করোনা টেস্ট করাতে আগ্রহ দেখাচ্ছে না মানুষ। হাসপাতালে যাচ্ছে না করোনা রোগীরা। অথচ গত দুই সপ্তাহের বেশি সময় ধরে দৈনিক করোনা রোগী শনাক্তের হার ঊর্ধ্বমুখী। করোনা উপসর্গ ও উপসর্গহীন মানুষে চলছে অবাধ মেলামেশা। প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম নেই বললেই চলে। এভাবে চলতে থাকলে করোনা পরিস্থিতি যেকোনো সময় ভয়াবহ আকার ধারণ করতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা।
গতকাল সোমবার এক অনুষ্ঠানে করোনা পরিস্থিতির অবনতির বিষয়টি স্মরণ করিয়ে দিয়ে সবাইকে সতর্ক হওয়ার আহ্বান করেছেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক।
- হাসপাতালে যাচ্ছে না করোনা রোগীরা
- করোনার ভয়াবহতা ভুলতে বসেছে মানুষ
- অবনতিতে সতর্কবার্তা দিলেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী
- চলছে মানুষের অবাধ মেলামেশা
মারাত্মক না হলেও গত প্রায় দুই সপ্তাহ ধরে দেশের করোনা পরিস্থিতির ধারাবাহিকভাবে অবনতি ঘটছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের করোনাবিষয়ক দৈনিক প্রতিবেদনে অবনতির চিত্র ফুটে উঠেছে। জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ধারাবাহিক অবনতির বিষয়টি অবহেলা করা যাবে না। নতুন রোগী শনাক্ত ও শনাক্তের হার প্রতিদিন বাড়ছে। করোনার ভয়াবহ থাবার বিষয়টি ভুলে যেতে বসেছে দেশের মানুষ। স্বাস্থ্যবিধির বালাই নেই। নিয়ন্ত্রণে যাওয়ার এক বছর পর করোনা পরিস্থিতির আবার অবনতি হয়েছে বিশ্বের অনেক দেশে। তাই দেশের মানুষকে স্বাস্থ্যবিধি বিশেষ করে মাস্ক ব্যবহার করার পরামর্শ দিয়েছেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা।
দৈনিক শনাক্ত ধারাবাহিকভাবে বাড়ছে: স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপচিালক (প্রশাসন) অধ্যাপক ডা. আহমেদুল কবীর স্বাক্ষরিত করোনাবিষয়ক দৈনিক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশে করোনায় নতুন শনাক্ত ও শনাক্তের হার গত ২ জুন ছিল যথাক্রমে ২২ জন ও ০.৪২ শতাংশ, ৩ জুন ২৯ জন ও ০.৬২ শতাংশ, ৪ জুন ৩১ জন ও ০.৭৫ শতাংশ, ৫ জুন ৩৪ জন ও ০.৭৯ শতাংশ, ৬ জুন ৪৩ জন ও ০.৯৯ শতাংশ, ৭ জুন ৫৪ জন ও ১.১৪ শতাংশ, ৮ জুন ৫৮ জন ও ১.১৮ শতাংশ, ৯ জুন ৫৯ জন ও ১.১৫ শতাংশ, ১০ জুন ৬৪ জন ও ১.৩৫ শতাংশ, ১১ জুন ৭১ জন ও ১.১৪ শতাংশ এবং ১২ জুন ১০৯ জন ও ২ শতাংশ।
টেস্ট করাতে আগ্রহ দেখাচ্ছে না মানুষ : জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, করোনা টেস্ট করাতে আগ্রহ দেখাচ্ছে না মানুষ। করোনা পরীক্ষা করানোর জন্য দৈনিক পরীক্ষিত নমুনা সংখ্যা দীর্ঘদিন ধরে চার থেকে পাঁচ হাজারের মধ্যে উঠানামা করছে। অথচ সারাদেশে পরীক্ষাগারের সংখ্যা বেড়ে হয়েছে ৮৭৯। গত ১২ জুন দেশের ২৫টি জেলায় করোনার কোনো নমুনা পরীক্ষা হয়নি। অর্থাৎ সংগৃহিত কোনো নমুনা ছিল না। বিভাগভিত্তিক বিবেচনায় ১২ জুন পরীক্ষিত নমুনার সংখ্যা ছিল ঢাকায় ৪৫৭৯, চট্টগ্রামে ৩৩৫, ময়মনসিংহে ১১, রাজশাহীতে ১৯৭, রংপুরে ৫৬, খুলনায় ৩৯, বরিশালে ৫ ও সিলেট বিভাগে ৫৮।
হাসপাতালে যাচ্ছে না করোনা রোগীরা : জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, হাসপাতালে যাচ্ছে না করোনা রোগীরা। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পাঠানো করোনাবিষয়ক দৈনিক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, কোভিড সাধারণ শয্যার প্রায় ৯৯.৫৭ শতাংশই খালি থাকছে। আর নতুন শনাক্ত রোগীর সংখ্যা ধারাবাহিকভাবে বাড়লেও হাসপাতালে চিকিৎসাধীন করোনা রোগী তেমন নেই। সারাদেশের বিভিন্ন হাসপাতালে গত ১২ জুন মোট ৫৫ জন, ১১ জুন ৩৬ জন, ১০ জুন ৪১ জন ও ৯ জুন ৫৪ জন করোনা রোগী ভর্তি ছিলেন। সারাদেশে দৈনিক সুস্থ হওয়া রোগীর হার ৯৭.৫০ শতাংশ। অর্থাৎ প্রতিদিন ২.৫০ শতাংশ করোনা রোগী রয়ে যাচ্ছে। কিন্তু হাসপাতালে তেমন রোগী নেই।
উপসর্গ দেখা দিলে সেন্টারে নমুনা দিতে হবে: বিশেষজ্ঞরা
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিসিন অনুষদের সাবেক ডিন ও প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত চিকিৎসক অধ্যাপক ডা. এবিএম আব্দুল্লাহ ভোরের আকাশকে বলেন, করোনা টেস্ট করাতে আগ্রহ দেখাচ্ছে না মানুষ। হাসপাতালে যাচ্ছে না করোনা রোগীরা। অথচ গত দুই সপ্তাহের বেশি সময় ধরে দৈনিক করোনা রোগী শনাক্তের হার ঊর্ধ্বমুখী। করোনা উপসর্গ ও উপসর্গহীন মানুষের স্বাস্থ্যবিধিহীন অবাধ মেলামেশা চলছে। উপগর্স দেখা দিলে সেন্টারে গিয়ে নমুনা দিয়ে আসতে হবে। আর নমুনা সংগ্রহ কার্যক্রমের সংশ্লিষ্টরাও নমুনা সংগ্রহে আগের মতো উদ্যোগী হবেন। যত বেশি নমুনা পরীক্ষিত হবে, দেশের করোনা পরিস্থিতির সার্বিক চিত্র তত বেশি প্রকাশ পাবে।
দেশের বিশিষ্ট ভাইরোলজিস্ট ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম ভোরের আকাশকে বলেন, উপসর্গ দেখা দেওয়ার পরও করোনা পরীক্ষা করোনার জন্য নমুনা দিতে না যাওয়ার বিষয়টি ভালো লক্ষণ হতে পারে না। বিষয়টি নিয়ে অবহেলা ঠিক হবে না। সংক্রমিত হওয়ার পরিবেশ তৈরি করে দিলে সারাদেশে ছড়িয়ে পড়তে খুব বেশি সময় লাগবে না। তাই সবাইকে এ বিষয়ে সচেতন হতে হবে।
সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইডিসিআর) উপদেষ্টা ডা. মুস্তাক হোসেন ভোরের আকাশকে বলেন, করোনা ভাইরাস শনাক্তকরণ ও হাসপাতালে যাওয়ার ক্ষেত্রে উদাসীনতা দেশের করোনা পরিস্থিতিতে ভূমিকা রাখবে। অধিকাংশ রোগীরই হাসপাতালে যেতে হয় না। যারা বাসায় থাকার সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন তারা বাসায় থাকলেও একজন চিকিৎসকের তত্ত্বাবধানে থাকতে হবে। না হলে তারা বুঝতে পারবেন না অবস্থার অবনতি হচ্ছে কিনা বলে জানান ডা. মুস্তাক হোসেন।
এদিকে, গতকাল সোমবার সচিবালয়ে সাংবাদিকদের ব্রিফিংকালে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক বলেন, দেশে গত কয়েকদিন ধরে আবারো করোনাভাইরাসের সংক্রমণে ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। কোভিড এখনো নির্মূল হয়নি। এখন স্বাভাবিক অবস্থায় থাকলেও করোনা যেকোনো সময় অস্বাভাবিক হতে পারে। ইতোমধ্যে মন্ত্রীসহ অনেক গণ্যমান্য ব্যক্তি ভাইরাসটিতে সংক্রমিত হয়েছেন। এখন সবাইকে আগের মতো স্বাস্থ্য সচেতন হতে হবে, অবশ্যই স্বাস্থ্যবিধি মানতে হবে। সবাইকে মাস্ক পরতে হবে।