পদ্মা সেতু। এক নতুন স্বপ্নের নাম। ১৭ কোটি মানুষের কাছে আশার প্রতীক। দেশের মানুষের দীর্ঘদিনের লালিত স্বপ্ন আজ বাস্তবে ধরা দিচ্ছে। উদ্বোধন উপলক্ষে সারাদেশে সাজ সাজ রব। সেতুর উদ্বোধনের মধ্য দিয়ে দেশ এক নতুন যুগে প্রবেশ করছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেল, যেকোনো দেশের উন্নয়নে, বিশেষ করে ব্যবসা বাণিজ্যের প্রসার ও সমৃদ্ধির জন্য সহজলভ্য যোগাযোগ ব্যবস্থা অপরিহার্য। ষড়যন্ত্র আর পরনির্ভরতার অচলায়তন ভেঙে আজ দেশে যোগাযোগ ব্যবস্থার এক মাইলফলক হয়েছে এই পদ্মা সেতু।
শুধু যোগাযোগ ব্যবস্থায় নয়। বিশ্বে বাঙালিদের মাথা অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছে এই পদ্মা সেতু। দেশের গণ্ডি পেরিয়ে সারাবিশে^ই এখন পদ্মা সেতু নিয়ে আলোচনা। বাংলাদেশের মতো একটি উন্নয়শীল দেশের পক্ষে এই সেতু নির্মাণ করা সহজসাধ্য বিষয় ছিল না। তাও আবার পদ্মা নদীর ওপর। কারণ বিশ্বের যত খরস্রোতা নদী রয়েছে তার মধ্যে অন্যতম হলো এই পদ্মা নদী। যা হিমালয় থেকে উৎপত্তি হয়ে বঙ্গোপসাগরে গিয়ে মিশেছে। তার চলার পথে শত শত শাখা, উপশাখার পানি বহন করে সাগরে ফেলছে এই পদ্মা।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এর চেয়ে বেশি পানির প্রবাহ আছে পৃথিবীর একটিমাত্র নদীতে। সেটি আমাজন নদী। তবে তার ওপর কোনো সেতু নেই। সেতুর নির্মাণ প্রকৌশলীরা বলছেন, এ রকম বিশাল ও প্রমত্ত একটি নদীর ওপর এত বড় সেতু নির্মাণের কাজ প্রকৌশলগত দিক থেকে ছিল বিরাট চ্যালেঞ্জ। নির্মাণকাজে বিশেষজ্ঞ দলের এক সদস্য ড. আইনুন নিশাত বলেন, পদ্মার তলদেশে এবং দু’পাশে নরম মাটি ও বালি। এ কারণে কাজটা ছিল বেশ কঠিন ও জটিল।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পদ্মা বহুমুখী সেতুর মাওয়া-জাজিরা পয়েন্ট দিয়ে নির্দিষ্ট পথের মাধ্যমে বাংলাদেশের কেন্দ্রের সঙ্গে দক্ষিণ-পশ্চিম অংশের সরাসরি সংযোগ তৈরি হয়। এই সেতুটি অপেক্ষাকৃত অনুন্নত অঞ্চলের সামাজিক, অর্থনৈতিক ও শিল্প বিকাশে উল্লেখযোগ্যভাবে অবদান রাখবে। প্রকল্পটির ফলে প্রত্যক্ষভাবে প্রায় ৪৪ হাজার বর্গ কিঃমিঃ (১৭ হাজার বর্গ মাইল) বা বাংলাদেশের মোট এলাকার ২৯% অঞ্চলজুড়ে ৩ কোটিরও অধিক জনগণ প্রত্যক্ষভাবে উপকৃত হবে। ফলে প্রকল্পটি দেশের পরিবহণ নেটওয়ার্ক এবং আঞ্চলিক অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামো হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। সেতুটিতে ভবিষ্যতে রেল, গ্যাস, বৈদ্যুতিক লাইন এবং ফাইবার অপটিক কেবল সম্প্রসারণের ব্যবস্থা রয়েছে। এই সেতুটি নির্মিত হলে বাংলাদেশের জিডিপি ১.২ শতাংশ পর্যন্ত বৃদ্ধি পাবে।
আবার পরিবেশগত বিবেচনায়ও বিশ্বে অনন্য পদ্মা সেতু। বিজ্ঞানীরা বলছেন, পদ্মা সেতু নির্মাণ করতে গিয়ে নদীর পরিবেশ যাতে ক্ষতিগ্রস্ত না হয় সেটা নিশ্চিত করারও ছিল বড় চ্যালেঞ্জ। এজন্য নদীর স্বাভাবিক গতিপথে কোনো বাধা দেওয়া হয়নি। নদীকে কোথাও সংকুচিতও করা হয়নি। সেতুর কারণে পদ্মা নদী ও তার আশপাশের পরিবেশের ওপর কী ধরনের প্রভাব পড়তে পারে সে বিষয়ে সমীক্ষা চালানো হয়। তাতে ইলিশ মাছের বিষয়টিকে গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করা হয়। ইলিশ মাছের বাস্তুসংস্থানে যাতে ক্ষতি না হয় সে বিষয়ে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।
সেতু শুধু যাতায়াতেরই সুবিধা দেবে না, জীবনমান উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। কৃষি-শিল্প-অর্থনীতি-শিক্ষা-বাণিজ্য- সব ক্ষেত্রেই এই সেতুর বিশাল ভূমিকা থাকবে। এই সেতু কেবল দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের নয়, সারা বাংলাদেশের অর্থনীতির চেহারাই বদলে দিতে পারে। শুধু বাংলাদেশ নয়, দক্ষিণ এশিয়া ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার যোগাযোগ, বাণিজ্য, পর্যটনসহ অনেক ক্ষেত্রেই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে একথা নিঃসন্দেহে বলা যায়।
এক সময়ের স্বপ্নের পদ্মা সেতু এখন দৃষ্টিসীমায় দিগন্তজুড়ে দাঁড়িয়ে। পদ্মার তীরে গেলেই দেখা যায় পিলারের দীর্ঘ সারি। সংশ্লিষ্ট প্রকৌশলীরা বলছেন, পদ্মা সেতুর খুঁটির নিচে সর্বোচ্চ ১২২ মিটার গভীরে স্টিলের পাইল বসানো হয়েছে। এসব পাইল তিন মিটার ব্যাসার্ধের। বিশ্বে এখনো পর্যন্ত কোনো সেতুর জন্য এত গভীরে পাইলিং হয়নি এবং মোটা পাইল বসানো হয়নি। ভূমিকম্প থেকে পদ্মা সেতুকে টিকাতে ‘ফ্রিকশন পেন্ডুলাম বিয়ারিং’ লাগানো হয়েছে। যেই বিয়ারিংয়ের সক্ষমতা ১০ হাজার টন। এখন পর্যন্ত বিশ্বের কোনো সেতুতে এমন সক্ষমতার বিয়ারিং লাগানো হয়নি। রিখটার স্কেলে ৯ মাত্রার ভূমিকম্পেও টিকে থাকতে পারবে পদ্মা সেতু।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন দেশের প্রধানতম এবং পৃথিবীর অন্যতম বৃহত্তম এ সেতু দক্ষিণ এশিয়ার জন্য এক বিস্ময়। সেতুটির ওপর দিয়ে প্রতিদিন গড়ে ৭৫ হাজার যানবাহন চলাচল করবে। সেতুটির মাধ্যমে মুন্সীগঞ্জ, শরীয়তপুর, মাদারীপুর জেলাসহ দক্ষিণাঞ্চল প্রত্যক্ষভাবে সংযুক্ত হবে এবং দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাংশের সঙ্গে উত্তর-পূর্ব অংশের সংযোগ স্থাপিত হবে। দেশের সার্বিক উন্নয়নে প্রভূত ভূমিকা রাখার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে পদ্মা সেতু নির্মাণের মধ্য দিয়ে।