ফেনীর কবির হোসেন। বাংলাদেশের একটি ফাইভ স্টার হোটেলে কাজ করতেন। আয়-রোজগারও খারাপ ছিল না। স্ত্রী-সন্তানকে নিয়ে ভালোই চলছিল সংসার। এক দিন পরিচিত এক দালাল বলেন, দুবাই গেলে অনেক টাকা আয় করতে পারবেন। অল্পদিনেই কোটিপতি। মাত্র ৩ লাখ টাকা খরচ করলেই পৌঁছে যাবেন দুবাই।
এরপর সেখানের নামিদামি হোটেলে কাজ করবেন। মাসে আয় কয়েক লাখ টাকা। কবিরের কাছে যেন আকাশছোঁয়া স্বপ্ন। অল্পদিনেই কোটিপতি হওয়ার লোভ। স্বজনরা কেউ কেউ নিষেধ করলেও কর্ণপাত করেননি তিনি। স্বপ্ন অনেক। তাই দালালের হাতে তুলে দেন সাড়ে ৩ লাখ টাকা।
ট্যুরিস্ট ভিসায় অল্প কয়েকদিনের মধ্যেই চলে যান স্বপ্নের মধ্যপাচ্যের দেশ আরব আমিরাতের দুবাই। সেখানে পৌঁছেই নানা প্রতিকূলতায় পড়েন কবির। দুবাই এয়ারপোর্ট থেকে তাকে নেওয়া বাংলাদেশিদের ক্যাম্পে। এরপর আর খোঁজ নেই দালালের। তিন মাস পেরিয়ে গেলেও কাজের কোনো খবর নেই। বসে বসে খাচ্ছেন। সঙ্গে যা টাকা নিয়েছিলেন, তা শেষ অল্প কয়েকদিনেই।
দেশ থেকে বেশ কয়েকবার টাকা নিলেও এখন আর টাকা পাঠাতে অপারগ স্বজনরা। তাই থাকা-খাওয়ারও সমস্যা প্রকট। বাসা ভাড়া না দিতে পারায় ইতোমধ্যে বাসা ছেড়ে দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন ফ্ল্যাট মালিক। সামনে মাসে হয়তো রাস্তা বা পার্কের ঘুমাতেই হবে তাকে। কথাগুলো বলেই কান্নায় ভেঙে পড়েন তিনি।
শুধু কবির হোসেন নয়, এরকম অসংখ্য বাঙালি কাজের সন্ধানে ট্যুরিস্ট ভিসায় দুবাই এসে নানা সমস্যায় ভুগছেন। কেউ কেউ ৫-৭ দিন না খেয়ে পড়ে আছেন রাস্তা বা পার্কে। কারো কারো ঠাঁই হয়েছে খেজুর বাগানে। একটু সচ্ছল বাঙালিদের সহায়তায় ৫-৭ দিন পরপর মিলছে সামান্য খাবার। প্রচণ্ড গরমে অসুস্থ হয়ে মৃত্যুবরণের ঘটনাও ঘটছে। পরে তার লাশ দেশে পাঠাতে সাহায্য তুলে খরচ মেটানো হচ্ছে।
সরেজমিন আরব আমিরাতের দুবাই, আজমান ও শারজাহ ঘুরে এসব চিত্র পাওয়া গেছে। আজমানের সানেগা এলাকায় কথা হয় মাদারীপুরের বাসিন্দা মো. সামি নামে এক যুবকের সঙ্গে। সামি জানান, দুই বছর ধরে তিনি দুবাই অবস্থান করছেন। একটি গার্মেন্টে চাকরি করেন।
বতর্মানে ট্যুরিস্ট ভিসায় যেভাবে বাংলাদেশিরা দুবাই প্রবেশ করেছেন, তা দুবাই শ্রমবাজারের জন্য বড় ধরনের হুমকি হয়ে দাঁড়াচ্ছে। দীর্ঘদিন ধরে দুবাই বসবাসকারীরাও কাজ হারাচ্ছেন। কোনো কোম্পানি দুই মাসে একটি বেতন দিচ্ছে। প্রতিবাদ করলেই চাকরিচ্যুত করে দেশে ফেরত পাঠানো হচ্চে। কারণ ট্যুরিস্ট ভিসায় এখানে আসা লোকদের সামান্য বেতনেই তারা নিয়োগ দিতে পেয়ে যাচ্ছেন।
আবার ট্যুরিস্ট ভিসায় যারা দুবাই আসছেন, তাদের ৬০ শতাংশই কাজ পাচ্ছেন না। তাই কেউ কেউ আবার পেটের তাগিদে শুধু থাকা-খাওয়ার বিনিময়ে কাজ করছেন। কারো ভাগ্যে আবার সেই সামান্য কাজটুকুও জুটছে না। ফলে অনাহারে-অর্ধাহারে পার্কে বা রাস্তায় খোলা আকাশের নিচে কাটছে তাদের জীবন।
প্রচণ্ড গরমের কারণে অনেকেই অসুস্থ হয়ে পড়ছেন। কারো কারো নিভে যাচ্ছে জীবন প্রদীপ। পরে সেই লাশ দেশে ফেরত পাঠাতে বাঙালি সাহায্য তুলতে বাধ্য হচ্ছে। এক্ষেত্রে দূতাবাসেরও কোনো সহায়তা পাওয়া যায় না বলে অভিযোগ তার।
রাস্তার পাশে ফুটপাতে বসে সবজি বিক্রেতা এক বাঙালিকে সহায়তা করছেন লক্ষ্মীপুরের রাসেল। এক মাস ২০ দিন হয়েছে ভিজিট ভিসায় দুবাই এসেছেন তিনি। খরচ হয়েছে ৩ লাখ ২০ হাজার টাকা। দালাল বলেছিল পৌঁছেই চাকরি জুটে যাবে। মাসে বেতন পাওয়া যাবে ৫০ হাজার টাকা। অভারটাইম করলে মাসে ৭০-৮০ হাজার টাকা আয় করা সম্ভব।
কিন্তু এখানে পৌঁছার পর কোনো খবর নেই দালালের। তাই সামান্য থাকা-খাওয়ার বিনিময়ে বাঙালি সবজি বিক্রেতা মহিউদ্দিনকে সহায়তা করছেন রাসেল। তিনি বলেন, আমাকে তিন মাসের ট্যুরিস্ট ভিসায় এখানে আনা হয়েছে। তিন মাস পর আবার স্থায়ী ভিসা লাগিয়ে দেওয়া হবে। কিন্তু দুবাই পৌঁছার দালালের কোনো খবর নেই।
এখন ঠিকমতো খাবারই পাওয়াই দুষ্কর, ভিসার মেয়াদ বাড়াব কীভাবে, সেই চিন্তায় অস্থির। ভিসার মেয়াদ বাড়াতে না পারলে দেশে ফেরত যেতে হবে। চট্টগ্রামের নূরুল আজিম। সাইফুদ্দিন নামে এক দালালের মাধ্যমে ৩ লাখ টাকা খরচ করে চার মাস আগে দুবাই পৌঁছান। বাড়ি থেকে আরো লাখ দেড়েক টাকা নিয়েছেন।
চার মাসেও কোনো কাজ জোটেনি তার ভাগ্যে। চোখে মুখে এক অজানা আতঙ্ক। কান্নাজড়িত কণ্ঠে তিনি বলেন, নিজে খেতে পারছি না। দেশে টাকা পাঠাব কীভাবে? যে টাকা ধারদেনা করে বিদেশ এসেছি, সেই টাকা কীভাবে শোধ করব, সেই চিন্তায়ও ঘুম হারাম।
নূরুল আজিম বলেন, ট্যুরিস্ট ভিসায় কেউ যেন দুবাই না আসেন। আমার মতো আর কোনো বাঙালি যেন এমন চরম বিপদে না পড়েন। সরকারকেও এ বিষয়ে কঠোর হওয়ার অনুরোধ করেন তিনি। কুমিল্লার চান্দিনার বাসিন্দা আশরাফ। অনেক স্বপ্ন ছিল তার। বিদেশ গিয়ে অনেক টাকায় রোজগার করবেন।
পরিবারের অসচ্ছলতা ঘোচাবেন। কিন্তু সব স্বপ্নেরই অপমৃত্যু হয়েছে। এক বছর আগে দুবাই পৌঁছে কাজ করেছেন মাত্র দুই মাস। বাকি ১০ মাসই বসা। বতর্মানে কয়েকদিন ধরে ফুটপাতে সবজি বিক্রি করে কোনোমতে দিনাতিপাত করছেন। তিনি বলেন, বর্তমানে দুবাইর পরিস্থিতি খুবই খারাপ। এখানে কাজ নেই। প্রচুর লোকজন বেকার। মানুষ এখনো বুঝছে না। এখনো আসছে।
বাগেরহাটের ফরিকহাট উপজেলার বাসিন্দা জিহাদ হোসেন বলেন, বিদেশে আসছি আমরা উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ গড়ার জন্য। কিন্তু সেটা তো হচ্ছে। বতর্মানে যে বেতন পাচ্ছি, তা দিয়ে নিজের চলাই দায়। এরপর আবার দুই বছর পর পর ভিসা রিনিউ করতে খরচ হচ্ছে দুই থেকে আড়াই লাখ টাকা।
এসব করে দেশে পাঠাব কী, আবার নিজে চলব কেমনে। তিনি বলেন, যে টাকা খরচ করে এসেছি, সেই টাকা তোলাই সম্ভব হচ্ছে না। তাহলে আমাদের ভবিষ্যৎ কী? কামাল আহমেদ নামে এক ব্যবসায়ী বলেন, ভারত, নেপাল, ফিলিপাইন, পাকিস্তানসহ বিভিন্ন দেশ থেকে যেসব শ্রমিক দুবাই আসছেন, তারা শিক্ষিত ও সংশ্লিষ্ট কাজের প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত।
ফলে এখানে আসার পর তাদের কাজ পেতে কোনো ধরনের সমস্যা হচ্ছে না। অথচ বাংলাদেশ থেকে যারা আসছেন, তারা লেখাপড়া যেমন জানেন না, তেমনি নেই কোনো কাজের প্রশিক্ষণ। তিনি বিদেশে কাজের উদ্দেশ্যে গেলে অবশ্যই প্রশিক্ষণ নিয়ে যাওয়ার অনুরোধ করেন।
বাংলাদেশ দূতাবাসের দুবাই কনস্যুলেট জেনারেল বিএম জামাল হোসেন ভোরের আকাশকে বলেন, প্রতিদিন উদ্দেশ্যহীনভাবে ৮০০ থেকে ১ হাজার বাংলাদেশি ট্যুরিস্ট ভিসায় দুবাই প্রবেশ করছেন। ফলে সামনে আরো ভয়াবহ পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হবে। তিনি বলেন, দীর্ঘদিন আরব আমিরাতে ওয়ার্ক ভিসা বন্ধ ছিল।
সম্প্রতি এখানকার সরকার ট্যুরিস্ট ভিসায় বাংলাদেশি শ্রমিক আসার অনুমতি দেয়। তবে তাদের আসার আগেই কর্মস্থল কনফার্ম করে আসতে বলা হয়। এমনকি জনশক্তি ব্যুরো থেকে ওয়ার্ক পারমিট কার্ড সংগ্রহ করা বাধ্যতামূলক করা হয়।
কিন্তু অধিকাংশ বাংলাদেশিই সেই নিয়ম মানছেন না। ফলে এখানে এসে বিপাকে পড়ছেন বাংলাদেশিরা। তারা কাজ পাচ্ছেন না। থাকা-খাওয়ার অভাব। অনেকেই মসজিদ, পার্ক, কিংবা খোলা মাঠে জীবনযাপন করছেন। কোনো বাঙালি দূতাবাসের সহায়তা চাইলে তাকে যথাসম্ভব সহায়তা করা হচ্ছে।
তিনি বলেন, গত এক বছরে দুবাইয়ে চার শতাধিক বাঙালি মারা গেছেন। ঠিকমতো কাগজপত্র না থাকায় তাদের লাশ দেশে পাঠাতেও নানা সমস্যায় পড়তে হয়েছে। সাহায্য তুলে তাদের লাশ দেশে ফেরত পাঠানো হয়েছে।