logo
আপডেট : ৮ জুন, ২০২২ ১০:৫২
বিভিন্ন সময় অগ্নিকাণ্ড
আলোর মুখ দেখে না তদন্ত প্রতিবেদন
এমদাদুল হক খান


আলোর মুখ দেখে না তদন্ত প্রতিবেদন

ফাইল ছবি

রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে প্রতিনিয়ত ঘটছে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা। আগুনে পুড়ে কয়লা হচ্ছে মানুষ। আগুনের লেলিহান শিখায় সারাজীবনের শেষ সম্বলটুকু পুড়ে ছাই হওয়ায় পথের ভিখারিও হয়ে যাচ্ছেন কেউ কেউ। প্রতিটি আগুনের ঘটনার পর পরই গঠন করা হয় তদন্ত কমিটি। বিশেষ করে বড় ধরনের অগ্নিকাণ্ড ঘটার পর সাধারণ মানুষের কাছে একটি কৌতূহল জাগে যে, বিষয়টি কি দুর্ঘটনা, নাকি নাশকতা। এসব ঘটনায় তদন্ত কমিটি হয়, কিন্তু তদন্তের যে রিপোর্ট তা কখনো জনসম্মুখে প্রকাশ পায় না। এ ধরনের ঘটনায় নাশকতা প্রমাণিত হয়ে বিচারিক আদালতে শাস্তির দৃষ্টান্তও মানুষ দেখতে পায় না।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় গঠিত তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন প্রকাশ আর যথাযথ ব্যবস্থা নিলে এ ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি নাও হতে পারত।

স্মরণকালে দেশের সবচেয়ে বড় অগ্নিকাণ্ডের ঘটনাটি ঘটে ২০১০ সালের ৩ জুন পুরান ঢাকার নবাব কাটারার নিমতলীতে। ভয়াবহ ওই অগ্নিকাণ্ডে নিহত হয় ১২৪ জন। দগ্ধ হয় দুই শতাধিক লোক। ওই ঘটনায় দায়ীদের শনাক্ত করতে একাধিক তদন্ত কমিটি গঠিত হলেও তারা কাউকে দোষী করতে পারেনি। শনাক্তই করা যায়নি, ওই অগ্নিকাণ্ডে প্রাণহানির জন্য দায়ী কারা। তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে অগ্নিকা-ের ঘটনাটিকে নেহায়েত দুর্ঘটনা হিসেবে উল্লেখ করে দায় এড়ানো হয়েছে। দুর্ঘটনা কাদের অবহেলায় ঘটেছে তাও উল্লেখ করা হয়নি।

এই অগ্নিকাণ্ডে ঘটনার এক যুগ পার হলেও কোনো নিয়মিত মামলা রুজু হয়নি। শুধু তাই নয়, দুর্ঘটনার পর বংশাল থানায় একটি সাধারণ ডায়রি হয়েছিল। তার তদন্তও হয়নি গত এক বছরে।

২০১২ সালের ২৪ নভেম্বর আশুলিয়ার নিশ্চিন্তপুরে তাজরীন ফ্যাশনসে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। ভয়াবহ ওই অগ্নিকাণ্ডে ১১৯ জন শ্রমিক পুড়ে মারা যায়। ওই ঘটনার পর আশুলিয়া থানা পুলিশ শ্রমিক নিহত হওয়ার জন্য দায়িত্বে অবহেলাকে দায়ী করে থানায় তাজরীন ফ্যাশনসের মালিকসহ ১৩ জনের বিরুদ্ধে মামলা করে। ২০১৩ সালের ২ ডিসেম্বর মামলার চার্জশিট দেওয়া হয়। এরপর ঢাকার জেলা ও দায়রা জজ আদালতে মামলাটি বিচারের জন্য স্থানান্তর হয়। ২০১৫ সালের ৩ সেপ্টেম্বর আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করা হয়। এই মামলা কবে শেষ হবে তা অনিশ্চিত। কেবল তাজরীন ফ্যাশনস নয়, মর্মান্তিক এমন ঘটনার নজির দেশে অনেক।

২০০৭ সালে বাংলাদেশ ইস্পাত ও প্রকৌশল কর্পোরেশন বিএসইসি ভবনে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় তদন্ত কমিটি গঠন করা হলেও আজ পর্যন্ত প্রকাশ করা হয়নি সেই তদন্ত প্রতিবেদন।

এ বিষয়ে স্থপতি ইকবাল হাবিব বলেন, ২০০৭ সালের রিপোর্ট অনুযায়ী এর যে রেট্রোফিকেশন হওয়ার কথা ছিল, সেটি আমরা হতে দেখিনি। এ সময় তিনি আরো বলেন, প্রতিটি ভবনে যাতে অগ্নি নির্বাপণ ব্যবস্থা থাকে সেগুলো নিশ্চিত করতে সরকারকে বাধ্য করতে হবে।

বুয়েটের স্থাপত্য বিভাগের অধ্যাপক ড. মাকসুদ হেলালি বলেন, যখন এগুলো সার্টিফিকেট পায় তখন এগুলো চেক করা উচিত, কিন্তু সেটি হয় না। তিনি আরো বলেন, বিশেষ করে ঢাকায় যে বহুতল ভবনগুলো নির্মিত হয়েছে সেগুলোতে পর্যাপ্ত পরিমাণ অগ্নি নির্বাপণ ব্যবস্থা থাকে না।

বুয়েট থেকে প্রকাশিত এক গবেষণা থেকে জানা যায়, রাজধানীতে গড়ে ওঠা অধিকাংশ বহুতল ভবন নির্মাণে মানা হয় না ভবন নির্মাণ আইন বা বিল্ডিং কোড। এ ছাড়া, এসব ভবনে রাখা হয়নি পর্যাপ্ত অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা। তবে, বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এসব দুর্ঘটনা রোধে সাধারণ মানুষের সচেতনতার পাশাপাশি ভবন নির্মাণের সাথে সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর সমন্বয় প্রয়োজন।

দেশে বিভিন্ন সময় সংঘটিত অগ্নিকাণ্ডের ঘটনাগুলো পর্যালোচনা করে দেখো গেছে, এসব জান-মাল হারালেও চিহ্নিত দায়ীরা থেকে যান ধরাছোঁয়ার বাইরে। অগ্নিকা-ের ঘটনা এবং এসব ঘটনায় হতাহতদের সুনির্দিষ্ট রেকর্ড পাওয়া না গেলেও সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, গত দুই দশকে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় দুই হাজারেরও বেশি মানুষ প্রাণ হারিয়েছে। এসব ঘটনায় দায়ীদের বিরুদ্ধে মামলা হলেও খুব সহজেই তারা জামিনে মুক্তি পান। এরপর ঘটনার সাক্ষ্য-প্রমাণের অভাবে ওই মামলা বছরের পর বছর ঝুলন্ত অবস্থায় রয়ে যায়।

ফায়ার সার্ভিস বলছে, গত ১২ বছরে বড় অগ্নিকা-ের ঘটনাটি ঘটেছিল ২০১০ সালে, পুরান ঢাকার নিমতলীতে। এতে ১২৪ জন নিহত হন। এর পরের বছর সাভারের আশুলিয়ায় তাজরীন ফ্যাশনসের অগ্নিকা-ে প্রাণ হারান ১১১ জন। আর ২০১৬ সালে টঙ্গীর টাম্পাকো ফয়েলস কারখানার অগ্নিকাণ্ডে মারা যান ৪১ জন।

পরিসংখ্যান থেকে দেখা গেছে, দেশের আট বিভাগের মধ্যে ঢাকায় সবচেয়ে বেশি অগ্নিকা- ঘটে। আর সবচেয়ে কম অগ্নিকা- হয় সিলেট বিভাগে। এ ছাড়া ময়মনসিংহ বিভাগেও অগ্নিকাণ্ডের সংখ্যা সিলেটের চেয়ে বেশি।

ফায়ার সার্ভিসের তথ্য মতে, গত দশ বছরে প্রায় ১ লাখ ৬৮ হাজারের বেশি অগ্নিকা-ের ঘটনা ঘটেছে। এর প্রায় সবই সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের দায়িত্ব পালনে অবহেলাজনিত কারণে হয়েছে। যার সূত্রপাত হয়েছিল অনিরাপদ ও অবৈধ গোডাউনে কেমিক্যাল মজুতের কারণে। বেশিরভাগ ব্যবসায়ী শুধু ট্রেড লাইসেন্স নিয়েই কেমিক্যাল ব্যবসা করছেন। তারা কেমিক্যাল মজুত, পরিবহণ ও বিক্রির ক্ষেত্রে আইনের বাধ্যবাধকতা মানছেন না।

ফায়ার সার্ভিসের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. মাইন উদ্দিন বলেন, অগ্নিপ্রতিরোধের ব্যবস্থা রাখা বিনিয়োগ হিসেবে দেখতে হবে। কারণ অগ্নিকাণ্ডে জীবন ও সম্পদের অনেক ক্ষতি হয়। অনেকেই মনে করেন, আগুন লাগলে দেখা যাবে, এজন্য প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নেন না। এই মানসিকতা থেকে বের হয়ে আসতে হবে। সব ক্ষেত্রেই নিজস্ব প্রতিরোধ ব্যবস্থা থাকতে হবে। যাতে অগ্নিকাণ্ডের সময় অন্তত ১০-১৫ মিনিট প্রতিরোধ করা যায়। আর সঙ্গে সঙ্গে ফায়ার সার্ভিসকে খবর দিতে হবে। ফায়ার স্টেশনের সংখ্যা আরো বাড়ানোর পক্ষেও মত দেন তিনি।

কেন এত দুর্ঘটনার শিকার ঢাকা? জানতে চাইলে ফায়ার সার্ভিস মহাপরিচালক বলেন, ঢাকার ডেনসিটি বেশি। অল্প জায়গায় বেশি মানুষ বসবাস করে। অনেক অপরিকল্পিত ও অবৈধ বৈদ্যুতিক সংযোগ রয়েছে। নতুন নতুন ইলেকট্রিক গ্যাজেট, ল্যাপটপ, মোবাইল চার্জারসহ অন্যান্য দাহ্য পদার্থের প্রাপ্যতা বেশি। তাই ঢাকায় অগ্নিকাণ্ডসহ অন্যান্য দুর্ঘটনার সংখ্যা বেশি। গত বছর দেশে যত অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে তার কারণ সম্পর্কে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তর একটি পরিসংখ্যান দিয়েছে। তাদের তথ্য বলছে, গত বছর দেশে আগুন লাগার ঘটনা ঘটেছে ১৮ হাজারের কিছু বেশি।

ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপস বলেন, পুরান ঢাকার যেসব কেমিক্যাল গোডাউন রয়েছে, ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী তা স্থানান্তরিত হচ্ছে। ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের ভ্রাম্যমাণ আদালত এই স্থানান্তর কাজ পরিচালনা করছে। একই সঙ্গে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ এবং র‌্যাব সার্বিক কার্যক্রমে সহায়তা প্রদান করছে বলে জানান তিনি।

মেয়র তাপস বলেন, ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের সীমাবদ্ধতা রয়েছে। ঢাকা শহরের বর্তমান জনসংখ্যা অনুযায়ী ফায়ার সার্ভিসের জনবল থাকার কথা ন্যূনতম ১০ হাজার। কিন্তু আছে মাত্র ৫০০ জন। অপরদিকে ফায়ার স্টেশন থাকার কথা ৫০টি কিন্তু আছে মাত্র ১২টি। বিভিন্ন পরিসংখ্যান তুলে ধরে ফায়ার সার্ভিসের জনবল এবং সক্ষমতা বৃদ্ধির ওপর জোর দেন তিনি।

তিনি আরো বলেন, অধিকাংশ অগ্নি দুর্ঘটনার প্রধান কারণ হলো ইলেকট্রিক্যাল সমস্যা। তাই মানসম্মত বৈদ্যুতিক তার ও ফিটিংস ব্যবহার করা প্রয়োজন। অভিজ্ঞ ইঞ্জিনিয়ার দ্বারা নিয়মিত ভবনের বৈদ্যুতিক ব্যবস্থাও পরীক্ষা করা প্রয়োজন। এ বিষয়ে জনসচেতনতার জন্য গণমাধ্যমকে এগিয়ে আসার আহ্বান জানান মেয়র তাপস।