logo
আপডেট : ১৩ জুন, ২০২২ ১০:১৬
বিশ্ব নারী উত্যক্তকরণ প্রতিরোধ দিবস আজ
বেশিরভাগ ঘটনার প্রতিবাদ হয় না
নিখিল মানখিন

বিশ্ব নারী উত্যক্তকরণ প্রতিরোধ দিবস আজ

প্রতীকী ছবি

রাজধানীর কুড়িল বিশ্ব রোডের একটি পোশাক কারখানায় কাজ করেন শেফালী বেগম (২৫)। পরিবার নিয়ে থাকেন জগন্নাথপুরে। যাওয়া-আসার পথে নানা অঙ্গভঙ্গিমা করে এক বখাটে তাকে উত্ত্যক্ত করতো।

এক দিন সন্ধ্যায় বাসায় ফেরার পথে একা পেয়ে শ্লীলতাহানির চেষ্টা করা হয়। চিৎকার দিলে পালিয়ে যায় ছেলেটি।

পরবর্তী দিনগুলোতে দলবদ্ধভাবে যাওয়া-আসা করায় ছেলেটির উত্ত্যক্ত থেকে রেহাই পায় শেফালী বেগম।

শুধু শেফালী বেগম নন, প্রতিদিন দেশের আনাচে-কানাচে নানাজনের দ্বারা নানাভাবে উত্ত্যক্তের শিকার হচ্ছেন হাজার হাজার নারী।

বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ঝামেলা এড়াতে এবং সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গির কথা ভেবে উত্ত্যক্তের শিকার হওয়ার ক্ষোভ ও কষ্ট নীরবে সহ্য করে চলেন ভুক্তভোগীরা।

বিশেষজ্ঞরা জানান, সাধারণত কোনো নারী বা কিশোরীকে তার স্বাভাবিক চলাফেরা বা কাজকর্ম করা অবস্থায় অশালীন মন্তব্য করা, ভয় দেখানো, তার নাম ধরে ডাকা এবং চিৎকার করা, বিকৃত নামে ডাকা, কোনো কিছু ছুড়ে দেয়া, ব্যক্তিত্বে লাগে এমন মন্তব্য করা, যোগ্যতা নিয়ে টিটকারী করা, তাকে নিয়ে অহেতুক হাস্যরসের উদ্রেক করা, রাস্তায় হাঁটতে বাধা দেয়া, অশ্লীল অঙ্গভঙ্গি করা, ইঙ্গিতপূর্ণ ইশারা দেয়া, সিগারেটের ধোঁয়া গায়ে ছাড়া, উদ্দেশ্যমূলকভাবে পিছু নেয়া, অশ্লীলভাবে প্রেম নিবেদন করা, উদ্দেশ্যমূলকভাবে গান-ছড়া বা কবিতা আবৃত্তি করা, চিঠি লেখা, পথ রোধ করে দাঁড়ানো, প্রেমে সাড়া না দিলে হুমকি প্রদান ইত্যাদি উত্ত্যক্তকরণের মধ্যে পড়ে।

চলতি বছরের মার্চে ‘নারীদের আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপট ও মানসিক স্বাস্থের প্রভাব’ শীর্ষক গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করে আঁচল ফাউন্ডেশন।

বৈষম্য, যৌন হয়রানি ও নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গির সম্মুখীন হয়েছেন এমন ১ হাজার ১৪ জন নারীর সাক্ষাৎকার নেয়া হয়েছে। জরিপে অংশ নেন সারা দেশের বিভিন্ন জেলা ও বিভাগের ১৮ থেকে ৩০ বছর বয়সি নারীরা।
গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশের ৬৯.৯২ শতাংশ নারী শারীরিক গঠন নিয়ে নেতিবাচক মন্তব্যের শিকার হচ্ছেন।

৩৭.২৪ শতাংশ নারীকে শরীরের গঠন নিয়ে আত্মীয়রা হেয় করেছে। বন্ধুর কাছে হেয় হয়েছে ২২ শতাংশ। এমনকি পরিবার থেকে এ ধরনের মন্তব্য শুনেছেন বলে জানিয়েছেন ১৪.২৫ শতাংশ।

শারীরিক গঠন নিয়ে পথচারীর কাছ থেকে নেতিবাচক কথা শুনেছেন ১১.৮৫ শতাংশ নারী। ওজনের কারণে নেতিবাচক মন্তব্যের শিকার হতে হয় বলে ৩৯.৪৯ শতাংশ নারী মনে করেন।

গায়ের রঙের কারণেও ৩৬.৯৫ শতাংশ নারী এ ধরনের অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যান। এ ছাড়া উচ্চতা, মুখাবয়বের গঠন, কণ্ঠস্বর প্রভৃতি বিষয় নিয়ে নারীরা বিরূপ মন্তব্য শুনে থাকেন।

২৩.৭৭ শতাংশ নারী সম্মতি ছাড়াই পরিবার থেকে বিয়ের চাপের সম্মুখীন হয়েছেন বলে জরিপে উঠে এসেছে। ৬৫.৫৮ শতাংশ নারী যৌন হয়রানির শিকার হয়েছেন বলে জরিপে জানা গেছে।

এর মধ্যে ৩৫.৪৯ শতাংশ নারী বিকৃত যৌন ইচ্ছার প্রচ্ছন্ন ইঙ্গিত বা কুদৃষ্টির শিকার হয়েছেন। ২৯.৬২ শতাংশ নারীকে আপত্তিকর স্পর্শের ভুক্তভোগী হতে হয়েছে।

আর বিভিন্ন জায়গায় ইভ টিজিংয়ের শিকার হয়েছেন ২২.২৬ শতাংশ। গণপরিবহণে ৪৫.২৭ শতাংশ নারী যৌন হয়রানির শিকার হন বলে জরিপে উঠে এসেছে।

জরিপ অনুযায়ী, অনলাইনে বিড়ম্বনার শিকার হন ৪৩.৮৯ শতাংশ নারী। এর মধ্যে কুরুচিপূর্ণ মেসেজ পাঠিয়ে বিব্রতকর পরিস্থিতিতে ফেলা হয়েছে ৬১.১২ শতাংশকে।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের আইডি হ্যাকিংয়ের শিকার হয়েছে ১০.৩৪ শতাংশ। ৯.৮৯ শতাংশ ব্যক্তিগত ও সংবেদনশীল ছবি নিয়ে দুর্ভোগ পোহান বলে আঁচল ফাউন্ডেশনের গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে।
নারী উত্ত্যক্তকরণ ঘটনা : নারী উত্ত্যক্তকরণ ঘটনার শেষ নেই। প্রতি মুহূর্তে দেশের কোথাও না কোথাও ভিন্ন ভিন্ন কৌশলে নারী উত্ত্যক্তকরণের ঘটনা ঘটছে।

গত ছয় মাসে ঘটে যাওয়া অসংখ্য ঘটনার মধ্যে বাস্তব উদাহরণ হিসেবে কয়েকটি ঘটনা তুলে ধরা হলো।

গত ৮ জুন ময়মনসিংহ সদর উপজেলার চর ঈশ্বরদিয়া ইউনিয়নের আলালপুর গ্রামে বখাটের উত্ত্যক্ত সহ্য করতে না পেরে শম্পা আক্তার (১৫) নামে এক স্কুলছাত্রী আত্মহত্যা করে বলে অভিযোগ ওঠে।

মৃত শম্পা ওই এলাকার শেখবর আলীর মেয়ে। সে নগরীর শম্ভুগঞ্জ ইউসি (ইউনিয়ন কাউন্সিল) উচ্চবিদ্যালয়ের দশম শ্রেণির ছাত্রী। এ তথ্যটি সাংবাদিকদের নিশ্চিত করেন কোতোয়ালি মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) শাহ কামাল আকন্দ।

চলতি বছরের গত ২০ মার্চ নাটোরের নলডাঙ্গায় স্কুলছাত্রীকে উত্ত্যক্ত করার দায়ে মো. মিরাজুল ইসলাম অপু নামে এক যুবককে ছয় মাসের কারাদণ্ডাদেশ দেন ভ্রাম্যমাণ আদালত।

ভ্রাম্যমাণ আদালতের বিচারক উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) সুকুমার সরকার এ আদেশ দেন।

চলতি বছরের গত ১৪ ফেব্রুয়ারি খাগড়াছড়ি জেলার মানিকছড়ি উপজেলা পরিষদ চত্বরে করোনার প্রতিষেধক টিকার দ্বিতীয় ডোজ নিতে গিয়ে দুই ছাত্রী উত্ত্যক্তের শিকার হয়।

প্রতিবাদ করতে গিয়ে মারধরের শিকার হয় ওই ছাত্রীর ভাই। উত্তেজিত জনতা ও পুলিশের হাতে ধৃত ২ বখাটেকে ভ্রাম্যমাণ আদালত ১৫ দিনের সাজা দিয়ে জেল-হাজতে প্রেরণ করেন।

চলতি বছরের ৩০ এপ্রিল ঢাকার ধামরাইয়ে প্রকাশ্যে এক উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা কর্মস্থলেই বহিরাগতদের উত্ত্যক্তের শিকার হন।

ওই ঘটনায় মামলা দায়েরের পর ৩ জনকে গ্রেফতার করে আদালতে পাঠায় পুলিশ।

চলতি বছরের গত ১৯ জানুয়ারি টাঙ্গাইলের ভূঞাপুরে করোনার ভ্যাকসিন নিতে আসা ছাত্রীদের উত্ত্যক্ত করার প্রতিবাদ করায় বহিরাগতদের হামলায় ৫জন শিক্ষার্থী আহত হয়।

এ ঘটনায় উপজেলা পরিষদ চত্বরে উত্তেজনা দেখা দিলে পুলিশ গিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে। ওই সময় ভূঞাপুর থানার উপপরিদর্শক (এসআই) ফাহিম ফয়সাল সাংবাদিকদের এ তথ্য নিশ্চিত করেন।

চলতি বছরের গত ৩ এপ্রিল জাতীয় সংসদের অধিবেশনে পয়েন্ট অব অর্ডারে দাঁড়িয়ে এক পুলিশ কর্মকর্তার ইভ টিজিংয়ের প্রতিবাদ জানান সংরক্ষিত মহিলা আসনের আওয়ামী লীগের সদস্য সুবর্ণা মুস্তাফা।

কপালে টিপ পরায় এক শিক্ষককে বাজে গালি দেওয়ার পর তার গায়ে মোটরসাইকেলের চাকা তুলে হেনস্তার অভিযোগ ওঠা পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়ার দাবিও জানান সুর্বণা মুস্তাফা এমপি।
উত্ত্যক্তকরণের শিকার হলে করণীয় সম্পর্কে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী নিপারসন আজিম ভোরের আকাশকে বলেন, নারী উত্ত্যক্তকরণ বেড়েছে বহুগুণ। তা প্রতিরোধে গড়ে তুলতে হবে সামাজিক আন্দোলন।

কেউ উত্ত্যক্তকরণের শিকার হলে বা এমন কোনো ঘটনা দেখলে, প্রথমে নিকটস্থ থানায় গিয়ে দ্রুত বিষয়টি অবগত করতে হবে। লিখিত অভিযোগও করা যেতে পারে।

অবশ্য পুলিশ নিজে বাদী হয়েও মামলা করতে পারে। যদি উত্ত্যক্তকারী পরিচিত কেউ হয়, তাহলে তার নাম-ঠিকানা দিতে হবে। অপরিচিত হলে তার চেহারার বর্ণনা দিতে হবে এবং ঘটনা ও ঘটনাস্থল সম্পর্কে সঠিক তথ্য দিতে হবে।

পুলিশের সদিচ্ছা থাকলে উত্ত্যক্তকারীকে খুঁজে আইনি ব্যবস্থা নিতে পারেন। কোনো কারণে থানায় যদি অভিযোগ না নেয়, তাহলে সরাসরি আদালতের শরণাপন্ন হওয়ার সুযোগ আছে।

অথবা আশপাশে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালিত হলে ভ্রাম্যমাণ আদালতকে সঙ্গে সঙ্গে বিষয়টি অবগত করা যেতে পারে। তাছাড়া জাতীয় জরুরি সেবা ৯৯৯-এ ডায়াল করলে পুলিশি সহায়তা নিতে পারেন।

আপনার আশপাশের র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নে অথবা উপজেলা পর্যায়ে উপজেলা নির্বাহী অফিসার, সহকারী কমিশনার (ভূমি) অফিসে সশরীরে হাজির হয়ে লিখিত বা মৌখিকভাবে অভিযোগ দাখিল করতে পারেন।

জেলাপর্যায়ে বিজ্ঞ জেলা ম্যাজিস্ট্রেটকে অবহিত করতে পারেন। র‌্যাবের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটকেও জানাতে পারেন। তাৎক্ষণিকভাবে ভ্রাম্যমাণ আদালত যদি হাতেনাতে প্রমাণ পান, তাহলে ঘটনাস্থলেই শাস্তি আরোপ করতে পারবেন।

তবে মনে রাখতে হবে, ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে নিরীহ কাউকে ফাঁসানোর চেষ্টা করলে কিন্তু ফল উল্টো হতে পারে বলে জানান অ্যাডভোকেট নিপারসন আজিম।