আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দক্ষিণ বাংলার মানুষ। জাতির পিতা ও তার পরিবারের সবাই দক্ষিণ বাংলার এক অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। তাই তো মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এ অঞ্চলের মানুষের দুঃখ-কষ্ট বুঝতেন এবং বোঝেন। এজন্য দক্ষিণাঞ্চলের জনগোষ্ঠীকে কিভাবে উন্নয়ন সাধন করা যায় এবং বাংলাদেশের অন্যান্য অঞ্চলের মতো উন্নয়নের বাতাস ছড়িয়ে দেওয়া যায়, সে বিষয়ে তিনি সবসময়ই ভাবতেন। এ লক্ষ্যে ২০০১ সালের ৪ জুলাই আনুষ্ঠানিকভাবে মাওয়া ফেরিঘাটের কাছেই এ সেতুর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। কিন্তু নানা প্রতিবন্ধকতার কারণে ২০০১ সালের নির্বাচনে তার দল পুনর্নির্বাচিত হতে পারেনি। তাই এ সেতুর নির্মাণকাজের অগ্রাধিকার হারিয়ে যায়।
২০০৯ সালে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় ফিরে আসার পর প্রধানমন্ত্রী আবার পদ্মা সেতুর নির্মাণকে জাতীয়ভাবে গুরুত্বপূর্ণ বিবেচনা করে অগ্রাধিকার তালিকায় নিয়ে আসেন। ২০০১ থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত শুধু জাইকার অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণে বিশদ সমীক্ষা সম্পন্ন হয়। এ সেতু নির্মাণ বাস্তবায়নের জন্য এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক, জাইকা, আইডিবি আর্থিক সহায়তার আশ্বাস প্রদান করে এবং পরবর্তীতে বিশ্ব ব্যাংক যুক্ত হয়।
উল্লেখ্য, বঙ্গবন্ধু সেতু নির্মাণেও (যমুনা সেতু) এ উন্নয়ন অংশীদাররা যুক্ত ছিল। এরই মধ্যে ওই সেতুর ঋণের অর্থ সময়মতো বাংলাদেশ পরিশোধ করেছে। তাই সরল বিশ্বাসে বিশ্ব ব্যাংককে যুক্ত করা হয়েছিল। কিন্তু শেষ অবধি বিশ্ব ব্যাংক সে বিশ্বাসের মূল্য দিতে ব্যর্থ হয়। একটা মনগড়া নোংরা বিতর্ক/ষড়যন্ত্র করাতে অন্যান্য উন্নয়ন সহযোগী দেশ বিব্রত বোধ করে।
কিন্তু মাননীয় প্রধানমন্ত্রী পুরো ষড়যন্ত্র বীরত্বের সাথে লড়াই করে ভণ্ডুল করে দিয়ে সেতু নির্মাণে অবিচল থাকেন। তিনি বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুপ্রেরণায় এবং আশ্বাসের পরিপ্রেক্ষিতেই এ মেগা প্রকল্প পদ্মা সেতু নির্মাণ নিজেদের সম্পদ থেকেই সম্পন্ন করার ঘোষণা দেন এবং এ সিদ্ধান্তটাই ছিল পদ্মা সেতুর বিভিন্ন বিতর্কের সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি। যুগ যুগ ধরে বাঙালির কাছে এ ইতিহাসের একক সিদ্ধান্ত এবং এ মুহূর্তে স্মরণীয় হয়ে থাকবে। নানা চড়াই-উৎরাই পার করে, সব দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রের জাল ছিন্ন করে এবং দুর্নীতি-অনিয়মের অভিযোগকে পেছনে ফেলে ২০১৪ সালের ১২ ডিসেম্বর যে স্বপ্নের বীজ রোপিত হয়েছিল পদ্মার পাড়ে; আজ তা বাস্তবে পরিণত হয়ে সেতুর ওপর দিয়ে যান চলাচলের জন্য উন্মুক্ত করা হয়েছে। বিশ্ব নেতৃত্বে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এখন একটি অনুকরণীয় নাম।
স্বপ্নের পদ্মা সেতু এখন আর স্বপ্ন নয়- বাস্তব। মাওয়া ও জাজিরা প্রান্ত এক সুতোয় গেঁথে দৃষ্টিসীমায় পূর্ণতা রূপ লাভ করে ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার পদ্মা সেতুর অবকাঠামো নির্মিত হয়েছে। বাংলাদেশের জাতীয় উন্নয়ন ত্বরান্বিত করতে যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষ করে গ্রামীণ উন্নয়নশীল এলাকার বিশাল জনগোষ্ঠীর অর্থনৈতিক উন্নয়ন, সামাজিক উন্নয়ন, জীবনমানের উন্নয়ন ও জ্ঞান-মনোভাবের ব্যাপক পরিবর্তনে যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতির বিকল্প ছিল না বলেই দক্ষিণাঞ্চলের উন্নয়নের জন্য পদ্মা সেতুর নির্মাণ। আজ পদ্মা সেতু চালু হয়েছে এবং এর সাথে সাথে নিবিড় যোগাযোগ স্থাপিত হচ্ছে দক্ষিণাঞ্চলের ২১টি জেলা। তাই বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ জাতীয় উন্নয়নের ধারক ও বাহক পদ্মা সেতু প্রজন্মের কিংবদন্তি, তারুণ্যের বাতিঘর ও বাংলাদেশের আপামর জনসাধারণের শেষ আশ্রয়স্থল মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সুযোগ্য নেতৃত্বে এখন আর এটি কেবল স্বপ্নই নয়- বাস্তব।
পদ্মা সেতু বাংলাদেশের পদ্মা নদীর ওপর নির্মিত একটি বহুমুখী সড়ক ও রেল সেতু। এর মাধ্যমে মুন্সীগঞ্জের লৌহজংয়ের সাথে শরীয়তপুর ও মাদারীপুর জেলা যুক্ত হয়েছে। ফলে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিম অংশের সাথে উত্তর-পূর্ব অংশের সংযোগ ঘটেছে।
এক নজরে নির্মিত পদ্মা সেতুর চিত্র :
সেতুর নাম : পদ্মা সেতু
স্থানাংক : ২৩.৪৪৬০ উত্তর ৯০.২৬২৩ পূর্ব
বহন করবে : যানবাহন এবং ট্রেন
অতিক্রম করবে : পদ্মা নদী
স্থান : মুন্সীগঞ্জের লৌহজংয়ের সাথে শরীয়তপুর ও মাদারীপুর
রক্ষণাবেক্ষণ : বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষ
ওয়েবসাইট : www.Padmabridge.gov.bd
বৈশিষ্ট্য
নকশা : এ ই মি ও এম
উপাদান : কংক্রিট, স্টিল
মোট দৈর্ঘ্য : ৬.১৫ কিলোমিটার (২০,২০০ ফুট)
প্রস্থ : ১৮-১০ মিটার (৫৯.৪ ফুট)
ইতিহাস
নকশাকার : AE COM
নির্মাণকারী : চায়না মেজর ব্রিজ ইঞ্জিনিয়ারিং কনস্ট্রাকশন কোম্পানি লি.
নির্মাণ শুরু : নভেম্বর, ২০১৪
নির্মাণ শেষ : জুন, ২০২২
চালু : ২৫ জুন, ২০২২
পদ্মা সেতু নির্মাণের ফলে মাওয়া-জাজিরা পয়েন্ট দিয়ে নির্দিষ্ট পথের মাধ্যমে দেশের কেন্দ্রের সাথে দক্ষিণ-পশ্চিম অংশের সরাসরি সংযোগ তৈরি হয়েছে। সেতুটি অপেক্ষাকৃত অনুন্নত অঞ্চলের সামাজিক, অর্থনৈতিক ও শিল্প বিকাশে উল্লেখযোগ্যভাবে অবদান রাখবে। এ সেতু নির্মাণের ফলে প্রত্যক্ষভাবে প্রায় ৪৫,০০০ বর্গকিলোমিটার (১৭,১০০ বর্গমাইল) বা বাংলাদেশের মোট এলাকার ২৯.৫% অঞ্চলজুড়ে সাড়ে তিন কোটিরও অধিক জনগণ প্রত্যক্ষভাবে উপকৃত হবে। সেতুটি দেশের পরিবহণ নেটওয়ার্ক এবং আঞ্চলিক অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামো হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। সেতুটিতে অদূর ভবিষ্যতে রেল, গ্যাস, বৈদ্যুতিক লাইন এবং ফাইবার অপটিক কেবল সম্প্রসারণের ব্যবস্থা রয়েছে। এ সেতুটি দেশের জিডিপির ১.২ শতাংশ পর্যন্ত বৃদ্ধি করবে।
বাংলাদেশ স্বাধীন-সার্বভৌম দেশ। ৯ মাস রক্তক্ষয়ী সশস্ত্র সংগ্রাম কওে ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ সালে কাক্সিক্ষত স্বাধীনতা ছিনিয়ে এনেছে এ দেশের আপামর জনসাধারণ। কাজেই এ জাতি অদম্য। পৃথিবীর কোনো শক্তি তার উন্নয়ন ও সমৃদ্ধির অগ্রযাত্রাকে রুখে দিতে পারবে না ইনশাআল্লাহ। বাংলাদেশ আকাশসম উচ্চতাকে জয় করবে, দুর্ভেদ্য সব সূচককে স্পর্শ করবে এবং বিশে^র বুকে মাথা উঁচু করে আত্মমর্যাদাশীল এক বিস্ময়কর জাতি হিসেবে তার বিকাশ অবশ্যই ঘটাবে।
অচিন্তীয় মেধা, অবিচল আস্থা ও আত্মপ্রত্যয়ের দৃপ্ত শপথে অসম্ভব এবং দুরূহ কার্যক্রমের সফল বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে গোটা বিশ্বকে চমকে দেবে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের এ স্বপ্নের সোনার বাংলা। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ইস্পাত কঠিন মনোবল নিয়ে এ দেশের সার্বিক উন্নয়ন ও সমৃদ্ধির চাকাকে অধিকতর সচল রাখতে বিরামহীন কর্মযজ্ঞ সম্পন্ন করে চলেছেন। দেশ ও দেশের মানুষের জন্য তিনি সম্ভাব্য সব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে তার পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করে যাচ্ছেন। সুনিপুণ দক্ষতার সাথে একের পর এক মেগা প্রকল্প বাস্তবায়ন করছেন। পদ্মা সেতুর বাস্তবায়ন দেশের ইতিহাসে তেমনি এক অবিস্মরণীয় অর্জন, যা আমাদের সামগ্রিক অর্থনীতিকে অনেক উচ্চতায় নিয়ে যাবে। এ সেতু দক্ষিণাঞ্চলের কৃষকদের ভাগ্য পরিবর্তনে যেমন ভূমিকা রাখবে, অন্যদিকে কৃষকরা আরো অধিক হারে উৎপাদন করতে পারবে। পাশাপাশি এ সেতুকে কেন্দ্র করে নতুন শিল্প-কলকারখানা গড়ে উঠবে, যা দেশের সামগ্রিক অর্থনীতিকে সচল রাখবে।
পদ্মা সেতু শুধু দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের অপেক্ষাকৃত পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীকে বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা এবং বন্দরনগরী চট্টগ্রামের অর্থনৈতিক লাইফ লাইনের সঙ্গে সংযুক্ত করবে না, এটি পুরো অর্থনীতিকে আক্ষরিক অর্থে একসূত্রে গাঁথার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম ও অনুঘটক হিসেবে কাজ করবে। এ সেতু ঢাকা থেকে মাওয়া-জাজিরা-ভাঙ্গা-পায়রা-কুয়াকাটা-যশোর-খুলনা-মোংলা পর্যন্ত সুবিস্তৃত একটি ইকোনমিক করিডোর হিসেবে দেশের অর্থনৈতিক দ্বিতীয় সর্বোত্তম লাইফ লাইনের ভূমিকায় অবতীর্ণ হবে। শিল্পায়নে দেশীয় ও বৈদেশিক পুঁজি আকর্ষণে ঢাকা-কুমিল্লা-মিরসরাই-চট্টগ্রাম-আনোয়ারা-মাতারবাড়ী-কক্সবাজার-টেকনাফের মতো আরেকটি আকর্ষণীয় গন্তব্য হয়ে উঠতে এ ইকোনমিক করিডোরের এক দশকও লাগবে না।
বাংলাদেশকে ‘ইমাজিং টাইগার’ বলে অভিহিত করা হয় এবং এর অন্যতম উদাহরণ হচ্ছে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর পরম সাহসী পদক্ষেপ। জনগণের টাকায় অর্থাৎ নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণের সিদ্ধান্তটি একটি যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত। এ সিদ্ধান্তের ফলে দেশের প্রবৃদ্ধি শ্লথ হয়নি, দেশের ব্যালেন্স অব পেমেন্টসে কোনো সংকট হয়নি, দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের চমকপ্রদ প্রবৃদ্ধি ব্যাহত হয়নি এবং বিশ্বের কাছে জাতির মিসকিনসুলভ পরনির্ভরতা ও ইমেজের সংকটে এক সিদ্ধান্তেই চিরতরে বদলে গেছে। বর্তমানে উন্নয়ন প্রকল্পের প্রায় ৮৫ শতাংশ নিজস্ব অর্থায়নেই বাস্তবায়িত হচ্ছে। বাংলাদেশ এখন আত্মনির্ভরশীল দেশ হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে।
স্বপ্নের পদ্মা সেতু এখন আর স্বপ্ন নয়- বাস্তব। যে পদ্মার একদিন ছিল না কূল-কিনারা; বর্তমানে সেই পদ্মার বুকে ছুটছে গাড়ি, চলবে ট্রেন। পদ্মা সেতু ঘিরে স্বপ্নের দূরত্ব মাত্র ১৫০ মিটার। মাওয়া ও জাজিরা প্রান্ত এক সুতায় গেঁথে দৃষ্টিসীমায় পূর্ণরূপে ভেসে উঠেছে ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার পদ্মা সেতুর মূল অবকাঠামো। এ সেতুর কারণেই দক্ষিণাঞ্চলের ২১টি জেলার মানুষের ভাগ্য খুলে যাচ্ছে এবং মানুষের জীবনযাত্রার মানও ইতোমধ্যেই বদলাতে শুরু করেছে।
এ পদ্মা সেতু যেন কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সেই অমর এক প্রতিচ্ছবি- যিনি বলেছিলেন; আমাদের বাঁচিবার উপায় আমাদের নিজেদের শক্তিকে সর্বোত্তমভাবে জাগ্রত করতে হবে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আমাদের সেই ভরসার বাণীই শুনিয়েছিলেন যখন অন্তরের গহীনতর তল থেকে বলে উঠেছিলেন, পদ্মা সেতু আমরা নিজেদের সম্পদেই গড়ে তুলব। আজ মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সেই দৃঢ়প্রতিজ্ঞ বক্তব্য সার্থক হয়েছে এবং সেতুটি দেশের অনন্য প্রতীক হিসেবে দাঁড়িয়ে আছে। পদ্মা সেতুর বাস্তবায়ন বাংলাদেশের জাতীয় মনোবল ও সক্ষমতা বৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।