logo
আপডেট : ১১ জুন, ২০২২ ১৮:৫৭
৩৮ সেবা নিতে রিটার্ন জমা দিতে হবে
অর্থনৈতিক প্রতিবেদক

৩৮ সেবা নিতে রিটার্ন জমা দিতে হবে

প্রতীকী ছবি

রাজধানীর ধানমণ্ডির বাসিন্দা শাহনাজ পারভীন সম্প্রতি জমি বিক্রি করে আট লাখ টাকা পেয়েছেন। নিরাপদ বিনিয়োগ হিসাবে সঞ্চয়পত্র কেনার কথা ভাবছিলেন।

কিন্তু এখন জানতে পেরেছেন, তাকে সঞ্চয়পত্র কিনতে হলে আয়কর রিটার্ন স্লিপ দিতে হবে, যদিও তার নির্দিষ্ট কোনো আয় নেই।

নতুন অর্থবছরের জন্য প্রস্তাবিত বাজেটে এমন ৩৮ ধরনের সেবা নিতে হলে রিটার্ন জমা দেয়ার প্রমাণ বাধ্যতামূলক করার প্রস্তাব করা হয়েছে।

এতোদিন এসব সেবা নিতে গেলে টিআইএন সার্টিফিকেটের কপি জমা দিতে হতো। কিন্তু এখন তাদের রিটার্ন জমার প্রমাণপত্র জমা দিতে হবে।

জাতীয় সংসদে দেয়া বাজেট বক্তৃতায় অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বলেছেন, করদাতার সংখ্যা এবং করের পরিমাণ বাড়াতে কিছু সেবা পাওয়ার জন্য আয়কর রিটার্ন দাখিলের প্রমাণ উপস্থাপন বাধ্যতামূলক করা হয়েছে।

যে প্রতিষ্ঠান থেকে সেবা নেয়া হবে, সেখানেই এসব প্রমাণ দেখাতে হবে। কোনো প্রতিষ্ঠান যদি সেবাগ্রহীতার কাছ থেকে এসব প্রমাণ সংগ্রহ করে না রাখে, তাহলে সেসব প্রতিষ্ঠানকে ১০ লাখ টাকা পর্যন্ত জরিমানার প্রস্তাব করা হয়েছে।

প্রমাণ হিসেবে আয়কর রিটার্নের প্রাপ্তিস্বীকার পত্র অথবা করদাতার নাম, টিআইএন ও কর বছর উল্লেখ করে অনলাইনের এনবিআরের সনদ অথবা উপ-কর কমিশনারের সদন গ্রহণযোগ্য হবে।

জরিমানা ছাড়াই পুরনো অর্থবছরের রিটার্ন জমার সুযোগ রাখা হয়েছে বাজেট প্রস্তাবে।

শাহনাজ পারভীন বলছেন, ‘আমার নিয়মিত কোন আয় নেই। ব্যাংকের কিছু জমা টাকা থেকে মাসে মাসে যে টাকা পাই, তাতে ইনকাম ট্যাক্স হয় না।

যদিও সঞ্চয়পত্র কেনার জন্য টিআইএন খুলতে হয়েছে। কিন্তু এবার শুনছি, নতুন নিয়মের কারণে এ বছর থেকে আমাকেও রিটার্ন জমা দিতে হবে।’

বাংলাদেশের জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) তথ্য অনুযায়ী, দেশে মোট টিআইএন রয়েছে ৭৫ লাখের বেশি, কিন্তু নিয়মিত রিটার্ন জমা দেন ২৫ লাখ মানুষ।

বাকিদের টিআইএন থাকলেও তারা নিয়মিত রিটার্ন জমা দেন না। যদিও ২০১৯ সাল থেকেই প্রত্যেক টিআইএনধারীর জন্য রিটার্ন জমা দেয়া বাধ্যতামূলক করেছে সরকার।

কর না দিলে এবার গ্যাস, বিদ্যুৎ, পানির মতো সেবা বন্ধের প্রস্তাব করেছেন অর্থমন্ত্রী।

যেসব সেবা পেতে আয়কর রিটার্নের প্রমাণ দেখাতে হবে

সঞ্চয়পত্র ক্রয়: পাঁচ লাখ টাকার বেশি সঞ্চয়পত্র বা পোস্টাল সেভিংস কিনতে হলে আয়কর জমার প্রমাণ দেখাতে হবে। যেখানে তিনি সঞ্চয়পত্র কেনার আবেদন করবেন, সেখানেই প্রমাণ জমা দিতে হবে।
ব্যাংক ঋণ: কোন ব্যাংক থেকে পাঁচ লাখ টাকার বেশি ঋণ নেয়ার আবেদন করলে আয়কর রিটার্নের প্রমাণপত্র দিতে হবে।

ব্যাংকে জমা: ব্যাংক জমার সুদ আয় থেকে উৎস কর কর্তনে টিআইএন সনদ থাকলে ১০ শতাংশ কাটা হয়ে থাকে। না থাকলে ১৫ শতাংশ কাটা হয়। এখন থেকে টিআইএনের পরিবর্ততে রিটার্ন জমার প্রমাণপত্র জমা দিতে হবে। তাহলেই তিনি ওই সুবিধা পাবেন। না হলে বেশি উৎস কর দিতে হবে।

জমি-ফ্ল্যাট ক্রয়: সিটি কর্পোরেশন, জেলা সদরের পৌর এলাকা অথবা ক্যান্টনমেন্ট এলাকায় ১০ লাখ টাকা বেশি মূল্যের জমি বা ফ্ল্যাট রেজিস্ট্রি, বিক্রি, দলিল হস্তান্তর, পাওয়ার অব অ্যাটর্নি দিতে হলে এতদিন শুধুমাত্র টিআইএন সার্টিফিকেট জমা দিতে হতো। কিন্তু এখন থেকে ক্রেতাকে রেজিস্ট্রি অফিসে রিটার্ন জমার স্লিপ বা সনদ জমা দিতে হবে।

ক্রেডিট কার্ড গ্রহণ: যেকোনো ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে ক্রেডিট কার্ড নিতে হলে এখন থেকে আয়কর রিটার্নের প্রাপ্তিস্বীকার পত্র জমা দিতে হবে। না হলে মিলবে না ক্রেডিট কার্ড।

গাড়ি ক্রয়, মালিকানা পরিবর্তন: দুই বা তিন চাকা ছাড়া যেকোনো মোটরগাড়ি নিবন্ধন, মালিকানা পরিবর্তন বা ফিটনেস নবায়ন করতে রিটার্ন জমা স্লিপ দেখাতে হবে। আগে শুধুমাত্র টিআইএন দিতে হতো, কিন্তু এখন থেকে রিটার্ন দাখিলের কপি দিতে হবে।

ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে পড়ানো: সিটি কর্পোরেশন বা জেলা সদর, পৌরসভায় সন্তান বা পোষ্যদের আন্তর্জাতিক পাঠ্যক্রমের আওতায় ইংরেজি মিডিয়াম স্কুল বা জাতীয় পাঠ্যক্রমের আওতায় ইংরেজি ভার্সনে ভর্তি করাতে হলে আয়কর রিটার্ন জমার স্লিপ বা সনদ জমা দিতে হবে।

গ্যাসের সংযোগ: দেশের যেকোনো স্থানে বাণিজ্যিক বা শিল্প কারখানায় গ্যাসের সংযোগ নিতে হলে এবং সিটি কর্পোরেশন এলাকায় বাসা বাড়ির গ্যাসের সংযোগ নিতে বা আগের সংযোগ বজায় রাখতে হলে রিটার্ন জমার স্লিপ বা সনদ লাগবে।

বিদ্যুৎ সংযোগ: সিটি কর্পোরেশন বা সেনানিবাস এলাকায় নতুন বিদ্যুৎ সংযোগ নিতে হলে রিটার্নের প্রাপ্তিস্বীকার পত্র জমা দিতে হবে। গ্রাম বা সিটি কর্পোরেশন এলাকার বাইরে অবশ্য এই নিয়ম বাধ্যতামূলক করা হয়নি।

বাড়িভাড়া: জমি বা বাড়ি ভাড়া দিয়ে অনেকে আয় করে থাকেন। আয় যাই হোক না কেন, এই ধরনের আয়ের ক্ষেত্রে আয়কর রিটার্ন বাধ্যতামূলক করা হয়েছে।

সরকারি আয়: সরকার বা সরকারি কোনো সংস্থা, কর্পোরেশন থেকে বেতন হিসাবে মূল বেতন ১৬ হাজার টাকা বা বেশি হলেই আয়কর রিটার্ন জমা দেয়ার প্রমাণপত্র জমা দিতে হবে।

বেসরকারি বেতন: বেসরকারি প্রতিষ্ঠান থেকে বেতন নেয়ার সময় বার্ষিক আয়কর রিটার্ন প্রমাণপত্র জমা দিতে হবে।

এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের আয়: শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সরকারি অংশ বা এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের আয় মাসে ১৬ হাজার টাকার বেশি হলেই আয়কর রিটার্ন জমা দিতে হবে।

নকশার অনুমোদন: ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনা, রাজশাহী শহরে ভবন নির্মাণের অনুমোদন চাইলে আবেদনপত্রের সঙ্গে রিটার্ন জমার প্রমাণপত্র দিতে হবে।

জনপ্রতিনিধি: জাতীয় সংসদ, সিটি কর্পোরেশন, জেলা পরিষদ, পৌরসভা, উপজেলায় কোনো নির্বাচনে প্রার্থী হতে হলে আবেদনপত্রের সঙ্গে আয়কর রিটার্ন জমা দেয়া বাধ্যতামূলক করা হয়েছে।

ফান্ডের রিটার্ন: পেনশন ফান্ড, অনুমোদিত গ্র্যাচুইটি ফান্ড, স্বীকৃত প্রভিডেন্ট ফান্ড, অনুমোদিত সুপারএন্যুয়েশন ফান্ড এবং শ্রমিক অংশগ্রহণ তহবিল ছাড়া অন্যান্য ফান্ডের রিটার্ন দাখিলের প্রস্তাব করা হয়েছে।
ট্রেড লাইসেন্স: সিটি কর্পোরেশন বা পৌর এলাকায় ট্রেড লাইসেন্স প্রাপ্তি ও নবায়ন করতে হলে আয়কর রিটার্ন দাখিল করতে হবে। তবে এর বাইরের অন্যান্য এলাকায় এই নিয়ম প্রস্তাব করা হয়নি।

ডিজিটাল পণ্য ও সেবা: ডিজিটাল প্লাটফর্মে কোনো পণ্য বা সেবা বিক্রি করতে হলে আয়কর রিটার্ন দাখিলের প্রমাণপত্র থাকতে হবে।

মোবাইল ব্যাংকিং: মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে অথবা ইলেকট্রনিক উপায়ে অর্থ হস্তান্তরে কমিশন, ফি জাতীয় অর্থ পেতে হলে রিটার্ন দাখিল করতে হবে।

সমবায় সমিতি: সোসাইটি রেজিস্ট্রেশন অ্যাক্টের আওতায় কোন সমিতি বা ক্লাব গঠিত হলে বা এ ধরণের ক্লাবের সদস্য হলে আয়কর রিটার্ন জমা দিতে হবে।

এছাড়া আরো যেসব সেবা পেতে রিটার্ন দাখিলের প্রমাণপত্র বাধ্যতামূলক করা হয়েছে, সেগুলো হলো:

# ডাক্তার, আইনজীবী, চার্টার্ড অ্যাকাউন্টেন্ট, প্রকৌশলী, স্থপতি ইত্যাদি পেশাজীবী সংগঠনের সদস্য হলে বা সদস্য হতে চাইলে

# পরামর্শক, ক্যাটারিং, ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট, জনবল বা নিরাপত্তা সেবা দিয়ে অর্থ গ্রহণ করতে

# বিবাহ নিবন্ধক বা কাজী হিসাবে লাইসেন্স পেতে চাইলে

# আমদানি-রপ্তানির সনদ পেতে চাইলে

# আমদানির এলসি খুলতে চাইলে

# কোম্পানি পরিচালক বা শেয়ারহোল্ডার পদ পেতে হলে

# ব্যবসা বা বাণিজ্য সংগঠনের বা সমিতির সদস্যপদ গ্রহণ

# বীমা কোম্পানির এজেন্ট হিসাবে তালিকাভুক্তি বা নবায়ন করতে হলে

# বীমা বা সার্ভেয়ার হিসাবে নিবন্ধন নিতে হলে

#  অস্ত্রের লাইসেন্স নেয়ার আবেদন করলে

# ওষুধ ব্যবসার জন্য ড্রাগ লাইসেন্স থাকলে বা করাতে চাইলে, অগ্নি-নিরাপত্তা লাইসেন্স, পরিবেশ ছাড়পত্র, বিএসটিআই লাইসেন্স পেতে চাইলে

# লঞ্চ, স্টিমার, ট্রলার, কার্গো, বার্জ ইত্যাদি নৌযানের সার্ভে সার্টিফিকেটের জন্য

# ইটভাটার অনুমোদন নিতে হলে

# পরিবহন সেবার ব্যবসা করলে

# কোন কোম্পানির ডিস্ট্রিবিউটর বা এজেন্টশিপ চাইলে

# পণ্য সরবরাহের ঠিকাদারি কাজে টেন্ডার জমা দিতে হলে আয়কর রিটার্ন জমার প্রমাণ দিতে হবে। তাতে ব্যর্থ হলে ৫০ শতাংশ হারে উৎসে কর কর্তন করার প্রস্তাব করা হয়েছে।

# এনজিও বা মাইক্রো ক্রেডিট সংস্থার জন্য বিদেশি অনুদানের ছাড় দেয়ার ক্ষেত্রে। সূত্র : বিবিসি বাংলা।