logo
আপডেট : ৭ জুন, ২০২২ ১২:৩৭
মৃত্যুঝুঁকি নিয়েও সিলেটে পাহাড়-টিলায় বাড়ছে বসতি
পাহাড় ধসে একই পরিবারের চারজন নিহত
কামরুল ইসলাম মাহি, সিলেট

মৃত্যুঝুঁকি নিয়েও সিলেটে পাহাড়-টিলায় বাড়ছে বসতি

সিলেটে পাহাড়-টিলায় বাড়ছে বসতি (ছবি: সংগৃহীত)

সিলেটের পাহাড়-টিলা সংশ্লিষ্ট এলাকায় ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় মানুষের বসবাস বাড়ছে। কয়েক বছর আগেও যেখানে মানুষের আনাগোনা ছিল না, সেসব এলাকায় এখান বসতি গড়ে উঠেছে। টিলায় ঝুঁকিপূর্ণ এ বসবাস হয়ে উঠছে বড় ধরনের দুর্ঘটনার কারণ। গত কয়েকদিন থেকে লাগাতার বৃষ্টিপাতে সিলেটে পাহাড় ও টিলা ধসের ঘটনা বেড়েছে। ঘটছে প্রাণহানিও। এতে পাহাড়-টিলাকে কেন্দ্র করে ঝুঁকিপূর্ণ বসবাসকারীদের মধ্যে বাড়ছে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা। সর্বশেষ গতকাল সোমবার সকালে সিলেটের জৈন্তাপুর উপজেলার চিকনাগুল ইউনিয়নের সাতজমি এলাকায় টিলা ধসে একই পরিবারের চারজন নিহত হয়েছেন।

স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান কামরুজ্জামান চৌধুরী জানান, অতিরক্ত বৃষ্টিতে সাতজমি এলাকার একটি টিলা ধসে ঘরের ওপর পরে। এতে একই পরিবারের চার সদস্য মারা যান। এর আগে গত ১৪ মে গোলাপগঞ্জের লক্ষণাবন্দ ইউনিয়নের চক্রবর্তী গ্রামে টিলা ধসে মাটিচাপায় ঘুমের মধ্যে মারা যান অপু পাল নামে এক এনজিওকর্মী। পরিবেশবিদদের অভিযোগ, ঝুঁকিপূর্ণ এ বসবাসকারীদের সরিয়ে নিতে প্রশাসনের নেই কোনো স্থায়ী উদ্যোগ। শুধু অভিযান অভিযান খেলায় পড়ে রয়েছে প্রশাসন। প্রতি বছর বৃষ্টির আগে শুধু প্রশাসনের পক্ষ থেকে ঝুঁকিপূর্ণভাবে বসবাসকারীদের উচ্ছেদাভিযান চালানো হয়।

তবে স্থায়ী পুনর্বাসনের ব্যবস্থা না থাকায় লোকদেখানো অভিযানের পরপরই পাহাড়ে আবার ফিরে যান বসবাসকারীরা। সিলেট নগরী ও সদর উপজেলাসহ জেলার গোলাপগঞ্জ, ফেঞ্চুগঞ্জ, জৈন্তাপুর ও গোয়াইনঘাট উপজেলায় প্রায় ৪০০ পাহাড়-টিলা রয়েছে। যদিও এ-সংক্রান্ত কোনো পরিসংখ্যান জেলা প্রশাসনের কাছে নেই। কয়েক বছর আগে বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতি (বেলা) সিলেট নগরী ও বিভিন্ন উপজেলায় টিলার একটি পরিসংখ্যান প্রকাশ করে।

বেলার দায়িত্বশীলরা জানান, নগরী ও সিলেট সদর উপজেলায় ২০০ টিলা রয়েছে। বিভিন্ন উপজেলায় আরো ২০০-এর বেশি টিলা আছে। এসব টিলার মধ্যে অনেক টিলাই সম্পূর্ণ এবং অধিকাংশ টিলা অর্ধেক ও আংশিকভাবে কেটে ফেলা হয়েছে। টিলা কেটে ফেলায় ও কাটা অব্যাহত থাকায় দিন দিন ঝুঁকি বাড়ছে। বিভিন্ন মাধ্যমের তথ্যমতে, সিলেট নগরী ও উপকণ্ঠের ব্রাহ্মণশাসন টিলা, মজুমদার টিলা, মুক্তিযোদ্ধা টিলা, জাহাঙ্গীরনগর টিলাসহ আশপাশের দুসকি, নালিয়া, ভাটা, তারাপুর চা-বাগান, বালুচর, শাহপরান ও খাদিমপাড়া এলাকায় ২০০-এর মতো টিলা রয়েছে।

এসব টিলায় কম হলেও ৮-৯ হাজার লোক বসবাস করছেন। চূড়াসহ টিলার বিভিন্ন স্থানে বিচ্ছিন্নভাবে গত ১৫-২০ বছর ধরে লোকজন সেখানে বাস করে আসছেন। দিন দিন তাদের সংখ্যা বাড়ছেই। জাহাঙ্গীরনগর টিলা গিয়ে দেখা যায়, টিলাটি প্রায় ৬০ থেকে ৭০ ফুট উঁচু। সেখানে বসবাসকারীদের অধিকাংশই স্বল্পআয়ের মানুষ। কেউবা টিলার জায়গা কিনে আবার কেউ ভাড়া হিসেবে বসবাস করছেন।

এ টিলার ওপর বসবাসকারী সুনামগঞ্জের একজন বাসিন্দা নামপরিচয় গোপন রেখে জানান, তিনি সেখানে ২০ হাজার টাকায় জায়গা কিনে ১০ বছর ধরে বাস করছেন। টিলার মালিক কে, তা জানাতে তিনি অপারগতা প্রকাশ করেন। বাংলাদেশ পল্লী ফোরামের চেয়ারম্যান চৌধুরী আলী আনহার শাহান বলেন, ‘টিলা বা পাহাড় ইজারা ও বিক্রির কোনো বিধান নেই। স্থানীয় প্রভাবশালীরা অনেক টিলার মালিকানা ও দখল দাবি করে মাটি বিক্রি; এমনকি জায়গাও বিক্রি করে আসছেন। টিলাকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা ওইসব বাড়ির মধ্যে অধিকাংশই কাঁচা ও খুপড়ি ঘর। মাঝেমধ্যে আধাপাকা বাড়িও রয়েছে সিলেটে।

নগরী ও উপকণ্ঠ ছাড়াও গোলাপগঞ্জ, জৈন্তাপুর ও গোয়াইনঘাট উপজেলায় ২ হাজারের মতো পরিবার ঝুঁকি নিয়েই বসবাস করছে। এর মধ্যে গোলাপগঞ্জের ধারাবহর, শিলঘাট, নালিউড়ী, খানিশাইল, ফুলশাইন ও চক্রবর্তীপাড়ার টিলায় প্রায় ১০০ পরিবার বাস করছে।

সিলেট সদরের খাদিমপাড়া ইউপি চেয়ারম্যান আফছর আহমদ বলেন, ‘প্রতি বছরই ঝুঁকি নিয়ে বসবাসকারীদের নিরাপদে সরে যাওয়ার জন্য বলা হয়। অনেক সময় মাইকিংও করা হয়। কিন্তু কেউ টিলা ছাড়তে চায় না।’ পরিবেশ অধিদপ্তর সিলেট বিভাগের পরিচালক মোহাম্মদ এমরান হোসেন বলেন, ‘ঝুঁকি নিয়ে টিলা বা টিলার পাদদেশে বসবাসের বিষয়টি জেলা ও উপজেলা প্রশাসন দেখে। আমরা প্রতি বছরই টিলা কাটার বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করি।’

সিলেটের জেলা প্রশাসক মো. মজিবর রহমান বলেন, ‘যারা ঝুঁকিপূর্ণভাবে টিলা বা টিলার পাদদেশে বসবাস করছেন, তাদের সতর্ক থাকতে বলা হয়েছে। এজন্য মাইকিং করা হচ্ছে। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাদেরও সে বিষয়ে বলা হয়েছে। ঝুঁকিপূর্ণ টিলাগুলো পরিদর্শন করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’