সীতাকুণ্ডের বিএম কনটেইনার ডিপো এখনো জ্বলছেই। দুই দিন পরও পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে আসেনি এই কনটেইনার ডিপোর আগুন। অগ্নিনির্বাপণে কাজ করে যাচ্ছেন ফায়ার সার্ভিসের সদস্যরা। তাদের সহযোগিতা করতে মাঠে রয়েছেন সেনাবাহিনীর সদস্যরাও। তবে ওই কনটেইনার ডিপোতে আরো চারটি কনটেইনারে কেমিকেল (হাইড্রোজেন পার অক্সাইড) রয়েছে। এ কারণে যে কোনো সময় আবার বিস্ফোরণের শঙ্কা রয়েছে।
# নিহতের সংখ্যা ‘সংশোধন’ করে ৪১ জন করল জেলা প্রশাসন
# গাফিলতির প্রমাণ পেলে চিহ্নিত করে ব্যবস্থা নেওয়ার ঘোষণা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর
গাফিলতির প্রমাণ পেলে দোষীদের চিহ্নিত করে ব্যবস্থা নেওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল। গতকাল সোমবার চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালে ওই অগ্নিকাণ্ডে আহতদের দেখতে এসে এই ঘোষণা দেন তিনি।
এদিকে বিএম কনটেইনার ডিপোতে অগ্নিকা-ে হতাহতের তথ্য সংশোধন করে নিহতের সংখ্যা ৪১ জনের কথা জানিয়েছে চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসন ও স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষ।
চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসক মো. মমিনুর রহমান গতকাল দুপুরে গণমাধ্যমকে বলেন, ‘কিছু মরদেহ চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতালের মর্গে নেওয়া হয়েছিল। সেখানে মরদেহ একবার গণনা করা হয়। ওই মরদেহগুলো চমেক হাসপাতালে নেওয়া হলে সেখানেও গণনা করা হয়। এতে সংখ্যা বেড়ে ৪৯ হয়েছিল।’ তিনি বলেন, ‘পরে সব মরদেহ চমেক হাসপাতালে নেওয়া হয়। সেখানে শুরু থেকে এখন পর্যন্ত ৪১ জনের মরদেহ পাওয়া গেছে। আগের দেওয়া তথ্যে ভুল ছিল, নিহতের প্রকৃত সংখ্যা ৪১ জন।’
প্রসঙ্গত, বিএম কনটেইনার ডিপোতে অগ্নিকাণ্ডে গতকাল নতুন কোনো মৃত্যুর খবর পাওয়া যায়নি। তবে চট্টগ্রাম পার্কভিউ হাসপাতালের আইসিইউতে চিকিৎসাধীন তিনজনের অবস্থা আশঙ্কাজনক। তাদের খুব শিগগির ঢাকায় স্থানান্তর করার পরামর্শ দিয়েছেন জাতীয় বার্ন বিশেষজ্ঞ ডা. সামন্ত লাল সেন।
বিএম কনটেইনার ডিপোর আগুন খুব শিগগিরই নিয়ন্ত্রণে আসবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করে চট্টগ্রাম বিভাগীয় ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্সের মোভিলাইজিং অফিসার মো. কফিল উদ্দিন বলেন, ডিপোর আগুন এখনো নেভেনি। তবে আশা করছি, আগুন খুব শিগগিরই নিয়ন্ত্রণে আসবে। আগুন নেভাতে আমাদের ফায়ার ফাইটাররা বিরামহীন চেষ্টা করে যাচ্ছেন। সহযোগিতা করতে মাঠে রয়েছেন সেনাবাহিনীর সদস্যরাও। জ্বলন্ত কনটেইনারগুলোর মধ্যে রাসায়নিক দ্রব্যেও কনটেননারেরও পাশে থাকতে পারে। এ কারণে সতর্কতার সঙ্গে আগুন নিয়ন্ত্রণে কাজ করে যাচ্ছেন ফায়ার ফাইটাররা।’ তিনি জানান, এর আগে বিস্ফোরণে পুরো এলাকায় রাসায়নিকের বিষাক্ত ধোঁয়া ছড়িয়ে পড়েছে। এসব কারণেই বেশি সাবধানতা অবলম্বন করা হচ্ছে।
সীতাকুণ্ডের এই বিএম কনটেইনার ডিপোর ভেতর আরো চারটি কনটেইনারে এখনো দাহ্য রাসায়নিক পদার্থ রয়েছে বলে জানিয়েছে সেনাবাহিনী। এখন চিহ্নিত চারটি কনটেইনার বিশেষ পদ্ধতিতে অপসারণের চেষ্টা চলছে বলে গতকাল এক ব্রিফিংয়ে এ তথ্য জানান সেনাবাহিনীর ২৪ পদাতিক ডিভিশনের ১৮ ব্রিগেডের অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল আরিফুল ইসলাম।
তিনি বলেন, ‘ডিপোতে থাকা চারটি কনটেইনারে রাসায়নিক পদার্থ থাকার বিষয়টি আমরা নিশ্চিত হয়েছি। এখন এই কনটেইনারগুলো বিশেষ পদ্ধতিতে অপসারণের চেষ্টা চলছে। এ কারণে ডিপোতে এখনো আগুন জ্বলছে, পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে আসেনি।’
এদিকে গাফিলতির প্রমাণ পেলে দোষীদের চিহ্নিত করে ব্যবস্থা নেওয়ার ঘোষণা দিয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেছেন, ‘সীতাকুণ্ডের বিস্ফোরণের ঘটনায় তদন্ত করে যদি কোনো ধরনের গাফিলতির প্রমাণ পাওয়া যায়, সে যতই শক্তিশালী হোক, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। গতকাল দুপুর চমেক হাসপাতালে দগ্ধ রোগীদের দেখতে এসে সাংবাদিকদের এসব কথা বলেন তিনি।
এ সময় মন্ত্রী আরো বলেন, ‘অবহেলা বা দায় থাকলে কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না। সে যতবড় শক্তিশালী হোক না কেন। কেউই আইনের ঊর্ধ্বে নয়।’ এর আগে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সীতাকুণ্ডের বিএম কনটেইনার ডিপো পরিদর্শন করেন। এ সময় সেনা, নৌবাহিনী ও ফায়ার সার্ভিসের কর্মকর্তাদের সঙ্গে ঘটনার বিষয়ে কথা বলেন তিনি।
গতকাল সীতাকুণ্ডের বিএম কনটেইনার ডিপো পরিদর্শনকালে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী ডা. মো. এনামুর রহমান এমপি বলেছেন, বিএম কনটেইনার ডিপোতে অগ্নিকা- ও বিস্ফোরণের আহতদের সম্পূর্ণ চিকিৎসার দায়িত্ব নিয়েছেন সরকার। যেখানে যত অর্থ লাগবে, বাহির থেকে যে ওষুধ ক্রয় করতে হচ্ছে, সেটাও ডিসি সাহেব দিচ্ছেন।’ তিনি বলেন, ‘আহতদের সর্বোচ্চ চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হচ্ছে। কোনো ধরনের ওষুধ ও খাবার সংকট নেই। চিকিৎসার জন্য যা কিছু প্রয়োজন, সবকিছু ব্যবস্থাও করা হবে।’
প্রতিমন্ত্রী আরো বলেন, ‘প্রতিটি দুর্ঘটনা থেকে আমরা শিক্ষা গ্রহণ করি। হয়তো শতভাগ আমরা সংশোধন হতে পারি না। প্রতিদিন দুর্যোগ মোকাবিলা ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বাড়ছে। তদন্ত রিপোর্ট পেলে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।’
নৌ পরিবহণ প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী বলেছেন, ‘কেউ এই ঘটনার জন্য দায়ী কিনা, তা তদন্ত শেষ না হলে বলা যাবে না। তবে তদন্ত
রিপোর্ট বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে জিরো টলারেন্স।’ গতকাল বিএম ডিপো পরিদর্শনে এসে সাংবাদিকদের সঙ্গে ব্রিফিংকালে এই মন্তব্য করেন তিনি। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, তদন্ত কমিটি করা হয়েছে। প্রতিবেদন আসার আগে কিছু বলা যাবে না। তবে এ ধরনের ঘটনা আমাদের বড় ক্ষতি হয়েছে। বিশেষ করে এটি আমাদের দেশের ভাবমূর্তির ওপর ধাক্কা। আমরা আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে যে বাণিজ্য করি, তা অনেক প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। কাজেই আমরা এই ব্যাপারে জিরো টলারেন্স। তদন্ত করে যেটা বেরিয়ে আসবে, আমরা সেই অনুযায়ী ব্যবস্থা নেব।’
সীতাকুণ্ডের বিএম কনটেইনার ডিপোতে ভয়াবহ বিস্ফোরণে হতাহতের ঘটনায় বিচার বিভাগীয় তদন্ত দাবি করেছেন চট্টগ্রাম মহানগর বিএনপির আহ্বায়ক ডা. শাহাদাত হোসেন।
গতকাল দুপুরে সীতাকুণ্ডের বিএম কনটেইনার ডিপোর ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা পরিদর্শন শেষে তিনি এ দাবি জানান। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘ক্ষতিগ্রস্ত কনটেইনার ডিপোর আশপাশের এলাকার বাতাসে এখনো লাশের গন্ধ। এখানে পরিবেশ দূষণ হচ্ছে। এলাকার মানুষ অসহায়ভাবে দিন যাপন করছে। এর আগে পুরান ঢাকায়ও কেমিকেল ফ্যাক্টরিতে আগুন লেগে মানুষ হতাহত হয়েছিল। বিএম ডিপোতে হাইড্রোজেন পার অক্সাইড, অক্সিজেন ও সালফার ছিল। এখন আমাদের আশঙ্কা, এই সালফারের সঙ্গে মিশ্রণ হয়ে যদি এসিড বৃষ্টি হয়, তাহলে ‘মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা’ হবে।’