচল করতে পারবে না। প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী, সেতুতে ১৩ ধরনের যানবাহন চলাচল করতে পারবে। তবে নসিমন-করিমন, ভটভটি ও সিএনজি-অটোরিকশা চলাচল করতে পারবে না। এমনকি হেঁটেও মানুষ যাতায়াত করতে পারবেন না। প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী, পদ্মা সেতুতে মোটরসাইকেলে ১০০ টাকা, কার বা জিপে ৭৫০, পিকআপভ্যানে ১ হাজার ২০০, মাইক্রোবাসে ১ হাজার ৩০০, ছোট বাসে (৩১ আসন বা এর কম) ১ হাজার ৪০০, মাঝারি বাসে (৩২ আসন বা এর বেশি) ২ হাজার, বড় বাসে (৩ এক্সেল) ২ হাজার ৪০০ টোল টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে।

এছাড়া ছোট ট্রাকে (৫ টন পর্যন্ত) ১ হাজার ৬০০, মাঝারি ট্রাক (৫-৮ টন) ২ হাজার ১০০, মাঝারি ট্রাক (৮-১১ টন পর্যন্ত) ২ হাজার ৮০০, ট্রাক (৩ এক্সেল পর্যন্ত) ৫ হাজার ৫০০, ট্রেইলার (৪ এক্সেল পর্যন্ত) ৬ হাজার ও টেইলর (৪ এক্সেলের বেশি) ৬ হাজারের সঙ্গে প্রতি এক্সেলে ১ হাজার ৫০০ টাকা করে যোগ করে টোল দিতে হবে। তবে এর মধ্যে সাইকেলের কথা উল্লেখ নেই।