logo
আপডেট : ১৪ জুন, ২০২২ ১১:১২
পদ্মা সেতুতে চাঙা হবে সাতক্ষীরার অর্থনীতি
আহসান রাজীব, সাতক্ষীরা

পদ্মা সেতুতে চাঙা হবে সাতক্ষীরার অর্থনীতি

দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জেলা সাতক্ষীরার সঙ্গে সারাদেশের যোগাযোগ ব্যবস্থার একমাত্র মাধ্যম সড়ক পথ। তবে সাতক্ষীরা থেকে ঢাকায় যেতে সবচেয়ে বড় ভোগান্তি ছিল দৌলদিয়া-আরিচা ও মাওয়া ফেরিঘাটে। দীর্ঘসময় ধরে ঘাটে ফেরির অপেক্ষায় ভোগান্তির শিকার হতে হয়েছে সাতক্ষীরাসহ দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের মানুষকে। তবে সেই কষ্টের অবসান হতে চলেছে। আর ক’দিন পরেই সাতক্ষীরা থেকে বাসে করে সকালে রওনা দিয়ে দুপুরে ঢাকায় পৌঁছানো যাবে। থাকবে না ফেরিঘাটের দীর্ঘ অপেক্ষার ভোগান্তি। আর এটা সম্ভব করছে পদ্মা সেতু।

আগামীতে উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থার কারণে জেলার উৎপাদিত মাছসহ কৃষিপণ্য দ্রুত ঢাকাসহ দেশের অন্য অঞ্চলে পৌঁছে যাবে। কলকাতা থেকে দূরত্ব কম হওয়ায় ভোমরা স্থলবন্দরে বাড়বে আমদানি-রপ্তানি। গড়ে উঠবে শিল্প কারখানা। সুন্দরবনে বাড়বে পর্যটকদের আনাগোনা। এক কথায় গোটা জেলার অর্থনীতি চাঙা হবে এই এক সেতুর মাধ্যমে।

পদ্মা সেতুর উদ্বোধনী তারিখ ঘোষণার পরপরই সাতক্ষীরার পরিবহণ ব্যবসায়ীরা নতুন রুটে গাড়ি নামানোর প্রস্তুতি নিচ্ছেন। ইতোমধ্যে নতুন নতুন বাস চলাচলের জন্য প্রস্তুত করছেন। সাতক্ষীরা-খুলনা-গোপালগঞ্জ রুটে তৈরি হচ্ছে নতুন বাস কাউন্টার।

সাতক্ষীরা শহরের বাসিন্দা রনি হোসেন বলেন, ‘অতীতে এক সময় সাতক্ষীরা থেকে নদী পথে দেশের অনেক এলাকায় যাতায়াত করা যেত। তবে এখন নদ-নদীগুলো পলি জমে ভরাট হয়ে যাওয়ায় সড়ক পথই আমাদের একমাত্র যোগাযোগের মাধ্যম। আমাদের জেলায় রেললাইন নেই। রেলে বা বিমানে চড়তে হলে যেতে হয় ৫০ কিলোমিটার দূরে যশোরে। পদ্মা সেতু চালু হলে ঢাকাসহ সারাদেশের সঙ্গে সাতক্ষীরার যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নত হবে।’

সাতক্ষীরার উপকূলীয় শ্যামনগর উপজেলার বাসিন্দা মো. ইয়াছিন বলেন, ‘আমরা দেশের সবচেয়ে দুর্যোগ প্রবণ উপজেলার বাসিন্দা। এখানে খাবার পানিও কিনে খেতে হয়। প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত অনেক পরিবারের সদস্যরা দেশের বিভিন্ন স্থানে কাজ করেন। কিন্তু এখান থেকে ঢাকায় পৌঁছতে ১০ থেকে ১৬ ঘণ্টা সময় লেগে যায়। ফেরিঘাটে দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করতে হয়। তাছাড়া উন্নত চিকিৎসার জন্য রোগীদের ঢাকায় নিতে চরম ভোগান্তি পোহাতে হয়। পদ্মা সেতু চালু হলে ৭-৮ ঘণ্টার মধ্যে আমরা ঢাকায় পৌঁছাতে পারব।’

জেলার সুন্দরবন সংলগ্ন মুন্সীগঞ্জ এলাকার বাসিন্দা মাসুম বিল্লাহ বলেন, ‘সড়ক পথে কেউ সুন্দরবন ভ্রমণ করতে চাইলে তাকে সাতক্ষীরা হয়েই সুন্দরবনে আসতে হবে। এতদিন ঢাকা থেকে সাতক্ষীরায় আসার ভোগান্তির কারণে পর্যটকরা এই রুট দিয়ে সুন্দরবনে ঘুরতে আগ্রহী ছিলেন না। তবে পদ্মা সেতু চালুর পর ঢাকা- সাতক্ষীরা রুটে অত্যাধুনিক যানবাহন চলাচল শুরু হবে। দ্রুত সময়ে ঢাকা থেকে সাতক্ষীরায় পৌঁছানো যাবে, তখন এখানে পর্যটকদের আনাগোনা বাড়বে।’

সাতক্ষীরা জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক কাজী আকতার হোসেন বলেন, ‘দক্ষিণবঙ্গের মানুষের পদ্মা সেতুর স্বপ্ন বাস্তবে রূপ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এই সেতু চালু হওয়ার পর ফেরিঘাটের বিড়ম্বনা কমবে। সাতক্ষীরার সঙ্গে সারাদেশের যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি হবে। আমাদের সুন্দরবনে পর্যটকের আগমন বাড়বে। ভোমরা বন্দরে আমদানি-রপ্তানি বাড়বে। নতুন নতুন শিল্প প্রতিষ্ঠান তৈরি হবে। জেলার হাজার হাজার মানুষের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হবে। মোট কথা সাতক্ষীরার অর্থনৈতিক চিত্র পাল্টে যাবে।’

সাতক্ষীরা বড় বাজার কাঁচামাল ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক আব্দুর রহিম বাবু বলেন, ‘সাতক্ষীরায় সারা বছরই বিভিন্ন জাতের শাকসবজি চাষ হয়। এছাড়া বর্তমানে বাণিজ্যিকভাবে আম, কুল, পেয়ারাসহ বিভিন্ন ফল উৎপাদন হচ্ছে। ফেরি ঘাটের জ্যামের কারণে অনেক সময় অতিরিক্ত অর্থ দিয়ে ফেরি পার হতে হত। সময়মতো পার হতে না পারলে ট্রাকেই নষ্ট হয়ে যেত। ফলে ব্যবসায়ীরা লোকসানে পড়তেন। ক্রেতাদেরও বেশি দামে কিনতে হত। এখন আর সেই সমস্যা থাকবে না।’

সাতক্ষীরা বড় বাজারের মাছ ব্যবসায়ী সমিতির নেতা বাবু খান বলেন, ‘সাতক্ষীরা জেলায় সবচেয়ে বেশি মাছচাষ হয়। প্রতিদিন সাতক্ষীরা জেলা থেকে শত শত টন মাছ ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় বিক্রি হয়। কিন্তু ফেরিঘাটে জ্যামের কারণে অনেক সময় সময়মতো বাজার ধরতে না পারায় অনেক ব্যবসায়ী লোকসানে পড়তেন। বরফ নষ্ট হয়ে অনেক সময় মাছের গুণগত মান নষ্ট হয়ে যায়। পদ্মা সেতু চালু হলে আমাদের মাছচাষি ও ব্যবসায়ীরা যেমন লাভবান হবে পাশাপাশি ক্রেতারা ভালো মানের মাছ পাবেন।’

ভোমরা স্থলবন্দর সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের সহ-সভাপতি শেখ এজাজ আহমেদ স্বপন বলেন, ‘বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম স্থলবন্দর ভোমরা স্থলবন্দর। কলকাতা থেকে সাতক্ষীরার এই বন্দরের দূরত্ব সবচেয়ে কম। অথচ শুধুমাত্র পদ্মা নদীতে ফেরি পারাপারে সমস্যার কারণে এতদিন অনেক ব্যবসায়ী এই বন্দর ব্যবহারে আগ্রহী ছিলেন না। পদ্মা সেতু চালু হলে ভোমরা বন্দরে আমদানি-রপ্তানি বাড়বে। জেলার হাজার হাজার মানুষের কর্মসংস্থান বাড়বে।’

স্থলবন্দরের সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক মাকসুদ খান বলেন, ‘ভোমরা বন্দর দিয়ে পেঁয়াজসহ বিভিন্ন ফল আমদানি বেশি হয়। ফেরি পারাপারে সমস্যার কারণে এসব পণ্য এখন ঢাকায় পাঠাতে অনেক সময় লেগে যায়। খরচও বাড়ে। পদ্মা সেতু চালুর পর ৫ থেকে ৬ ঘণ্টার মধ্যে পণ্য ঢাকায় পৌঁছবে।’

সাতক্ষীরা মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালের পরিচালক ডা. কুদরত-ই-খুদা বলেন, ‘সড়ক পথে ভোগান্তির জন্য সীমান্তবর্তী এই জেলার অনেক মানুষ এতদিন চিকিৎসার জন্য ভারতমুখী ছিলেন। তবে সেতু চালুর পর সাতক্ষীরার রোগীরা উন্নত চিকিৎসার জন্য দ্রুত ঢাকায় পৌঁছতে পারবেন।’