স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যার কবলে সিলেট বিভাগের চার জেলা। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত সিলেট ও সুনামগঞ্জ। উজানে রেকর্ড বৃষ্টিপাতের কারণে এবার ভাটির জেলাগুলোতে বন্যার ভয়াবহতা অনেক বেশি।
বলা হচ্ছে, বিগত ৫০ বছরের কেকর্ড ছাড়িয়েছে এবারের বান। ধীরে ধীরে পানি নামতে থাকায় দৃশ্যমান হচ্ছে সড়ক, মহাসড়ক, সেতু ও কালভার্টের ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ।
সিলেট সদরের সঙ্গে এখনো বিচ্ছিন্ন কয়েকটি উপজেলার সড়ক যোগাযোগ। ছাতক, দোয়ারাবাজার, বিশ^ম্ভরপুর, তাহেরপুর ও জামালগঞ্জের সঙ্গে এখনো সুনামগঞ্জের সড়ক যোগাযোগ স্বাভাবিক হয়নি।
সড়ক বিভাগ ও এলজিইডি সূত্রে জানা গেছে, সিলেটের সড়ক বিভাগের প্রায় ১২৫ কিলোমিটার সড়ক তলিয়ে যাওয়া প্রাথমিকভাবে ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে শত কোটি টাকা।
আর সুনামগঞ্জে সড়ক বিভাগ ও এলজিইডি মিলিয়ে আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ আনুমানিক প্রায় ৭০০ কোটি টাকা। এই জেলায় ২২’শ কিলোমিটার সড়ক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। হবিগঞ্জে ক্ষতিগ্রস্ত সড়ক ৩৩৪ কিলোমিটার।
এ জেলায় আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ ৮০ কোটি টাকা। সব মিলিয়ে তিন জেলায় ক্ষতিগ্রস্ত সড়ক প্রায় দুই হাজার ৭০০ কিলোমিটার। প্রাথমিকভাবে আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ৯০০ কোটি টাকা। তবে বন্যা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে ক্ষতির পরিমাণ আরো বাড়বে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
সিলেটে তলিয়েছে ১২৫ কিলোমিটার সড়ক। সলেটের সড়ক ও জনপথ বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী মোস্তাফিজুর রহমান জানান, বন্যায় সিলেটে সড়ক ও জনপথ বিভাগের প্রায় ১২৫ কিলোমিটার সড়ক তলিয়ে গেছে।
এতে ক্ষতির পরিমাণ ১০০ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে। তবে জেলায় এলজিইডির রাস্তা সবচেয়ে বেশি। এই প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে এখনো আর্থিক ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ হিসাব করা হয়নি বলে জানা গেছে। তবে অনুমান করা হচ্ছে সড়ক বিভাগের থেকে এলজিইডির আর্থিক ক্ষতি কয়েক গুণ বেশি হতে পারে।
বন্যার পানি নামলেও এখন পর্যন্ত সিলেট-কোম্পানীগঞ্জ মহাসড়কে যান চলাচল শুরু হয়নি। তেলিখালে একটি সেতুতে ফাটল ধরেছে। দেবে গেছে কোম্পানীগঞ্জ থানা বাজার এলাকার আরেকটি সেতুর এপ্রোচ সড়ক। এতে ওই সড়ক দিয়ে বন্ধ রয়েছে যান চালচল।
বুধবার থেকে ক্ষতিগ্রস্ত সেতুগুলো সংস্কারে কাজ করছে সেনাবাহিনী ও সড়ক বিভাগ। বুধবার থেকেই এই সড়কে যান চলাচল শুরু করার কথা জানিয়েছেন সড়ক বিভাগের কর্মকর্তারা।
সড়ক থেকে পানি নামলেও কোম্পানীগঞ্জ এখনও বিচ্ছিন্ন আছে জানিয়ে এই উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা লুসিকান্ত হাজং বলেন, কোম্পানীগঞ্জ সড়কের কিছুটা পথে গাড়ি আসছে। সেতু ভেঙে যাওয়ায় এরপর আর আসছে না।
সড়ক বিভাগের কর্মকর্তারা বলছেন, ভয়াবহ বন্যায় পানিতে তলিয়ে গেছে সিলেটের বেশির ভাগ সড়ক। বন্যায় জেলার সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত উপজেলা কোম্পানীগঞ্জ। সিলেট-কোম্পানীগঞ্জ মহাসড়ক তলিয়ে যাওয়ায় যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে এই উপজেলা।
তারা বলছেন, এখন সড়কগুলো থেকে পানি নামতে শুরু করেছে। তবে পানি নামার সঙ্গে সঙ্গে ভেসে উঠছে ক্ষয়ক্ষতির চিত্র। পানি উঠে অনেক সড়কে ভাঙন দেখা দিয়েছে। কার্পেটিং উঠে গেছে প্লাবিত প্রায় সব সড়কের। সড়ক ও সেতুর এপ্রোচ সড়কেও দেখা দিয়েছে ধস।
সড়ক বিভাগের কর্মকর্তারা জানান, বন্যায় তলিয়ে যায় সিলেট-সুনামগঞ্জ এবং সিলেট-কোম্পানীগঞ্জ আঞ্চলিক মহাসড়ক। পানি নেমে যাওয়ায় বুধবার থেকে সিলেট-
সুনামগঞ্জ মহাসড়কে যান চলাচল শুরু হয়েছে। তবে পানির তোড়ে এই সড়কে তৈরি হয়েছে খানাখন্দ ও বড় বড় গর্তের।
জানা গেছে, বন্যায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে কানাইঘাট, গোয়াইনঘাট ও কোম্পানীগঞ্জ উপজেলায়।
বন্যায় ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ এখনো চূড়ান্ত নিরূপণ করা হয়নি জানিয়ে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল বিভাগ (এলজিইডি) সিলেটের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. ইনামুল কবির বলেন, আমাদের সড়কগুলো এখনো পানিতে তলিয়ে আছে। পানি না নামলে ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণ করা যাবে না।
সুনামগঞ্জে ক্ষতিগ্রস্ত ২২’শ কিলোমিটার সড়ক : বন্যায় সুনামগঞ্জের ৯০ ভাগ এলাকা তলিয়ে যাওয়ায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে প্রায় ২২শ কিলোমিটার সড়ক। এর মধ্যে সড়ক ও জনপথের ১৮৪ কিলোমিটার এবং বাকি দুই হাজার কিলোমিটার এলজিইডির আওতাধীন বলে জানিয়েছে কর্তৃপক্ষ। জেলার বিভিন্ন এলাকায় পানি কমতে থাকায় দৃশ্যমান হচ্ছে বন্যার বিভিন্ন ক্ষয়ক্ষতির চিত্র।
সুনামগঞ্জ স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. মাহবুব আলম জানান, কিছু স্থানে বন্যার পানি নামায় দৃশ্যমান হয়েছে সড়কগুলো। তবে জলমগ্ন পিচঢালা সড়কে যানবাহন চলাচলে ক্ষতি আরো বাড়ছে।
রাস্তার বিটুমিন উঠে গিয়ে তৈরি হচ্ছে বড় বড় গর্ত। পানির তোড়ে ভেসে গেছে গ্রামীণ সড়কের অনেক ব্রিজ ও কালভার্ট। এ কারণে জেলা সদর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে আছে উপজেলাগুলো।
সুনামগঞ্জ সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের নির্বাহী প্রকৌশলী আশরাফুল ইসলাম প্রামাণিক বলেন, বেশির ভাগ সড়ক এখনো পানির নিচে ডুবে থাকায় ক্ষয়ক্ষতির সঠিক পরিমাণ নিরূপণ করা যাচ্ছে না। পানি পুরোপুরি নামার পরেই শুরু হবে সড়ক মেরামতের কাজ।
সুনামগঞ্জ সড়ক ও জনপথ বিভাগের তথ্য অনুযায়ী বন্যায় সুনামগঞ্জের ৯টি সড়ক তলিয়ে গিয়েছিল। পানিতে ডুবে গিয়েছিল সুনামগঞ্জ সড়কের ৪৬ কিলোমিটার,
তাহিরপুর সড়কের ১৭ কিলোমিটার, শাল্লা-জরসোকা সড়কের ২২ কিলোমিটার, নিয়ামতপুর-কাছিরগাতি-বিশ্বম্ভরপুর সড়কের ১৭ কিলোমিটার, সুনামগঞ্জ-জামালগঞ্জ সড়কের ১৮ কিলোমিটার, গোবিন্দগঞ্জ-ছাতক সড়কের ২৭ কিলোমিটার, মদনপুর-দিরাই-শাল্লা সড়কের ৪৬ কিলোমিটার ও পাগলা-রানীগঞ্জ-আউশকান্দী সড়কের ৩৬ কিলোমিটার পানিতে ডুবে বিটুমিনের ক্ষতি হয়েছে।
আশরাফুল ইসলাম প্রামাণিক বলেন, বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হওয়ার পর ক্ষয়ক্ষতির সঠিক তথ্য পাওয়া যাবে। প্রথম দফা বন্যায় বেশ কয়েকটি সড়কের অন্তত ৭৫-৮০ কিলোমিটার সড়কের প্রায় ৬৭ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছিল।
দ্বিতীয় দফা বন্যায় সব কটি সড়ক তলিয়ে গিয়েছিল এবং পাহাড়ি ঢলের তোড়ে আরও ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। ধারণা করা হয় প্রাথমিকভাবে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ৩০০ কোটি টাকা ছাড়াতে পারে।
মাহবুব আলম বলেন, ‘বন্যার পর সড়ক থেকে পানি নামার পর ক্ষয়ক্ষতির সঠিক তথ্য জানা যাবে। তবে দুই দফা বন্যায় সুনামগঞ্জের সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে গ্রামীণ রাস্তাঘাটের।
প্রথম দফা বন্যায় ২৫০টি সড়কের ৫০০ কিলোমিটার সড়ক ও ৮টি সেতু-কালভার্টের প্রায় ২০০ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছিল। সেই ক্ষতির হিসাবের সঙ্গে দ্বিতীয় দফার ভয়াবহ বন্যায় সড়কের দ্বিগুণ ক্ষতি হয়েছে।
এলজিইডি সূত্রে জানা গেছে, প্রথম দফা বন্যায় অন্তত ২৫০টি সড়কের ৫০০ কিলোমিটার সড়ক ও ৮টি সেতু-কালভার্টের প্রায় ২০০ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছিল। সেই ক্ষতির হিসাব ও বরাদ্দ অনুমোদনের জন্য কর্তৃপক্ষের কাছে চিঠি পাঠানোর মাথায় দ্বিতীয় দফা ভয়াবহ বন্যা পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়ে সড়কের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে।
সুনামগঞ্জের এলজিইডির কর্মকর্তা মিজান রহমান বলেন, শুধুমাত্র সড়কের ক্ষতি হয়েছে তা, নয়। সেতু, কালভার্ডসহ সব ধরনের সড়কের স্থাপনার ক্ষতি হয়েছে। সঠিক ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণ করতে আরেকটি সময় লাগবে।
কারণ হলো বেশ কয়েকটি উপজেলার সঙ্গে সুনামগঞ্জ সদরের সড়ক যোগাযোগ এখনো বিচ্ছিন্ন। তিনি বলেন, আমরা নিজেদের জায়গা থেকে সড়ক মেরামত ও ক্ষতির পরিমাণ তুলে আনার চেষ্টা করছি। সবকিছু চূড়ান্ত হলে অর্থ বরাদ্দ চেয়ে ঢাকায় সদর দপ্তরে পাঠানো হবে বলে জানান এই কর্মকর্তা।
হবিগঞ্জে ক্ষতিগ্রস্ত ৩৩৪ কিলোমিটার পাকা সড়ক : বন্যায় হবিগঞ্জ জেলার ৩৩৪ কিলোমিটার পাকা সড়ক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত সড়কের মধ্যে এলজিইডির অধীন ৩১০ কিলোমিটার এবং সওজ বিভাগের অধীন ২৪.২ কিলোমিটার। সড়কের প্রাথমিক ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ৮০ কোটি টাকা।
এলজিইডির নির্বাহী প্রকৌশলী মো. আবদুল বাছির জানান, জেলায় এলজিইডির অধীন মোট ১৮৩৫ কিলোমিটার পাকা সড়ক রয়েছে। এর মধ্যে ৩১০ কিলোমিটার সড়ক বন্যার পানিতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। প্রাথমিক হিসাবে ক্ষতির পরিমাণ ৬৯ কোটি টাকা হবে।
সওজ বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী শাকিল মোহাম্মদ ফয়সাল জানান, সওজ বিভাগের অধীন হবিগঞ্জ-বানিয়াচং-আজমিরীগঞ্জ সড়কের ৮ কিলোমিটার, বানিয়াচঙ্গ-নবীগঞ্জ সড়কের ৬ কিলোমিটার, পাগলা-জগন্নাথপুর-রানীগঞ্জ-আউশকান্দি সড়কের হবিগঞ্জ অংশে সাড়ে ১০ কিলোমিটার মধ্যে ৪ কিলোমিটার সড়ক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। প্রাথমিকভাবে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ১০ কোটি টাকা।