সুনামগঞ্জের দিরাই পৌর সদরের রুদ্র মিজান। পেশায় সাংবাদিক। পেশাগত কারণে তিনি এখন রাজধানীর বাসিন্দা। প্রবল বর্ষণ আর পাহাড়ি ঢলের বন্যায় তার প্রিয় জন্মস্থান বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন। তাই দুইদিন পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ নেই তার।
তিনি বলেন, গত বৃহস্পতিবার সবশেষ তার পিতা সামরিক মুক্তিযোদ্ধা ফজলুর রহমানের সঙ্গে তার কথা হয়। তখন তিনি জানিয়েছিলেন সর্বোচ্চ দশ ইঞ্চি পানি বাড়লে তাদের বসত ভিটা তলিয়ে যাবে। এরপর থেকে শনিবার সকাল পর্যন্ত আর যোগাযোগ সম্ভব হয়নি।
দুপুরে বাবার মোবাইল ফোন থেকে কল আসলে রিসিভ করেন। ১৫ সেকেন্ডের কথা হয়। মোবাইল নেটওয়ার্ক সমস্যায় তার কথাও স্পষ্ট বোঝা যায়নি। পিতার কথায় তিনি এতোটুকুই বুঝেছেন যে- তাদের বাড়িতে কোমর পানি। রাস্তাঘাট সব তলিয়ে গেছে। বিদ্যুৎ তো আগেই বিচ্ছিন্ন। রুদ্র মিজান বলেন- চরম উৎকণ্ঠায় রয়েছি পরিবার নিয়ে। স্বজনেরা কী অবস্থায় আছেন তা জানি না!
শুধু রুদ্র মিজান নয় তার মতো অসংখ্যা মানুষ এখন দুশ্চিন্তায়। বিশেষ করে সিলেট ও সুনামগঞ্জে বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন। তাই সেখানকার প্রবাসী বা এলাকার বাইরে অবস্থানকারীরা স্বজনদের নিয়ে নানান দুঃস্বপ্ন দেখছেন। তাদের কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়েছে। অজানা আতঙ্কও তাড়া করছে তাদেরকে। এই অঞ্চলের মানুষের একটা বড় অংশই প্রবাসী। তাই এলাকার প্রবাসীরা যে ভালো নেই তা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের স্ট্যাটাস বা পোস্টে প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে। পরিবারের কোন সন্ধান না পেয়ে তাদের অনেকে ফেসবুকে লাইভে এসে কান্নাকাটিও করছেন।
সিলেটের কাওসার এখন থাকেন ঢাকায়। তিনি ফেসবুকে লিখেছেন- আব্বা দুইবার স্ট্রোক করেছেন। সাথে আছে ডায়বেটিস। হৃদরোগ আর ডায়াবেটিস রোগের প্রধান শত্রু দুশ্চিন্তা। এ বন্যা দেখে তার দুশ্চিন্তা হওয়ার কথা। থাইরয়েডজনিত সমস্যা আম্মার। ছোট ভাই এখনো অবুঝ। তাদেরসহ স্বজনদের খবর কিংবা উদ্ধার করতে না পারায় আমরা দুশ্চিন্তাগ্রস্থ। আল্লাহ সবাইয়ে হেফাজত করুন।
সুনামগঞ্জের দিরাই উপজেলার রাজনগর গ্রামের শাহীন মিয়া। তিনি লন্ডন প্রবাসী। গত দুইদিন থেকে পরিবারের কারো সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারেননি। এক আত্নীয়ের মাধ্যমে খবর নিয়ে জানতে পেরছেন বেশ উঁচু জায়গা হওয়া সত্ত্বেও তার বাড়িতে হাঁটু সমান পানি। তার অসুস্থ মা রাবেয়া বেগমসহ পরিবারের সদস্যদের নিয়ে তিনি নির্ঘুম দিন কাটাচ্ছেন বলে ভোরের আকাশকে জানিয়েছেন।
তিনি বলেন- নৌকা নিয়ে কোনমতে তার স্বজনেরা যেন নিরাপদে পৌঁছাতে পারেন সেচেষ্টা করছেন তিনি। বিদ্যুৎ না থাকায় মোবাইল ফোনের চার্জ নেই। তাছাড়া নেটওয়ার্কেরও সমস্যা। তাই নৌকাও ম্যানেজ করতে পারছেন না তিনি। শাহীন বলেন, রাস্তা ঘাটও সব পানির তলে। আশপাশের জেলা জেলা কেউ যে গিয়ে একটু খবর নেবে সে উপায়ও নেই।
সিলেট ও সুনামগঞ্জের বন্যা কলবিত মানুষেরা এখন সরকারসহ বিত্তবানদের কাছে আবেদন জানিয়েছেন যে- তারা যেন নিরাপদ স্থানে পৌঁছে জীবনে বেঁচে থাকতে পারেন সে ব্যবস্থা গ্রহণের। তাদের দাবি- প্রবল খাদ্য সঙ্কটে থাকা মানুষ যেন কোনরকম পেটে কিছু দিয়ে আপাতত দিন পার করতে পারেন।
আর মাত্র কয়েকদিন পরেই ঈদুল আজহা। এই ঈদে অনেকেই প্রবাস থেকে বাড়িতে আসতে চেয়েছিলেন। বুকভরা কত শত আশা আর স্বপ্ন ছিল। কিন্তু আকস্মিক বন্যায় তাদের স্বপ্ন ভেঙে খান খান হয়ে গেছে।
বন্যার প্রবল থাবা আর গ্লানি মুছে স্বাভাবিক জীবনে ফেরা নিয়েও অশ্চিয়তায় রয়েছেন বন্যার্ত মানুষেরা। তারা বিশেষ করে সরকারের কাছে জীবনের নিরাপত্তা, খাদ্য সঙ্কট দূরীকরণ ও যত দ্রুত সম্ভব বিদ্যুৎ সংযোগ চালুর জোর দাবি জানিয়েছেন।
প্রযুক্তির এই যুগে পৃথিবীটা এখন হাতের মুঠোয়। তাই পৃথিবীর নানান প্রান্তে থাকা স্বজনেরা একে অপরের সঙ্গে প্রতিমূহুর্তে যোগাযোগ করবেন সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু সেই স্বাভাবিকতা যে প্রকৃতির নির্মম থাবায় অস্বাভাবিক হয়ে গেছে তা সিলেট ও সুনামগঞ্জের বিশেষ করে প্রবাসীদের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম প্রমাণ দিচ্ছে।