logo
আপডেট : ২০ জুন, ২০২২ ১২:৪৬
ঢাকা টু দুবাই-৩
হুমকির মুখে সংযুক্ত আরব আমিরাতের শ্রমবাজার
এমদাদুল হক খান, দুবাই থেকে ফিরে

হুমকির মুখে সংযুক্ত আরব আমিরাতের শ্রমবাজার

প্রতিকী ছবি।

হুমকির মুখে পড়তে যাচ্ছে সংযুক্ত আরব আমিরাতের শ্রমবাজার। প্রতিদিন সহস্রাধিক বাংলাদেশি টুরিস্ট ভিসায় সেখানে প্রবেশ করছেন। তাদের অধিকাংশই বেকার। ফলে অল্প টাকায় কর্মী নিয়োগের সুযোগ পাচ্ছে আরব আমিরাতের কোম্পানিগুলো। আগে যাদের বেতন ছিল ২ হাজার দিরহাম।

তাদের বেতন কমিয়ে ৮শ থেকে এক হাজার দিরহাম করা হচ্ছে। কেউ প্রতিবাদ করলে তাকে চাকরিচ্যুত করে দেশে পাঠিয়ে দেওয়া হচ্ছে। আবার অভিযোগ রয়েছে, কোনো কোনো কারখানা মালিক টানা তিনমাস বেতন বন্ধ রাখছে।

ফলে অনেকেই স্বেচ্ছায় চাকরি ছেড়ে দিচ্ছেন। এতে তিন মাসের টাকা থাকছে কোম্পানির পকেটে। সরেজমিন আরব আমিরাতের দুবাই, শারজাহ ও আজমান এলাকা ঘুরে বাংলাদেশি শ্রমিকদের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।

বাংলাদেশ দূতাবাসের কনস্যুলেট জেনারেলও এর সত্যতা নিশ্চিত করে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। তিনি বাংলাদেশিদের কর্মস্থল নিশ্চিত করে আরব আমিরাত প্রবেশের অনুরোধ জানান।

বাংলাদেশ দূতাবাসের দুবাই কনস্যুলেট জেনারেল বিএম জামাল হোসেন ভোরের আকাশকে বলেন, দালালদের প্রলোভনে পড়ে প্রতিদিন ৮ থেকে এক হাজার বাংলাদেশি টুরিস্ট ভিসায় আরব আমিরাতে প্রবেশ করছেন। তাদের প্রত্যেকের কাছ থেকে দালাল চক্র ৩ থেকে ৪ লাখ টাকা করে নিয়েছে।

এখানে তাদের উচ্চ বেতনের কাজের প্রতিশ্রুতি দিয়ে আনা হলেও দুবাই প্রবেশের পর দালাল চক্র আর কোনো খোঁজখবর নিচ্ছে না। ফলে অনেকেই চাকরি পাচ্ছেন না। কেউ কেউ পেটের তাগিদে সামান্য বেতনে চাকরি নিচ্ছেন। যা আয় হচ্ছে, তা দিয়ে নিজেদেরই চলা দায়। দেশে পাঠানোর মতো কিছুই অবশিষ্ট থাকছে না।

তিনি বলেন, যারা কর্মস্থল নিশ্চিত করে ও জনশক্তি ব্যুরোর কার্ড নিয়ে দুবাই প্রবেশ করছেন, তারা কোনো সমস্যায় পড়ে দূতাবাসের সহায়তা চাইলে দূতাবাস সর্বোচ্চ সহযোগিতা করছে।

কিন্তু যারা উদ্দেশ্যহীনভাবে এক মাসের টুরিস্ট ভিসায় এখানে এসেছেন, তাদের জন্য দূতাবাসের করার কিছু নেই। ফলে এসব লোকজন নানা সমস্যায় পড়ছেন। কাজ না পেয়ে কেউ কেউ অনাহারে-অর্ধাহারে দিন পার করছেন। কারো কারো আশ্রয় হচ্ছে মসজিদ, খেজুর বাগান, পার্ক বা খোলা কোনো মাঠে।

বিএম জামাল হোসেন বলেন, আরব আমিরাতের ৭টি প্রদেশের মধ্যে দুবাইয়ে সবচেয়ে বেশি সংখ্যক বাংলাদেশি অবস্থান করছেন। তারা খুবই মানবেতর জীবনযাপন করছেন। দিনদিন পরিস্থিতি ভয়াবহ হচ্ছে। টুরিস্ট ভিসায় উদ্দেশ্যহীনভাবে দুবাই প্রবেশ বন্ধ না হলে বাংলাদেশিদের জন্য এদেশের শ্রমবাজার ভয়াবহ খারাপ পরিস্থিতির রূপ নেবে।

আজমানের সানেগা এলাকায় কথা হয় নোয়াখালীর আবুল হোসেনের সঙ্গে। তিনি বলেন, কোম্পানির ভিসায় যারা দুবাই প্রবেশ করছেন, তারা কাজ না জানলে কোম্পানি তাদের রেখে দিচ্ছে।

এমনকি ভিসাও রিনিউ করে দিচ্ছে। কিন্তু ভিজিট ভিসায় যারা আসছেন, তাদের ক্ষেত্রে কোম্পানির কোনো দায় থাকছে না। তারা তিনমাস পর পছন্দ না হলে ওই শ্রমিককে ফিরিয়ে দিচ্ছে।

তিনি বলেন, একটি খেজুর ফ্যাক্টরিতে লোক নেওয়ার কথা বলে একশ বাংলাদেশিকে এখানে আনা হয়। তাদেরকে চারটি বিল্ডিংয়ে রাখা হয়। পরদিন একটি গোডাইনে নিয়ে তাদের কয়েক বস্তা খেজুর প্যাকিং করানো হয়।

এরপর তারা গ্রামের বাড়ি ফোন করে জানিয়ে দেন, কাজে যোগ দিয়েছেন। স্বজনরা চুক্তি অনুযায়ী দালালদের বকেয়া ৪ হাজার দিরহাম পরিশোধ করেন। এরপরই কারখানাও নেই, দালালদেরও কোনো খবর নেই। এখন এই একশ লোক না খেয়ে চরম মানবেতর জীবন কাটাচ্ছেন।

সাদ্দাম হোসেন নামে এক প্রবাসী বলেন, এখানে কর্মস্থলের চেয়ে শ্রমিকের সংখ্যা বেশি হয়ে গেছে। কোম্পানিগুলোর চাহিদার তুলনায় কয়েক লাখ বেশি লোক এখানে অবস্থান করছেন। এছাড়া প্রতিদিনই আরো শত শত লোক কাজের সন্ধানে দুবাই প্রবেশ করছেন। ফলে ধীরে ধীরে পরিস্থিতি ভয়াবহ রূপ নিচ্ছে।

তিনি আরো বলেন, গত এক সপ্তাহে তাদের কোম্পানির দেড় শতাধিক বাংলাদেশিকে চাকরিচ্যুত করা হয়েছে। অনেকের বেতন কমিয়ে অর্ধেক করা হয়েছে। আবার কোনো কোনো কোম্পানি ২/৩ মাস বেতন দিচ্ছে না। ফলে অনেকে চাকরি ছেড়ে দিতে বাধ্য হচ্ছেন।

রাস্তার পাশে ফুটপাথে বসে সবজি বিক্রি করেন আবদুল আলিম। গ্রামের বাড়ি যশোরের নাভারন এলাকায়। তিনি বলেন, গত ৭ বছর ধরে তিনি দুবাই আছেন। এ রকম বাজে পরিস্থিতিতে কখনো পড়েননি।

অধিকাংশ কোম্পানিতেই কাজ নেই। কাজ না পেয়ে তাই সামান্য থাকা-খাওয়া নিশ্চিত করতে সন্ধ্যায় সবজি নিয়ে বসে পড়েন দুবাইয়ের রাস্তায়। যা আয় হয়, তা দিয়ে কোনোভাবে দিনাতিপাত করছেন তিনি।

বাংলাদেশ দূতাবাসের দুবাই কনস্যুলেট জেনারেল বিএম জামাল হোসেন বলেন, প্রবাসী বাংলাদেশিদের সমস্যা সমাধানে নানা কর্মসূচি নেওয়া হচ্ছে। এরমধ্যে দুয়ারে কনস্যুলার নামে একটি কর্মসূচি চালু করা হয়েছে।

এ কর্মসূচির আওতায় দূতাবাসের লোকজন বিভিন্ন এলাকায় গিয়ে শ্রমিকদের নিয়ে বৈঠক করছেন। তাদের সমস্যার কথা শুনছেন। দূতাবাসের সাধ্যমতো সমস্যার সমাধান করার চেষ্টা চলছে।

তিনি বলেন, দূতাবাসের একার পক্ষে এ সমস্যার সমাধান করা সম্ভব নয়। সবার আগে দুবাইগামীদের সচেতন হতে হবে। কর্মস্থল নিশ্চিত না করে দুবাই প্রবেশ না করার অনুরোধ করেন তিনি।