logo
আপডেট : ২১ জুন, ২০২২ ১১:১৬
বন্যা পরিস্থিতি
বিশুদ্ধ পানি ও খাবার সংকট
রুদ্র মিজান

বিশুদ্ধ পানি ও খাবার সংকট

চারদিকে হাহাকার। খাবার নেই। বিশুদ্ধ পানি নেই। ঘুম নেই। কষ্টের শেষ নেই বানভাসি মানুষের। সিলেটের কয়েক উপজেলাসহ পুরো সুনামগঞ্জ জেলার একই অবস্থা। ক্ষুধায় শিশুরা কাঁদছে। খেয়ে না-খেয়ে মানবেতর দিনাতিপাত করছে ঘরহারা মানুষগুলো। বন্যার পানি গত দুদিন যাবত কমতে শুরু করলেও এখনো ৮০ ভাগ বাড়িঘর পানির নিচে। সর্বনাশা বন্যা কেড়ে নিয়েছে সর্বস্ব। পানিতে ভেসে গেছে গোলাভরা ধান, রান্নার হাড়ি, পরনের কাপড়, আসবাবপত্র। এই অবস্থায় ত্রাণের জন্য তাকিয়ে আছে হাওর অঞ্চলের মানুষ। নীরবে কান্না করছেন তারা। অন্ধকার দেখছেন দু’চোখে। সুনামগঞ্জের দিরাই, শাল্লা, তাহিরপুর, বিশম্ভরপুর উপজেলায় এখনো উল্লেখযোগ্য ত্রাণসামগ্রী পৌঁছায়নি।

 

সুনামগঞ্জের দিরাই উচ্চ বিদ্যালয়, বালিকা উচ্চ বিদ্যায় ও থানা রোডস্থ জালাল সিটি নামক একটি মার্কেটে আশ্রয় নিয়েছে হাজার হাজার মানুষ। গাদগাদি করে সেখানে থাকছেন তারা। শুকনো খাবার কিনে খাচ্ছেন। মাঝে-মধ্যে ব্যক্তিগতভাবে কেউ কেউ খাবার পৌঁছে দিচ্ছেন। কিন্তু তা মোটেও পর্যাপ্ত না। কেরোসিনের চুলায় রান্না করছেন কেউ কেউ। বেশির ভাগেরই জুটছে না খাবার। জালাল মার্কেটে দুই শিশু সন্তানকে নিয়ে আশ্রয় নিয়েছেন দিবা রাণী।

 

তিনি জানান, কালনী নদী-তীরবর্তী চাঁদপুরে তাদের বাড়ি। বন্যার পানিতে ঘর ডুবে গেছে। ঘরের ভেতরের আসবাবপত্র, রান্নার চুলা, পরনের কাপড় সব পানিতে ভেসে গেছে। অল্প সময়ের মধ্যেই পানিতে তলিয়ে গেছে ঘরটি। কোনোভাবে দুই সন্তানকে নিয়ে স্বামী-স্ত্রী দুজন এখানে আশ্রয় নিয়েছেন। কথা বলার সময় তার কোলে থাকা পাঁচ বছর বয়সী শিশু সন্তান কান্না করছিল। খাবারের অভাবে কাঁদছে শিশুটি। হাতে একটি বিস্কুট তোলে দিলে তাতে সন্তুষ্ট হয়নি। ভাত খেতে চায়। কোনোভাবেই তার কান্না থামানো যাচ্ছিল না। এরকম দৃশ্য দেখা গেছে প্রায় প্রতিটি আশ্রয়কেন্দ্রে।

 

পানি কমলেও ঘরের ভেতরে কয়েক ফুট পানি এখনো আছে দিরাই উপজেলার ইসলামপুরে। ওই গ্রামের বেশিরভাগ মানুষ হতদরিদ্র। ঘরের ওপরে মাচা তৈরি করে রয়েছেন তারা। আশপাশের লোকজনের দেওয়া খাবার সন্তানদের মুখে তোলে দিলেও প্রাপ্তবয়স্করা রয়েছেন খেয়ে না-খেয়ে। সিরাজ মিয়া জানান, গত তিন ধরে ভাত দেখেননি চোখে। মুড়ি খেয়ে খেয়ে আছেন। এখন তাও নেই। ওই গ্রামে কোনো সরকারি ত্রাণ পৌঁছেনি। একই অবস্থা দিরাই উপজেলার জগদল ইউনিয়নের রাজনগর, মাতারগাঁও, ভাটিরগাঁও, তাড়লের ভাঙ্গাডহর, সন্তোষপুর, নোয়াগাঁও, বাউসি গ্রামে।

 

দিরাই উপজেলার রাধানগর গ্রামের নুরুল আমিন বলেন, উপজেলার কোনো গ্রামের অবস্থাই ভালো নেই। গরিব-ধনী সবার অবস্থা একই। সুনামগঞ্জ সদরের এইচএমপি উচ্চ বিদ্যালয়, সরকারি জুবিলি উচ্চ বিদ্যালয়ে আশ্রয় নিয়েছে বিপুল মানুষ। একইভাবে সদরের জানিগাঁও গ্রামের জমিরুন নুর উচ্চ বিদ্যালয়ের পাঁচ তলা ভবনে গাদাগাদি করে থাকছেন বন্যার্তরা। শহরে মাঝে-মধ্যে ত্রাণ পৌঁছালেও খাদ্য সঙ্কট চরম আকার ধারণ করেছে গ্রামে। নৌকা সঙ্কটের কারণে গ্রামের সঙ্গে যোগাযোগ কম হচ্ছে। দক্ষিণ সুনামগঞ্জের ঠাকুরভোগ গ্রামের হুমায়ূন কবির সুমন জানান, মানুষ খেয়ে না-খেয়ে বেঁচে আছে। রান্নার সুযোগ কম। শুকনো খাবারও জুটছে না।

 

দক্ষিণ সুনামগঞ্জের উজানিগাঁও’র বাসিন্দা খালেদ আহমদ জানান, গ্রামে গত শনিবার থেকেই রান্নার আয়োজনের চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছি। রান্না করার মতো শুকনো জায়গা নেই। এখন পানি কমছে। রান্না করার মতো জায়গা থাকলেও সেভাবে ত্রাণ পৌঁছানো যাচ্ছে না। যোগাযোগ ব্যবস্থার কারণে। নৌকা সঙ্কট। এলাকার বাজারগুলোতে পড়েছে বন্যার প্রভাব। প্রায়ই দোকানেই ঢুকেছে বন্যার পানি। নষ্ট হয়েছে পণ্য। পূর্ব দিরাইয়ের বাসিন্দা এস আর সুমন জানান, তিনি ত্রাণ দিতে প্রস্তুতি নিয়েছেন। কিন্তু বাজারের এক দোকানে সব পাওয়া যাচ্ছে না। ব্যবসায়ীরা জানান, বন্যার কারণে নতুন করে পণ্য আনা হয়নি। যা ছিল তা অনেকটাই নষ্ট হয়েছে।

 

ছাতকের বাসিন্দা এনামুল হক জানান, পানি কমার কারণে সিলেট থেকে গোবিন্দগঞ্জ, পাগলা হয়ে মদনপুর পর্যন্ত যাওয়া যায়। তারপর দিরাই, শাল্লা, সুনামগঞ্জ, বিশম্ভরপুর, তাহিরপুর যেতে প্রয়োজন নৌকার। দিরাই সদরে যেতে অন্তত ৩০ কিলোমিটার নৌকায় যেতে হয়। তা ছাড়া জেলাজুড়েই এক গ্রাম থেকে অন্য গ্রামে যেতে নৌকার বিকল্প নেই। যে কারণে ব্যক্তিগতভাবে ইচ্ছে থাকলেও অনেকে সহজে ত্রাণ পৌঁছাতে পারছেন না। জগন্নাথপুরের রুহুল আমিন খান ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, এ দুর্যোগ মোকাবিলায় প্রশাসন এখন পর্যন্ত সফলতা দেখাতে পারেনি। এখনো প্রত্যন্ত অঞ্চলে সরকারি সহযোগিতা পৌঁছেনি বলে অভিযোগ করেন তিনি। তবে সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী ও ফায়ার সার্ভিসকর্মীদের তৎপরতার প্রশংসা করেন এই যুবক।

 

সিলেট, সুনামগঞ্জে বন্যার পানি কমলেও বাড়ছে সিলেট বিভাগের হবিগঞ্জে ও মৌলভীবাজারে। এছাড়া উত্তর ও মধ্যাঞ্চলের বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হতে পারে বলে জানিয়েছে বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের (বাপাউবো) বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র। অন্যদিকে দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের চট্টগ্রাম বিভাগের নদীগুলোর পানি বাড়ছে বলেও জানিয়েছে সংস্থাটি। তথ্যানুসারে দেশের ১১টি জেলা বন্যাকবলিত হয়েছে।

 

বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. আরিফুজ্জামান ভূঁইয়া জানান, হবিগঞ্জ, লালমনিরহাট, নীলফামারী, রংপুর, কুড়িগ্রাম, গাইবান্ধা, বগুড়া, সিরাজগঞ্জ, জামালপুর ও টাঙ্গাইল জেলার বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হতে পারে। মৌলভীবাজার জেলার নিম্নাঞ্চলে বন্যা দেখা দিয়েছে। জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে এরই মধ্যে ৯৮টি আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়েছে। এতে ১৫ হাজার মানুষ আশ্রয় নিয়েছেন।

 

সুনামগঞ্জে গতকাল পর্যন্ত বন্যাদুর্গতদের জন্য সরকারের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় কর্তৃক বরাদ্দ ছিল ১ কোটি ৪৮ লাখ টাকা। সিলেটে ছিল ১ কোটি ৬৩ লাখ টাকা। মৌলভীবাজারে ১০ লাখ ও হবিগঞ্জে ১০ লাখ টাকা। নেত্রকোনায় ৩০ লাখ। কুড়িগ্রামে ১০ লাখ টাকা।

 

ভোরের আকাশ/আসা