logo
আপডেট : ২৬ জুন, ২০২২ ১০:২৭
স্বপ্নের পদ্মা সেতু
৫০ বছর পর দেশে নিরবচ্ছিন্ন যোগাযোগব্যবস্থার মাইলফলক
শাহীন রহমান

৫০ বছর পর দেশে নিরবচ্ছিন্ন যোগাযোগব্যবস্থার মাইলফলক

আহবমানকাল থেকে নদী দ্বারা বেষ্টিত এই ভূখণ্ড নানা অংশে বিভক্ত ছিল। ফলে মানুষের এক স্থান থেকে অন্য স্থানে যাতায়াত ছিল দুরূহ। নদীমাতৃক এই দেশে নদীগুলো জালের মতো বিছিয়ে আছে। স্বাধীনতার পরও ৫৫ হাজার বর্গমাইলের এই দেশে যোগাযোগব্যবস্থা ছিল প্রায় বিচ্ছিন্ন। এসব অংশের সঙ্গে যোগাযোগের জন্য সনাতনী ব্যবস্থাই ছিল একমাত্র উপায়। নৌ-যোগাযোগের মাধ্যমে এক অংশের সঙ্গে অন্য অংশের যোগাযোগ রক্ষা হতো। কিন্তু পদ্মা সেতু নির্মাণের পর সেই বিচ্ছিন্নতাও ঘুচেছে ৫০ বছর পর।

 

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, স্বাধীনতার ৫০ বছরেও এক অর্থে বাংলাদেশ যেন দুটি বিচ্ছিন্ন ভূখণ্ডই ছিল। মেঘনা ও পদ্মা নদীর কারণে ঢাকা বিভাগের পাঁচ জেলার পাশাপাশি পুরো বরিশাল ও খুলনা বিভাগ সড়কপথে বিচ্ছিন্ন ছিল রাজধানীসহ দেশের ৪৩ জেলা থেকে। পদ্মা সেতুর মাধ্যমে ওই দুই বিভাগের ২১ জেলা এখন যুক্ত হচ্ছে বাকি বাংলাদেশের সঙ্গে। তারা বলেন, এরই মধ্যে সংযুক্তির করিডরে একটি এক্সপ্রেসওয়েও নির্মিত হয়েছে। যা ২০২০ সালে উদ্বোধনও করা হয়েছে। এক্সপ্রেসওয়ের দুটি অংশ। যাত্রাবাড়ী-মাওয়া এবং পাঁচ্চর-ভাঙ্গা। পদ্মা সেতু এখন এই দুই অংশকে পরস্পরের সঙ্গে যুক্ত করছে।

 

খরস্রোতা পদ্মা নদীর ওপর দিয়ে নানা কারিগরি, প্রযুক্তিগত, অর্থনৈতিক আর কূটনৈতিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে সেতু তৈরি করেছে বর্তমান সরকার। তাই এই সেতু উদ্বোধনের ঐতিহাসিক ক্ষণকে ঘিরে নানা আয়োজনে উদযাপিত হচ্ছে আজকের এই মাহেন্দ্রক্ষণ।

 

তবে দৌলতদিয়া-পাটুরিয়ায় সেতু না থাকায় অখণ্ড ভূখণ্ডের এক ধরনের অপূর্ণতা রয়েছে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। বিআইডাব্লিউটিসির পরিচালক এস এম আশিকুজ্জামানের মতে, পাটুরিয়া -দৌলতদিয়া দিয়ে প্রতিদিন ১০-১২ হাজার গাড়ি যাওয়া-আসা করে। এর মধ্যে বাস আছে গড়ে ১২শ থেকে ১৩শ। ফলে এখানে সেতু না থাকায় দেশে বিশাল জনগোষ্ঠীর মধ্যে এখনো এক ধরনের অপূর্ণতা রয়েছে। তবে এখানেও সেতুর আশ^াস মিলেছে। সম্প্রতি সংসদে প্রশ্নোত্তর পর্বে সেতু বিভাগের আওতায় দৌলতদিয়া-পাটুরিয়ায় দ্বিতীয় পদ্মা সেতু নির্মাণের লক্ষ্যে সম্ভাব্যতা সমীক্ষা করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন সড়ক পরিবহণ ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। বলেছেন নির্দেশনা পাওয়া গেলে বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

 

ওবায়দুল কাদের বলেন, ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর পদ্মা সেতু প্রকল্পকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেয় এবং বাংলাদেশ সরকারের নিজস্ব অর্থায়নে ৩০ হাজার ১৯৩ কোটি টাকা প্রাক্কলিত ব্যয় ধরে ভায়াডাক্টসহ ৯.৮৩ কিলোমিটার দীর্ঘ এই সেতুর নির্মাণকাজ শুরু করে।

 

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিশে^র খরোস্রোতা নদীর মধ্যে অন্যতম হলো এই পদ্মা নদী। যার উৎপত্তি গঙ্গার উৎপত্তি হিমালয়ের গঙ্গোত্রী হিমবাহ থেকে, যা সমুদ্র থেকে প্রায় সাত হাজার মিটার উঁচুতে। উৎপত্তির পর নদীটি ২ হাজার ৫২০ কিলোমিটার পাড়ি দিয়ে বঙ্গোপসাগরে মিশেছে। পদ্মা পৃথিবীর সবচেয়ে ভাঙনপ্রবণ নদী হিসেবে পরিচিত। আর এই খরস্রোতা পদ্মা পারাপার দেশের মধ্যভাগ ও পূর্বাঞ্চলের সঙ্গে দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের নিরবচ্ছিন্ন যোগাযোগে বড় বাধা ছিল। যানবাহন পারাপারের মাধ্যম ফেরি। মানুষ পারাপারের মাধ্যম লঞ্চ, ট্রলার, স্পিডবোট অথবা নৌকা। বর্ষায় পদ্মা যখন ভয়ংকর রূপ নেয়, তখন ছোট নৌযানে নদীটি পাড়ি দেয়া অনেকটা প্রাণ হাতে নেওয়ার মতো। আর ফেরিঘাটে সারা বছর মানুষকে ভুগতে হয়েছে যানবাহনের দীর্ঘ লাইনে। সেই দুর্ভোগ লাঘব করছে স্বপ্নের এই পদ্মা সেতু।

 

তবে এই সেতুর ওপর ব্রিজ করা সহজ সাধ্য ছিল না। এই নদীতে প্রবাহিত পানির পরিমাণ, নদীর গভীরতা ও প্রশস্ততা এবং তলদেশে মাটির ধরন এসব কিছুর কারণে এর ওপর সেতু নির্মাণ করা ছিল অসম্ভব রকমের কঠিন এক কাজ। শেষ পর্যন্ত এই অসম্ভব কাজটিই সম্ভব হয়েছে। প্রায় আট বছরের নির্মাণকাজ শেষে এই সেতু উদ্বোধন হচ্ছে আজ শনিবার। পদ্মা সেতু নির্মাণ প্রকল্পের সঙ্গে জড়িত দেশে বিশিষ্ট নদী বিশেষজ্ঞ ড. আইনুন নিশাত বলেন, এই পদ্মা সেতু নির্মাণ করতে গিয়ে ধাপে ধাপে অনেক জটিলতা তৈরি হয়েছে। সেসব সামাল দিতে পরিবর্তন করতে হয়েছে সেতুর নকশাও। প্রায় নয় কিলোমিটার দীর্ঘ এই সেতু নির্মাণে বিশ্বের অত্যাধুনিক সব প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়েছে।

 

দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের মানুষের দীর্ঘদিনের স্বপ্ন পদ্মা সেতু চালু হচ্ছে আজ। দীর্ঘদিন ধরে মানুষের অপেক্ষার প্রহর শেষ হচ্ছে। এখন অপেক্ষা স্বপ্ন ডানা মেলার। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সেতুটি চালু হলে যানবাহনের চাপ কমবে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের আরেক প্রবেশদ্বার পাটুরিয়া-দৌলতদিয়া নৌ-রুটে। এতে ঘাটে যানজট আর আর যাত্রী ভোগান্তি কমবে। ফলে এ নৌ-রুটেও স্বস্তি ফেরাবে পদ্মা সেতু।

 

যাত্রী ও পরিবহণ শ্রমিকরা জানান, ঘনকুয়াশা, তীব্র স্রোত, নাব্য, ঘাট ও ফেরি সংকটসহ নানা কারণে বছরজুড়েই পাটুরিয়া-দৌলতদিয়া নৌ-রুটে দুর্ভোগ ও ভোগান্তি লেগেই থাকে। ঈদসহ বিভিন্ন উৎসবে যানবাহনের চাপ বাড়লে দুর্ভোগ পৌঁছে চরমে। পদ্মা সেতু চালুর পর ঘাটের এ চিত্র আর নাও দেখা যেতে পারে।