logo
আপডেট : ১৯ জুন, ২০২২ ০০:৩৫
বন্যা
ধান-চাল ও গবাদি পশু নিয়ে বিপাকে বন্যাদুর্গতরা
শাহীন রহমান

ধান-চাল ও গবাদি পশু নিয়ে বিপাকে বন্যাদুর্গতরা

সুনামগঞ্জের ফতেহপুরে রিঙ্কু চক্রবর্তী। অন্যসবার মতো তার বাড়িও হঠাৎ বন্যায় তলিয়ে গেছে। দুটি ঘরই বন্যায় ভাসিয়ে নিয়েছে। গবাদি পশু নিয়ে উঠেছেন আশ্রয়কেন্দ্রে। কিন্তু বন্যায় নিজের ও পরিবারের খাদ্য সঙ্কুলানের নিশ্চয়তা নেই। এ অবস্থায় গবাদি পশু নিয়ে পড়েছেন বিপাকে। তিনি বলেন, ‘নিজেই খাবার পাচ্ছি না, সেখানে গবাদি পশুগুলোকে কীভাবে বাঁচাব।’

দক্ষিণ সুনামগঞ্জের উজানগাঁও গ্রামের এমজেএইচ জামিল। পরিবারের সদস্য ১৪ জন। সারা বছরের খাবার হিসেবে গোলায় দেড়শ মন ধান রয়েছে তাদের। তিনি বলেন, ‘বাড়ি বন্যার পানিতে তলিয়ে গেছে। এখন এই ধান কীভাবে সংরক্ষণ করা হবে, তা নিয়ে বিপাকে পড়েছেন। অথচ এই ধান দিয়ে সারা বছরের খাবার চলে। ধান নষ্ট হলে পরিবারের সদস্যদের খাবারে অনিশ্চয়তা দেখা দিতে পারে।’

শুধু রিঙ্কু অথবা জামিল নন। ধান চালা গবাদি পশু নিয়ে বিপদে পড়েছেন সিলেট বিভাগের অধিকাংশ মানুষ। শহর থেকে গ্রাম সবই পানি নিচে তলিয়ে আছে। বানভাসি মানুষ ছুটছে আশ্রয়ের সন্ধানে। কিন্তু বাড়ির ঘর বন্যায় ভেসে যাওয়ায় প্রয়োজনীয় জিনিসও সঙ্গে নিতে পারেনি।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ‘দেশের উৎপাদিত ধানে বড় অংশ আসে হাওর অঞ্চল থেকে। প্রতি বছর বর্ষা মৌসুমের আগে হাওরের এক ফসলি জমিতে প্রচুর ধান উৎপাদন হয়। সেসব ধান সারা বছরের খাদ্যের জন্য কৃষক গোলায় সংরক্ষিত রাখেন। কিন্তু এবারের বন্যায় সংরক্ষিত অধিকাংশ ধান নষ্ট হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। ফলে বন্যা শেষ হলে হাওর অঞ্চলে খাদ্য সংকট প্রকট হতে পারে।

বন্যায় আক্রান্তদের অনেকে প্রতিবেশীর বাড়ি, নৌকায় আশ্রয় পেলেও গবাদি পশু নিয়ে বিপদে পড়েছেন। সড়ক বা বাঁধগুলো ডুবে যাওয়ায় এসব প্রাণী রাখার জায়গা পাচ্ছেন না। সাব-স্টেশনে পানি ঢুকে পড়ায় সুনামগঞ্জ এলাকার অনেক এলাকায় বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ রেখেছে বিদ্যুৎ বিভাগ। ফলে মোবাইল নেটওয়ার্ক কাজ করছে না।

এ নিয়ে হাওর অঞ্চল তিন দফা বন্যায় আক্রান্ত হয়েছে। আগের বন্যায় মানুষ পানিবন্দি হলে ধান চাল বা গবাদি পশুর বড় ধরনের ক্ষতি হয়নি। এবারে তাও রক্ষা করতে সক্ষম হচ্ছেন না বানভাসিরা। পানিবন্দি হয়ে এখন চরম মানবেতর জীবনযাপনের হুমকিতে পড়েছেন।

সিলেটের কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার রনিখাইল এলাকার ইসমাইল আলী বলেন, ‘বারবার বন্যায় আক্রান্ত হচ্ছি। সব হারিয়ে এখন দিশাহারা হয়ে পড়েছি। পরিবার নিয়ে কোথায় যাব। গবাদি পশু কীভাবে রক্ষা করব। চার দিনের টানা বৃষ্টিতে ভেসে গেছে কোম্পানিগঞ্জ। নিজেদের বাঁচাতেই যখন হিমশিম অবস্থা, তখন গবাদি পশু নিয়ে আরো বিপাকে পড়েছে মানুষ।

দেশের অন্যান্য অঞ্চলের সঙ্গে বন্যাক্রান্ত উপজেলাগুলোর যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। পানি সাঁতরে, নয়তো নৌকায় চেপে আশ্রয়স্থলে ছুটছে মানুষ। অনেকে কলাগাছের ভেলায় চেপেও নিরাপদ আশ্রয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছেন। ঘাসিটুলা, কলাপাড়া, শামীমাবাদ, ডহর, তালতলা, কালিঘাট, সোবহানীঘাট, শাহজালাল উপশহর, তেররতন, হবিনন্দি, সাদিপুর, বোরহানবাগ, শিবগঞ্জ ও দক্ষিণ সুরমার কদমতলিসহ বিভিন্ন এলাকার সড়ক পানিতে ডুবে গেছে। অনেক বাড়িতে পানি ঢুকে পড়েছে।

শাহজালাল উপশহর এলাকার বাসিন্দা আমিনুল ইসলাম পলাশ জানান, ‘উপশহরের বেশির ভাগ সড়ক তলিয়ে গেছে। রাতের দিকে বাসায় পানি ঢুকে পড়ে। বিদ্যুৎ নেই, সঙ্গে পানির সংকটও দেখা দিয়েছে। সিলেট ও সুনামগঞ্জের নয়টি উপজেলার অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্যার পানিতে তলিয়ে গেছে। সিলেট জেলায় ২৩০টি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পানি উঠেছে। এছাড়া জেলার ৬০টি মাধ্যমিক বিদ্যালয়, কলেজ ও মাদ্রাসা পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় এগুলোতে পাঠদান বন্ধ রাখা হয়েছে।’

সুনামগঞ্জে একতলা কোনো বাড়িতে পানি উঠতে বাকি নেই। বন্ধ রাখা হয়েছে বিদ্যুৎ। সুরমা উপচানো বন্যা চরম দুর্বিপাকে ফেলেছে সুনামগঞ্জ শহরের বাসিন্দাদের। সেলিম মিয়া নামের এক বাসিন্দা বলেন, ‘আমার ৫০ বছরের জীবনে সুনামগঞ্জ শহরে এমন ভয়াবহ বন্যা দেখিনি। শহরের সব এলাকা প্লাবিত। মানুষ আশ্রয় নিতে পারছে না। এখন ত্রাণের চেয়ে আশ্রয় জরুরি।’

সুনামগঞ্জ শহরের বাসিন্দা তোফাজ্জল হোসেন বলেন, ‘বন্যায় আমার বাড়ি ডুবে গেছে। পরিবারের সবাইকে নিয়ে একজন প্রতিবেশীর দোতলার ছাদে উঠেছি। আমার মতো গ্রামের আরো অনেকে এখানে আশ্রয় নিয়েছেন। সেখানে দ্রুত পানি বাড়ছে বলে তিনি জানান।’