logo
আপডেট : ১৩ জুন, ২০২২ ০৯:৪৭
শ্রমজীবীদের জন্য বরাদ্দ নেই
অর্থনীতি চালিকাশক্তির মানুষগুলোই উপেক্ষিত
মূল্যস্ফীতির শিকার শ্রমিকরা
জাফর আহমদ

অর্থনীতি চালিকাশক্তির মানুষগুলোই উপেক্ষিত

করোনা মহামারির পর বৈশ্বিক ও স্থানীয় মুদ্রাস্ফীতির ধাক্কা সামলাচ্ছে বাংলাদেশ। এ সময়ে রপ্তানি খাত, কৃষি খাত ও প্রবাসীদের পাঠানো বৈদেশিক মুদ্রাই মুদ্রাস্ফীতির ধাক্কা সামলানোর প্রধান ভরসা।

আর এ তিন খাতে চালকের ভূমিকায় রয়েছেন শ্রমজীবী মানুষ। এমন পরিস্থিতিতে জাতীয় সংসদে উপস্থাপন করা হয়েছে ২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেট।

অথচ বাজেটে অর্থনীতির চালিকাশক্তি এই শ্রমজীবী মানুষরাই উপেক্ষিত হয়েছে।

মূল্যস্ফীতির কারণে গত তিন মাসে শ্রমজীবী মানুষের প্রায় ২০ শতাংশ খরচ বেড়েছে। চাল, ডাল, মাছ, মাংস, সবজি, শিশু খাদ্য থেকে শুরু করে সব ধরনের নিত্য ও সেবার দাম বেড়েছে।

বাড়তি দামে শ্রমিকরা খরচ নির্বাহ করতে হিমশিম খাচ্ছেন। পরিস্থিতি সামাল দিতে তারা অতিরিক্ত পরিশ্রম করেও ঠিকমতো সংসার চালাতে পারছেন না।

কম খেয়ে বা ধার-দেনা করে জীবন নির্বাহ করছেন। অথচ এই বাজেটে শ্রমজীবী মানুষের জন্য বিশেষ কোনো বরাদ্দ বা স্কিম নেই, যার মাধ্যমে তারা সহায়তা পাবেন।

জানা যায়, তৈরি পোশাক খাতসহ বিভিন্ন শিল্পে শ্রমিকের সংখ্যা প্রায় ৮০ লাখ। এর মধ্যে তৈরি পোশাকশিল্প ও বস্ত্র খাতেই রয়েছে প্রায় ৫০ লাখ শ্রমিক।

এর বাইরে রয়েছে অন্যান্য আনুষ্ঠানিক ও অনানুষ্ঠানিক শিল্প খাত। বাজেট উপস্থাপনের দুই দিন আগে মিরপুরের তৈরি পোশাকশিল্পের শ্রমিকরা মজুরি বোর্ড গঠন করে বেতন বৃদ্ধির দাবি তোলেন।

এসব শ্রমিকরা একনাগাড়ে চার দিন সড়কে বিক্ষোভ করেন। এর উত্তাপ উত্তরা শিল্প এলাকাতেও আছড়ে পড়ে। স্পন্দন তৈরি হয় অন্যান্য শিল্প এলাকাতেও।

এ সময় শ্রমিকরা বলেন, নিত্যপণ্যের দাম বাড়ছে। তারা বলেন, বেড়েছে সব ধরনের খরচ। গরিবের প্রিয় খাবার এক ডজন ডিমের দাম বেড়েছে এলাকা ভেদে ২০ থেকে ৩০ টাকা।

এ অবস্থায় বেতন না বাড়লে আমরা চলতে পারছি না।

সরকারের হিসাবে শহরাঞ্চলে সবচেয়ে বেশি মূল্যস্ফীতি হয়েছে। প্রস্তাবিত বাজেটে উল্লেখ করা হয়েছে মার্চ পর্যন্ত শহরাঞ্চলে খাদ্যে ৪.৫৩ শতাংশ এবং খাদ্যবহির্ভূত ৬ দশমিক ১৯ শতাংশ মূল্যস্ফীতি হয়েছে।

এ সময়ে জাতীয় বা গড় মূল্যস্ফীতি হয়েছে ৬.৩২ শতাংশ। এপ্রিল-মে দুই মাসে মূল্যস্ফীতি আরো বেড়েছে।

থিঙ্কট্যাঙ্ক সিপিডিসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে বলা হয়েছে, এ সময় প্রকৃত মূল্যস্ফীতি সরকার উল্লিখিত মূল্যস্ফীতির প্রায় দ্বিগুণ।

নিত্যপণ্য ক্রয়ের জন্য বাজারে গেলে এ তথ্য মেলে। শ্রমিক নেতারা বলেন, এই বাজেটে শ্রমিকরা উপেক্ষিত হয়েছে।

প্রস্তাবিত বাজেটে শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের জন্য বরাদ্দ রাখা হয়েছে ৩৫৬ কোটি ৮২ লাখ টাকা। এ বরাদ্দের মধ্যে মন্ত্রণালয়ের পরিচালন ব্যয় বাবদ যাবে ১৯৮ কোটি ৮২ লাখ টাকা।

আর উন্নয়ন ব্যয় বাবদ যাবে মাত্র ১৫৮ কোটি টাকা। বৈশি^ক ও স্থানীয় মূল্যস্ফীতির আঘাতে বিপর্যস্ত শ্রমজীবী মানুষের খাদ্য সহায়তার জন্য কোনো ঘোষণা নেই বাজেটে।

বিআইডিএসের মহাপরিচালক বিনায়ক সেন বলেন, শহরাঞ্চলের মূল্যস্ফীতির হার তুলনামূলক বেশি। শ্রমিকরা কলে কারখানায় উৎপাদন করছেন।

উদ্ভূত পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে নিম্ন আয়ের মানুষকে খোলাবাজারে কম দামে যে চাল, ডাল দেওয়া হচ্ছে রাজধানীর ৭০ থেকে ৮০ লাখ শ্রমিকের কাছেও এসব পণ্য পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে।

যাতে উদ্যোক্তাদের ওপর কোনো চাপ সৃষ্টি না হয়।

শ্রমিক নেতৃবৃন্দ ও অর্থনীতিবিদরা মনে করছেন, মূল্যস্ফীতিকে বাগে আনার ক্ষেত্রে দেশে উৎপাদিত খাদ্য, রপ্তানি আয় ও প্রবাসী আয় ভূমিকা রাখছে।

প্রায় দুই কোটি কৃষি শ্রমিক, এক কোটির উপরে প্রবাসী শ্রমিক এবং ৮০ লাখ শহুরে শ্রমিকসহ কোটি শ্রমিক শ্রম-ঘামে ভূমিকা রাখছে।

অথচ এসব শ্রমিককে স্বস্তি দিতে বাজেটে প্রত্যক্ষ কোনো বরাদ্দ নেই।

জানা গেছে, গত সপ্তাহে মিরপুরে বেতন বৃদ্ধির দাবিতে গার্মেন্ট শ্রমিকদের বিক্ষোভের সময় কম দামে চাল, ডাল, চিনি দেওয়ার কথা ঘোষণা করা হয় কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরের বৈঠক থেকে।

বলা হয়, আন্তর্জাতিক ও স্থানীয় কারণে পণ্যমূল্য বেড়ে যাওয়ায় শ্রমিকদের জীবন নির্বাহের ব্যয় বেড়েছে। এ কারণে শ্রমিকরা বিক্ষোভ শুরু করেছেন। একটি মহল শ্রমিকদের ভিন্ন পথে পরিচালিত করছে।

পণ্যমূল্য বৃদ্ধির কারণে শ্রমিকরা বিক্ষোভ করছে, এ সত্য সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তরের ঘোষণাতেই ওঠে আসে। বৈঠক শেষে সংবাদ সম্মেলনে এ কথা বলা হয়।

পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে শ্রমিকদের কার্ডের মাধ্যমে কম মূল্যের নিত্যপণ্য দেওয়ার যে কথা ঘোষণা দেওয়া হয়েছে তা যৌক্তিক। কিন্তু বাজেটে সে ব্যাপারে ন্যূনতম উদ্যোগ নেই বলে মনে করেন শ্রমিক নেতারা।

শ্রমিক ফ্রন্টের সাধারণ সম্পাদক রাজেকুজ্জামান রতন বলেন, শ্রমিকরা শ্রম ও ঘাম দিয়ে উৎপাদন করে জিডিপি বাড়িয়েছে, ভোগ্যপণ্য কেনার মাধ্যমে ভ্যাট দিয়ে রাষ্ট্রের টাকা বাড়িয়েছে কিন্তু তার উৎপাদনের স্বীকৃতিও যেমন পায়নি, ভ্যাট দেওয়ার বিনিময়ে রাষ্ট্রের কাছে থেকে কোনো সেবাও পায়নি।

তিনি বলেন, বাজেটে শ্রমিকের জন্য যেমন কথা নেই। তেমনি বাজেট পূর্ব আলোচনার সময় কোনো শ্রমিক প্রতিনিধিকেও ডাকা হয়নি।

বাজেট কেমন হবে সে আলোচনা করেছে শুধু ব্যবসায়ীর সঙ্গে। এমনকি অন্য কোনো পেশার মানুষের সঙ্গেও আলোচনা করা হয়নি। বাজেট করার ক্ষেত্রে সরকার ব্যবসায়ীদেরই শুধু অংশীজন মনে করেছে। ফলে এই বাজেট অংশগ্রহণমূলক হয়নি।

বাজেটে শ্রমজীবী মানুষের জন্য নির্দিষ্ট করে ঘোষণা না থাকলেও সার্বিক মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে দেশের মানুষকে স্বস্তি দেওয়ার জন্য উদ্যোগ আছে বলে জানান তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রী ড. হাছান মাহামুদ।

তিনি গতকাল সচিবালয়ে সংবাদ সম্মেলনে বলেন, প্রস্তাবিত বাজেটে প্রায় ৯০ হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি দেওয়া হয়েছে। সার, জ্বালানি ও বিদ্যুতে ভর্তুকি দেওয়া হয়েছে।

দেশের মানুষের কথা বিবেচনা করেই এটা করা হয়েছে।

বাজেটে শ্রমজীবী মানুষের সঙ্গে অবিচার করা হয়েছে বলে মনে করেন প্রবীণ শ্রমিক নেতা ও বাংলাদেশ ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্রের (টিইউসি) সভাপতি এবং বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির সাবেক সভাপতি শহিদুল্লাহ চৌধুরী।

তিনি ভোরের আকাশকে বলেন, দেশে বড়লোক-রাজনৈতিক দল ও আমলা মিলে যা কিছু করে সবকিছু শ্রমিককে বঞ্চিত করার জন্য। এ বাজেটেও তাই হয়েছে।

বাজেট উপস্থাপনের এক সপ্তাহের মধ্যে মিরপুরের শ্রমিকরা বেতন বৃদ্ধির জন্য স্বতঃস্ফূর্তভাবে কারখানার বাইরে বের হয়ে গেল। শ্রমিকরা ভালো নেই, শ্রমিকদের মজুরি বৃদ্ধি প্রয়োজন।