অপেক্ষার পালা শেষ। বাকি আর মাত্র ২৪ ঘণ্টা। আগামীকাল সকালেই দ্বার খুলছে বহুল কাক্সিক্ষত পদ্মা সেতু। পরদিন যানবাহন চলাচলের জন্য বিশে^র ১১তম দীর্ঘ এ সেতু উন্মুক্ত করে দেওয়া হবে। ইতোমধ্যে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে সেতু বিভাগকে পদ্মা সেতু আনুষ্ঠানিক বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে। এ সেতু হবে না, হলেও টিকবে না- ছিল এমন নানা কথামালা আর ডালপালা মেলছিল নানা গুজব। এসব কঠিন পথ পেরিয়েই পদ্মার দুই পাড় বাঁধল ৬ কিলোমিটার দীর্ঘ সেতু। দক্ষিণাঞ্চলের সঙ্গে জোড়া লাগল রাজধানী।
এদিকে পদ্মা সেতুর উদ্বোধনী অনুষ্ঠান প্রচারে জেলায় জেলায় নেওয়া হয়েছে বিশেষ ব্যবস্থা। বড় ডিজিটাল পর্দায় জেলা-উপজেলায় সেতু উদ্বোধন প্রচার করা হবে। সেতু উদ্বোধনকে কেন্দ্র করে দক্ষিণের ২৯ জেলার মানুষের মধ্যে বইছে আনন্দ উচ্ছ্বাস। সেতুর দুই পাড় ঘিরে এখন সাজসাজ রব। ইতোমধ্যে পুরো এলাকা ছবি, লাইট দিয়ে সাজানোর কাজ শেষ পর্যায়ে। সবাই অধীর আগ্রহে আছেন, কখন সেতু উদ্বোধন হবে। চলবে যানবাহন। তাছাড়া সারা দেশে পদ্মা সেতু উদ্বোধনকে কেন্দ্র করে বাড়তি উৎসাহ উদ্দীপনার যেন শেষ নেই। সাড়ে তিন হাজার অতিথির মধ্যে বিতরণ করা হয়েছে আমন্ত্রণপত্র। বিএনপিসহ ড. মুহম্মদ ইউনূসকেও আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। বিদেশি সংসদ সদস্য, বিচারপতি, কূটনীতিক, বিশিষ্টজন, শিক্ষক, প্রকৌশলী, আইনজীবী, বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতা থেকে শুরু করে সব শ্রেণি পেশার আমন্ত্রিত অতিথিরা অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকবেন। ঢাকাসহ বিভিন্ন জেলার ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীরাও ইতিহাসের সাক্ষী থাকতে সমাবেশে যোগ দেওয়ার প্রস্তুতি নিয়েছেন।
উদ্বোধন উপলক্ষে মাদারীপুরের জনসভামঞ্চও ইতোমধ্যে প্রস্তুত হয়েছে। সেতুর আদলে নির্মাণ করা হয়েছে মঞ্চ। মঞ্চের সামনে থাকবে ভাসমান নৌকা। উদ্বোধনের কর্মসূচি সফল করতে হলিকপ্টারসহ কয়েকস্তরের নিরাপত্তা জোড়দার করা হয়েছে। সমাবেশে ১০ লাখ মানুষের সমাগম ঘটবে এমন প্রস্তুতিই নেওয়া হয়েছে। ইতোমধ্যে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতাদের উপস্থিতিতে কয়েক দফা প্রস্তুতিমূলক বৈঠক হয়েছে জনসভাস্থলে। কর্মসূচি সফল করতে যার যার দায়িত্ব তা বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে। আগামীকাল সেতুর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে যোগ দেওয়ার কথা রয়েছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার। করোনা মহামারির সময়ে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে ভার্চুয়ালি যোগ দিলেও আবেগের এ সেতুর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে সরাসরি উপস্থিত থাকবেন তিনি। পদ্মা সেতু নিরাপত্তার মূল দায়িত্বে নিয়োজিত রয়েছে সেনাবাহিনী। অনুষ্ঠানের দিন সকাল ১০টায় হেলিকপ্টারযোগে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পদ্মা সেতুর মাওয়া প্রান্তে এসে উপস্থিত হবেন। মাওয়া প্রান্তে সেতুর উদ্বোধনী ফলক উন্মোচন করবেন ও সুধী সমাবেশে অংশ নেবেন তিনি। পরবর্তীতে সেখান থেকে সেতু পার হয়ে শরীয়তপুর অংশে দলীয় একটি জনসভায় অংশ নেবেন। এছাড়া সেতুর দুই পাড়ে দুটি ম্যুরাল উদ্বোধন করবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
উদ্বোধনী অনুষ্ঠানকে কেন্দ্র করে নৌপুলিশ এরই মধ্যে অনুষ্ঠানস্থলে নদী পার হয়ে এক পাশ থেকে অন্য পাশে আসা মানুষের ক্ষেত্রে বেশকিছু পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে। আজ ২৪ জুন রাত ১২টার পর থেকে বন্ধ থাকবে ফেরি চলাচল। সেতুর নিরাপত্তায় ঘাটের দুই পাশে অতিরিক্ত নৌ পুলিশ সদস্য মোতায়েন করা হয়েছে। পুলিশ সদর দপ্তর বলছে, পদ্মা সেতুর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানকে কেন্দ্র করে বিপুলসংখ্যক লোক অনুষ্ঠানস্থলে জড়ো হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। উপস্থিতির বিষয়টি সম্পর্কে আগাম ধারণা নিয়ে যেসব রুট দিয়ে তারা আসবেন সেসব বিষয়ে তথ্য সংগ্রহ করে সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে। বেশ কয়েক দফা নিরাপত্তা তল্লাশি পার হয়ে অনুষ্ঠানস্থলে উপস্থিত হতে হবে আগত অতিথিদের। পুলিশের পক্ষ থেকে বেশ কয়েক স্তরের নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। যারা বিভিন্ন জায়গা থেকে উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে অংশ নেবেন তাদের যথাযথ নিরাপত্তা তল্লাশি পেরিয়ে অনুষ্ঠানস্থলে উপস্থিত হতে হবে। কেউ যেন কোনো ধরনের অপতৎপরতা সৃষ্টি করতে না পারে, সে ব্যাপারে থাকবে কঠোর নজরদারি। হাইওয়ে পুলিশ, ট্রাফিক পুলিশ, জেলা পুলিশ, আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন, নৌ পুলিশ, র্যাবসহ সবাই একযোগে মোতায়েন থাকবে।
পদ্মা সেতুর উদ্বোধন উপলক্ষে সার্বিক নিরাপত্তায় নিয়োজিত থাকবে র্যাবসহ সাড়ে ৫ হাজার পুলিশ সদস্য। এজন্য সাজানো হয়েছে ত্রিমাত্রিক নিরাপত্তা বলয়। এ বিষয়ে পুলিশ সদর দপ্তরের এআইজি (মিডিয়া অ্যান্ড পিআর) মো. কামরুজ্জামান বলেন, কেউ যাতে গুজব ছড়াতে না পারে, সেজন্য সার্বক্ষণিক সাইবার মনিটরিং করা হচ্ছে। উদ্বোধনের দিন পদ্মার দুই পাড়ে র্যাবসহ পুলিশের সাড়ে ৫ হাজারের বেশি সদস্য ইউনিফর্মে মোতায়েন থাকবেন। এর বাইরে বিভিন্ন বাহিনীর গোয়েন্দা শাখার সদস্যরা সাদা পোশাকে তৎপর থাকবেন। নৌপথে শৃঙ্খলা রক্ষায় নিয়োজিত থাকবে নৌপুলিশ। মাদারীপুর, শরীয়তপুর, মুন্সীগঞ্জ জেলা পুলিশের চাহিদা মোতাবেক আরো যদি ফোর্স লাগে তা দেওয়া হবে। একইসঙ্গে কাজ করছে হাইওয়ে পুলিশ। আমাদের র্যাবের সদস্যরাও নিয়োজিত থাকবেন। আকাশ পথে টহল দেবে র্যাবের এয়ার উইং। অর্থাৎ নিরাপত্তা ব্যবস্থায় ত্রিমাত্রিক বলয় সাজানো হয়েছে।পদ্মা সেতুতে অর্থায়নে বিশ্বব্যাংক চুক্তিবদ্ধ হওয়ার পর দুর্নীতির ষড়যন্ত্রের অভিযোগ তুলে পিছু হটেছিল। এ নিয়ে দীর্ঘ টানাপড়েনের পর সরকার নিজস্ব অর্থায়নে এই সেতু নির্মাণের পথে এগিয়ে যায়। ৩০ হাজার ১৯৩ কোটি টাকার নির্মিত সেই সেতুর উদ্বোধন হচ্ছে শনিবার।
বিশ্বব্যাংক দুর্নীতির ষড়যন্ত্রের যে অভিযোগ তুলেছিল, তারা তা প্রমাণ করতে পারেনি। এ নিয়ে কানাডার আদালতে মামলাও হয়েছিল, কিন্তু তা টেকেনি। ২০১৫ সালে পদ্মা সেতু নির্মাণযজ্ঞ শুরু হলেও তার পরিকল্পনা তারও আগের। বিশাল এ প্রকল্পের মূল সেতু নির্মাণের কাজটি পায় চীনা প্রতিষ্ঠান চায়না মেজর ব্রিজ ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানি। প্রকল্পে চীনের প্রায় ১৫০ প্রকৌশলী এবং ৩৫০ কর্মী যোগ দেয়। ২০১৫ সালের ১ মার্চ মুন্সীগঞ্জের মাওয়ায় মূল সেতুর পরীক্ষামূলক ভিত্তি স্থাপনের সময় নদীতে গরু ও খাসির রক্ত ঢালতে দেখা যায় চাইনিজ ওই প্রতিষ্ঠানের কর্মীদের। ভাসিয়ে দেওয়া হয় কয়েকটি মুরগিও। সে সময় জানানো হয়, এটা চীনাদের প্রচলিত রীতি ও বিশ্বাস। তারা বিশ্বাস করেন, বড় কোনো কাজের শুরুতে পশু উৎসর্গ করলে স্রষ্টার সন্তুষ্টি লাভ করা যায়। চীনা ওই রীতি রীতি নিয়ে বড় কোনো আলোচনা তখন না থাকলেও ২০১৯ সালের মাঝামাঝিতে শুরু হয় গুজব। সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়ানো হয়, পদ্মা সেতু তৈরিতে ‘মানুষের মাথা লাগবে’। এই গুজব পালে হাওয়া পায় ২০১৯ সালের ১৯ জুলাই নেত্রকোনায় এক যুবকের ব্যাগ থেকে একটি শিশুর মাথা পাওয়ার পর। স্থানীয়দের সন্দেহ হয়, পদ্মা সেতুতে বলি দেওয়ার জন্য ওই যুবক কাটা মাথা সংগ্রহ করছিল। ওই যুবক গণপিটুনিতে নিহত হয়। সেইসঙ্গে দেশের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে পড়ে ছেলে ধরার গুজব। আর তারমধ্যে দেশের বিভিন্ন স্থানে আক্রান্ত হয় নিরীহ মানুষ।
এর মধ্যে সবচেয়ে বেদনাদায়ক ঘটনাটি ঘটে ঢাকার উত্তর বাড্ডায়। ওই বছরের ২০ জুলাই সকালে উত্তর বাড্ডা এলাকায় মেয়েকে স্কুলে ভর্তি করানোর তথ্য জানতে স্থানীয় একটি স্কুলে গিয়েছিলেন তাসলিমা বেগম রেনু নামে এক নারী। তাকে ছেলেধরা সন্দেহে পিটিয়ে মারা হয়। একই দিনে নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জে ‘ছেলেধরা’ সন্দেহে পিটুনিতে এক ব্যক্তি নিহত হন। একই জেলায় আরেক স্থানে এক নারী হন পিটুনির শিকার। ২১ জুলাই মিনু মিয়া নামের আরেক ব্যক্তি টাঙ্গাইলের কালিহাতীর সয়া হাটে মাছ ধরার জাল কিনতে গিয়ে ছেলেধরা সন্দেহে জনতার পিটুনিতে নিহত হন।
সেতু উদ্বোধনের আগে আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের সেসব কথা স্মরণ করে বলেন, ‘আগামী ২৫ জুন পদ্মা সেতুর উদ্বোধনের মধ্য দিয়ে মিথ্যাচারের জবাব দেওয়া হবে, জবাব দেওয়া হবে সকল গুজবের। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সেতু উদ্বোধনের পর বাড়বে কর্মসংস্থান। তেমনি বাড়বে জিডিপি প্রবৃদ্ধিও। সেতুর দুই পাড়ে গড়ে উঠবে আধুনিক বসতি ও শিল্প কারখানা। বাড়বে পর্যটনের সম্ভবনা। তেমনি যোগাযোগের পথ ত্বরান্বিত হবে। আন্তর্জাতিক সড়ক ও রেল যোগাযোগেও পা রাখবে বাংলাদেশ।