logo
আপডেট : ২৫ জুন, ২০২২ ১২:৫৩
খুলল অর্থনীতির নতুন দ্বার
জাফর আহমদ

খুলল অর্থনীতির নতুন দ্বার

আজ খুলছে বহুল প্রত্যাশিত পদ্মা বহুমুখী সেতু। সেতু চালুর মধ্য দিয়ে অবসান হচ্ছে দক্ষিণাঞ্চলের ২১ জেলার ৬ কোটি মানুষের অপেক্ষার পালা। ভঙ্গুর যোগাযোগের কারণে যে কৃষক কৃষিপণ্য উৎপাদন করেও কাক্সিক্ষত মূল্য পেতেন না; ব্যয়বহুল ও সময়সাপেক্ষ যোগাযোগের কারণে একই শিল্পপণ্য অন্য এলাকায় বেশি দামে কিনতে হতো; সম্ভাবনা থাকার পরও সুন্দরবন বা কুয়াকাটার মতো পর্যটন কেন্দ্রগুলোতে প্রাণস্পন্দন জাগেনি। পদ্মা সেতু চালুর মধ্য দিয়ে সেই মলিন দিনের অপেক্ষা শেষ হলো।


সেতু চালু হওয়ার পরদিন থেকেই মানুষ সুবিধা পাবে বলে মনে করেন বিশ্বব্যাংকের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন।


তিনি ভোরের আকাশকে বলেন, পদ্মা সেতুতে গাড়ি চলাচল শুরুর দিন থেকে পণ্য পরিবহণে ট্রাকের ১০ ঘণ্টা সময় কমে যাবে। ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ বা চট্টগ্রামে উৎপাদিত শিল্পপণ্য সরাসরি দক্ষিণের জেলাগুলোয় পৌঁছবে। দক্ষিণের কৃষক কৃষিপণ্য, মাছ উৎপাদন করে সরাসরি ঢাকায় নিয়ে আসবে। জাগবে ট্যুরিজম শিল্প। জিডিপিতে যোগ হবে ১.২ থেকে ১.৮ শতাংশ।


পদ্মা সেতুর সঙ্গে সমান্তরাল এগিয়ে গেছে দক্ষিণাঞ্চলের অবকাঠামো নির্মাণের কাজ। পদ্মা সেতু শুরুর দিন থেকেই মানুষ স্বপ্ন দেখা শুরু করে। এ অঞ্চলে শিল্পকারখানা, ব্যবসা-বাণিজ্য, বিপণন, সরবরাহ ও কৃষিপণ্য বাজারজাত করে সর্বোচ্চ মূল্য পাওয়ার অপেক্ষায় ছিল। এর জন্য যে অবকাঠামো প্রয়োজন তার কিছু এখন মাঝামাঝি পর্যায়ে। কিছু ইতোমধ্যে সম্পন্ন হয়েছে। সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলো বলছে, এসব কার্যক্রম সম্পন্ন হলে কাক্সিক্ষত প্রবৃদ্ধি অর্জন সম্ভব হবে।


দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের মানুষের বাধা হয়ে দাঁড়াত পদ্মা। ট্রাকে করে পণ্য নিতে পদ্মায় খেয়ে ফেলত সব সময়। আজ থেকে পরাভূত প্রমত্ত পদ্মা। পণ্যবাহী ট্রাক ১০ ঘণ্টার অপেক্ষার সড়ক পার হবে ৫ মিনিটে। ফেরিতে অপেক্ষারত যাত্রী তিন থেকে চার ঘণ্টা সময় আগেই গন্তব্যে পৌঁছে যাবে। শিল্পকারখানা গড়ে উঠতে সময় লাগলেও কার্যক্রম চলছে মহা ধুমধামে। পদ্মা সেতু হওয়ার পর অর্থনৈতিক উন্নয়ন কর্মকাণ্ডগুলোকে গতিশীল করতে প্রয়োজনীয় সড়ক, সেতু ও বিদ্যুতের মতো অবকাঠামো নির্মাণের কাজ চলছে- যাতে এ অঞ্চলে শিল্পকারখানা, ব্যবসা-বাণিজ্য, কৃষি প্রক্রিয়াজাতকরণ প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠবে। ঢাকায় দ্রুত আসা-যাওয়া ও পণ্য আনা-নেওয়া করবে। পদ্মা সেতু অর্থনৈতিক অগ্রযাত্রা, সক্ষমতা ও প্রতিরোধ্য ইচ্ছাশক্তির প্রতীক। বিশ্বের প্রথম সারির অর্থলগ্নিকারী প্রতিষ্ঠান ও দাতা সংস্থাগুলোর বিরোধিতার মুখে নিজস্ব শক্তি ও সাহস নিয়ে নিজ অর্থায়নে প্রতিষ্ঠা করা হচ্ছে পদ্মা সেতু। যার সঙ্গে পুরো দেশের আবেগ জড়িত। জড়িত দক্ষিণাঞ্চলের মানুষের স্বপ্ন। সেই বাস্তবতাতেই যুক্ত হয়েছে রামপালের মৈত্রী সুপার থার্মাল পাওয়ার প্রজেক্ট; পায়রা গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ প্রকল্প ও পদ্মা সেতু রেল সংযোগ প্রকল্পের মতো ফার্স্ট ট্যাক প্রজেক্ট।


পদ্মা সেতুর চালুতে ফার্স্ট ট্র্যাক প্রকল্প অর্থনীতিতে অবদান নিয়ে গবেষণা করেছে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগ (আইএমইডি)।


গবেষণায় দেখা গেছে, এই সেতুর ফলে দক্ষিণাঞ্চলের সঙ্গে ঢাকার যোগাযোগে সময় কমার পাশাপাশি জিডিপি প্রবৃদ্ধিতে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখবে। ১. রাজধানীর সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ, ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার, কাঁচামাল সরবরাহ এবং শিল্পায়ন সহজতর করতে সহায়তা করবে। ২. ২১ জেলায় গড়ে উঠবে ছোট-বড় শিল্প। কৃষির ব্যাপক উন্নতি হবে। কৃষকরা পণ্যের দাম ভালো পাবেন ফলে উৎপাদন বৃদ্ধি পাবে। ৩. দক্ষিণের জেলাসমূহের বার্ষিক জিডিপি ২.০ শতাংশ এবং দেশের সামগ্রিক জিডিপি ১.২ শতাংশের বেশি বাড়াতে সাহায্য করবে । ৪. সমন্বিত যোগাযোগ কাঠামোর উন্নতি হবে। দেশের দক্ষিণাঞ্চল ট্রান্স-এশিয়ান হাইওয়ে (ঘ-৮) এবং ট্রান্স এশিয়ান রেলওয়ের সঙ্গে সংযুক্ত হবে। ৫. ভারত, ভুটান ও নেপালের সঙ্গে বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক যোগাযোগ বৃদ্ধি পাবে। সেতুর দুই পাশে গড়ে তালা হবে অর্থনৈতিক অঞ্চল, হাইটেক পার্ক ও বেসরকারি শিল্প শহর। ফলস্বরূপ, বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান বাড়বে। ৬. মোংলা ও পায়রা সমুদ্রবন্দর নতুন উদ্যমে চালু থাকবে। ৭. পর্যটন শিল্পের বিকাশ ঘটার পাশাপাশি দক্ষিণাঞ্চলের কুয়াকাটা সমুদ্রসৈকত, সুন্দরবন, ষাট গম্বু^ুজ মসজিদ, টুঙ্গিপাড়ায় বঙ্গবন্ধুর মাজার, মাওয়া ও জাজিরায় পুরনো-নতুন রিসোর্টসহ নতুন-পুরনো পর্যটনকেন্দ্রগুলো দেশি-বিদেশি পর্যটকদের আকৃষ্ট করবে। এবং ৮) সেতুর ওপর দিয়ে যানবাহন চলাচলের সংখ্যা প্রতি বছর ৭-৮ শতাংশ বৃদ্ধি পাবে এবং ২০৫০ সাল নাগাদ ৬৭ হাজার যানবাহন চলাচল করবে।


সেতু উদ্বোধন হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে দক্ষিণাঞ্চলের জেলাগুলোর সঙ্গে পদ্মা সেতু হয়ে ঢাকা যোগাযোগের স্বপ্নদ্বার খুলে যাবে। ইতোমধ্যে মানুষের মধ্যে সাজ সাজ রব। অপেক্ষায় ছিল শুধু উদ্বোধনের। জাজিরা থেকে ভাঙা হয়ে গোপালগঞ্জ পর্যন্ত ফোর লেন সড়ক নির্মাণের কার্যক্রম সম্পন্ন হয়েছে। গোপালগঞ্জের নড়াইলের লোহাগড়ার কালনা পর্যন্ত চার লেনের সড়কের কার্যক্রম হাতে নেওয়া হয়েছে। খুব তাড়াতাড়ি উন্নত হবে কুষ্টিয়া, যশোর, খুলনা থেকে মোংলা পর্যন্ত। এদিকে বরিশাল থেকে ভোলা, পটুয়াখালীর যোগাযোগ ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজানো হয়েছে।


পদ্মা সেতু হয়ে ঢাকার সঙ্গে কুয়াকাটা পর্যন্ত ইতোমধ্যে যোগাযোগের জন্য সড়ক প্রস্তুত হয়েছে। এক্ষেত্রে পায়রা সেতু সংযোগ করেছে। পায়রা সেতু বাংলাদেশের সড়ক সেতু, যা পায়রা নদীর ওপর নির্মাণ করা হয়। সেতুটির দৈর্ঘ্য ১ হাজার ৪৭০ মিটার। এ সেতু নির্মাণের পর থেকে বরিশাল থেকে কুয়াকাটা পর্যন্ত ১১১.৫ কিলোমিটার যাত্রাপথে ফেরি পারাপারের প্রয়োজন শেষ হয়। ঢাকা-বরিশাল-পটুয়াখালী-কুয়াকাটা মহাসড়কের পটুয়াখালীর দুমকি উপজেলার লেবুখালী এলাকার পায়রা নদীর ওপর নির্মাণ করা হয় এ সেতু।


দক্ষিণাঞ্চল মূলত কৃষিনির্ভর এলাকা। এখানে কৃষিপণ্য উৎপাদিত হলেও যোগাযোগের অভাবে চাষিরা দাম পান না। খাদ্যভাণ্ডারখ্যাত উত্তরাঞ্চলে খাদ্য উৎপাদন হওয়ার পাশাপাশি খাদ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্পকারখানাও গড়ে উঠেছে। হচ্ছে বড় বড় বিনিয়োগ। মূলত যোগাযোগ ব্যবস্থা সহজ হওয়ার কারণে এমন পরিবর্তন এসেছে। দক্ষিণাঞ্চলে কৃষিপণ্য উৎপাদন হলেও যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি না হওয়ার কারণে সেখানকার কৃষি ও কৃষক তিমিরেই থেকে গিয়েছিল। সেতু চালুর পরের দিন থেকে শেষ হবে অপেক্ষার পালা। শ্রম ঘাম দিয়ে উৎপাদিত পণ্য কম দামে বিক্রি করে কৃষককে আর ঘরে ফিরতে হবে না। ন্যায্য দামে বিক্রি করে নতুন করে উৎপাদন সক্ষমতার পুরো প্রয়োগ করতে মনোযোগ দিতে পারবে।


উদ্যোক্তারা বলছেন, পদ্মা সেতু চালু হওয়ার পর থেকে অন্ধকার কেটে যাবে। মানুষের চলাচল, ব্যবসাবাণিজ্যের প্রসারে পদ্মা সেতু যোগাযোগের মহোৎসব শুরু হবে, সেই অবস্থাকে বিবেচনায় রেখেই এসব উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। পদ্মা সেতু চালু হলে নতুন করে প্রাণচাঞ্চল্য তৈরি হবে মংলা বন্দরের। ঢাকার সাথে কমবে দূরত্ব। এজন্য সড়ক পথের কার্যক্রম ঢেলে সাজানো হচ্ছে। সেতুকেন্দ্রিক উন্নয়ন কাঠামো নির্মাণ এসব সড়ক নির্মাণের লক্ষ্য।


এ বিষয়ে পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরএ) নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর ভোরের আকাশকে বলেন, পদ্মা সেতুকে কেন্দ্র করে যেসব অবকাঠামো গড়ে উঠছে, সেখানে শিল্পকারখানা গড়ে উঠবে। ব্যবসাবাণিজ্য বা কৃষিপণ্য আনা-নেওয়ার কাজটি এখনই শুরু হলেও শিল্পায়নের কাজটি কিছুটা সময় লাগবে। এখন উন্নয়ন কার্যক্রম চলছে, এটা কাক্সিক্ষত জায়গায় যেতে হয়তো ৫-৬ বছর লাগবে। তবে যেসব অর্থনৈতিক জোন এসব অঞ্চলে গড়ে উঠেছে, সেগুলো উৎপাদনে যাওয়ার মতো জায়গায় নিয়ে যেতে হবে।


পদ্মা সেতুকে কেন্দ্র করে প্রতিবেশী ভারতের সঙ্গেও যোগাযোগের নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হবে। ভারত বাংলাদেশের আঞ্চলিক বাণিজের বড় অংশীদেশ। কোলকাতায় পণ্য আনা নেয়ার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীরা বলছেন সেতু উদ্বোধনের পর বেনাপোল থেকে ঢাকায় আসার সময় কমবে চার ঘণ্টা। এর ফলে দুদেশেরই যাতায়াত, ব্যবসাবাণিজ্য বাড়বে। বিশেষ করে কলকাতার যেসব মানুষ ওপারে চলে গেছে তাদের বাংলাদেশে সফর বাড়বে।