logo
আপডেট : ২২ সেপ্টেম্বর, ২০২২ ১৫:১১
প্রথম পর্ব
যেভাবে সুদিন হারাল বাংলা চলচ্চিত্র
মুস্তাফির হমান নাহিদ

যেভাবে সুদিন হারাল বাংলা চলচ্চিত্র

বাঙালি জীবনের সঙ্গে মিশে আছে বাংলা চলচ্চিত্র, যাত্রাপালা, পুতুলনাচ, বায়োস্কোপ, জারি, সারি, ভাটিয়ালি, কবিগান, পুঁথি পাঠ, গাজিকালুর কিচ্ছাসহ সংস্কৃতির নানা অনুষঙ্গ। কালের বিবর্তনে এখন এসব হারাতে বসেছে। এরই মধ্যে বিলীন হয়ে গেছে অনেক। কিছু এখনো টিকে আছে। সংস্কৃতির বিভিন্ন শাখা নিয়ে ভোরের আকাশের এ আয়োজন।

 

তারপর কী হলো? কী আর হবে শাবানার, সে কী কষ্ট! তার তো আসলে কোনো দোষ নেই। বাচ্চা-কাচ্চা নেই তো, বাপ্পারাজরে সে নিজের ছেলের মতোর জানে। কিন্তু এটিএম শাবানা আর বাপ্পারাজরে ভুল বোঝে। তার শয়তানির জন্য শাবানা আর বাপ্পারাজের জীবনে এত কষ্ট নেমে আসে। অরুণা বিশ্বাসও তাদের ভুল বোঝে। তারপর এটিএম কী ভুল বুঝেই থাকল? না শেষ পর্যন্ত শাবানা মরে যাওয়ার জন্য পুকুর ঘাটে যায়। সেখানে যায় বাপ্পারাজও। এটিএম তাদের পিছু নেয়। ভাবে আজ আর দুজনের নিস্তার নেই। পরে বুঝতে পারে তাদের সম্পর্ক আসলে মা-ছেলের। এটিএম শাবানার কাছে মাফ চাই। এভাবে একসময় বাংলার ঘরে ঘরে সিনেমার গল্প হতো। কোনো ছবি মুক্তি পেলে পরিবারের সবাই মিলে ছুটতেন হলে। সকাল ৯টা থেকে রাত ১২টা পর্যন্ত চলত শো। যারা যেতে পারতেন না, তারা অন্যের কাছে সিনেমার গল্প শুনতেন। সিনেমার গানগুলো ছড়িয়ে যেত মুখে মুখে। হলের পাশাপাশি শুক্রবার হলে সবাই টিভির সামনে বসে পড়তেন। পাড়ায় পাড়ায় ভিসিআর দেখার চল ছিল।


সময় বদলে গেছে। এর সঙ্গে হারিয়ে গেছে বাংলার অনেক ঐতিহ্য। আকাশ সংস্কৃতি হতে শুরু করে বর্তমানের গুগল ইউটিউব কেড়ে নিয়েছে অনেক কিছু। যার বলি হয়েছে বাংলা সিনেমাও। তবে শুধু এ কারণে বাংলা চলচ্চিত্রের সুদিন হারিয়ে যায়নি। এক দিনে তৈরি হয়নি বৈরী পরিস্থিতি। মানুষের রুচির পরিবর্তন, ভালো নির্মাতার অভাব, ভালো গল্পের অভাব, বাজেট কমে যাওয়া, খুব বেশি ব্যবসায়ী মনোভাব, মুখচেনা শিল্পীদের দিয়ে কাজ করানো, কাস্টিং কাউচ, গুণী শিল্পী, গীতিকার, কাহিনীকারদের কদর কমে যাওয়া, অশ্লীলতাসহ বিভিন্ন কারণে দিনে দিনে হারিয়ে গেছে বাংলা সিনেমার সুদিন। সারা বছর তো দূরের কথা, এখন ঈদ-পূজা কিংবা বিশেষ দিনে চলচ্চিত্র মুক্তি পেলেও এর খবর রাখেন না এক সময়ের সিনেমাপ্রেমীরা।

প্রথম বাংলা চলচ্চিত্রকার হীরালাল সেন। তাকেই বলা হয় বাংলা চলচ্চিত্রের জনক। তার হাত ধরেই চলচ্চিত্রের যাত্রা ১৮৯৮ থেকে ১৯১৩ সাল পর্র্যন্ত তিনি বেশ কিছু চলচ্চিত্র নির্মাণ করে। চলচ্চিত্র গবেষক অনুপম হায়াতের মতে তিনি প্রায় ১০০ চলচ্চিত্র তৈরি করে। তবে ১৯১৭ সালে এক অগ্নিকাণ্ডে তার সব চলচ্চিত্র নষ্ট হয়ে যায়। এরপর চলচ্চিত্র তার নিজ গতিতে এগিয়ে গেছে। ১৯৪৭ সালে দেশ ভাগের পর বাংলা সিনেমা বিভক্ত হয়ে গেছে দুটি ভৌগোলিক অংশে, পশ্চিমবঙ্গ ও পূর্ববঙ্গের মধ্যে। দুই বাংলার সিনেমার মধ্যে যোজন যোজন দূরত্ব না থাকলেও, মোটা দাগে কিছু পার্থক্য তো থেকেই গেছে।

ভারতবর্ষে প্রথম চলচ্চিত্র শুরু করার কৃতিত্ব বাঙালিদের হলেও প্রথম পূর্ণাঙ্গ চলচ্চিত্র নির্মিত হয় মুম্বাইয়ে, ১৯১৩ সালে। এরপর কলকাতায় ১৯১৬ সালের দিকে ম্যাডান থিয়েটারস কোম্পানি চলচ্চিত্র নির্মাণ শুরু করে। এ প্রতিষ্ঠানের উদ্যোগে প্রথম বাংলা নির্বাক পূর্ণদৈর্ঘ্য চিত্র বিল্বমঙ্গল মুক্তি পায় ১৯১৯ সালের ৮ নভেম্বর। এ ছবির পরিচালক জ্যোতিষ ব্যানার্জি (মতান্তরে রোস্তমজী দুতিওয়ালা) হলেও নেপথ্য স্থপতি ছিলেন ঢাকার নওয়াব এস্টেটের ম্যানেজারের পুত্র পরবর্তীকালের বিখ্যাত প্রযোজক-পরিচালক প্রিয়নাথ গাঙ্গুলি। কাজেই, চলচ্চিত্রের নির্মাতা ওপার বাংলার হলেও, নেপথ্য ভূমিকা এপার বাংলার চলচ্চিত্রকারদেরই।

১৯২৭-২৮ সালের দিকে ঢাকার নবাব পরিবারের কয়েকজন তরুণ চলচ্চিত্র নির্মাণের উদ্যোগ নেন। তারা সুকুমারী নামে চার রিলের একটি নির্বাক ছবি বানান। ছবিটি পরিচালনা করেন বিশিষ্ট নাট্যকর্মী ও জগন্নাথ কলেজের শরীরচর্চার প্রশিক্ষক অম্বুজ প্রসন্ন গুপ্ত। মজার ব্যাপার হচ্ছে, এ সিনেমায় নারী চরিত্র থাকলেও কোনো নারী অভিনয় করেননি। পুরুষেরাই নারী চরিত্রে অভিনয় করেন। ১৯৫৭ সালে পূর্ব পাকিস্তান চলচ্চিত্র উন্নয়ন সংস্থা (ইপিএফডিসি) প্রতিষ্ঠিত হয়।

এফডিসি প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে বাংলাদেশের চলচ্চিত্র শিল্পের ভিত্তি স্থাপিত হয়। এখানকার সুযোগ-সুবিধা নিয়ে ১৯৫৯ সালে থেকে নিয়মিতভাবে প্রতি বছর চলচ্চিত্র মুক্তি পেতে থাকে। এফডিসির ছাড়াও বেসরকারি পর্যায়ে পপুলার স্টুডিও , বারী স্টুডিও, বেঙ্গল স্টুডিও বাংলাদেশের চলচ্চিত্রশিল্পের বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। ১৯৫৬ সালের ৩ আগস্ট ইকবাল ফিল্মসের ব্যানারে মুখ ও মুখোশ সিনেমাটি মুক্তি পায়। পরিচালক আবদুল জব্বার খানের স্বরচিত নাটক ডাকাত অবলম্বনে এ ছবির কাহিনী তৈরি হয়। এরপর দেশে তৈরি হতে থাকে দারুণ দারণ সব বাংলা সিনেমা। ১৯৫৯ সালে এহতেশাম নির্মাণ করেন গ্রামীণ পটভূমিতে এ দেশ তোমার আমার। ফতেহ লোহানীর আকাশ আর মাটি এবং মহিউদ্দিনের মাটির পাহাড় এ বছরের অন্য দুটি সিনেমা।

স্বাধীনতার বছর ১৯৭১ সালে এদেশে ৮টি সিনেমা মুক্তি পায়। এর মধ্যে নজরুল ইসলামের স্বরলিপি, খান আতাউর রহমানের সুখ-দুঃখ সামাজিক চলচ্চিত্র হিসেবে উল্লেখযোগ্য। ১৯৭২ সালে আলমগীর কবিরের ধীরে বহে মেঘনা, সুভাষ দত্তের বলাকা মন, জহিরুল হকের রংবাজ, ঋত্বিক ঘটকের তিতাস একটি নদীর নাম বাংলা চলচ্চিত্রকে বিশেষ মানে উন্নীত করে। এ সুস্থ ও সৃজনশীল ধারায় ১৯৭৪ সালে নির্মিত হয় নারায়ণ ঘোষ মিতার আলোর মিছিল। সত্তরের দশকের আরো কিছু উল্লেখযোগ্য চলচ্চিত্র হচ্ছে আলমগীর কবিরের সূর্য কন্যা, সীমানা পেরিয়ে, রুপালি সৈকতে; আমজাদ হোসেনের নয়নমনি, গোলাপি এখন ট্রেনে, আবদুল্লাহ আল মামুনের সারেং বৌ প্রভৃতি। এসব চলচ্চিত্রের কাহিনী এখনো মনিুষের মুখে মুখে ফিরে। স্বাধীন বাংলাদেশের সবচেয়ে আলোচিত চলচ্চিত্রটি নির্মিত হয় ১৯৭৯ সালে।

মসিউদ্দিন শাকের ও শেখ নিয়ামত আলীর যৌথ নির্মাণ সূর্য দীঘল বাড়ি বাংলাদেশের চলচ্চিত্রকে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে পরিচয় করিয়ে দেয়। ও এ সময়ের উৎকৃষ্ট চলচ্চিত্র। আশির দশকে আমজাদ হোসেনের ভাত দে, জন্ম থেকে জ্বলছি ও সখিনার যুদ্ধ চাষী নজরুল ইসলামের দেবদাস, শুভদা; মোস্তফা আনোয়ারের কাজল লতা, সুভাষ দত্তের সকাল সন্ধ্যা, ফুলশয্যা; রাজ্জাকের সৎভাই প্রভৃতি সব অর্থে সুস্থধারার ও আলোচিত চলচ্চিত্র।

নব্বইয়ের দশকে বাংলা চলচ্চিত্রজগতে প্রবেশ করেন কলম জাদুকর হুমায়ূন আহমেদ। তার রচিত উপন্যাস অবলম্বনে মুস্তাফিজুর রহমান নির্মাণ করেন শঙ্খনীল কারাগার। হুমায়ূন আহমেদ সেরা কাহিনীকার হিসেবে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার লাভ করেন। তিনি দুই দুয়ারী, চন্দ্রকথা, শ্যামল ছায়াসহ বেশকিছু ভালো এবং ভিন্নধারার চলচ্চিত্র উপহার দেন। এ সময়ে শালমানশাহ্ শবানুর মৌসুমি জুটিদের নিয়ে সুস্থধারায় কিছু ছবি নির্মাণ হয়। যে ছবিগুলো সর্বকালের ব্যবসা সফল চলচ্চিত্র বেদের মেয়ে জোনসার সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে। তবে এ সময়ে ভালো কিছু চলচ্চিত্র নির্মান হলেও ঠিক এ সময়ে চলচ্চিত্রে অশ্লীলতা ঢুকে যায়।

কিছু পরিচালক শিল্প বাদ দিয়ে শুধু টাকার দিকে ঝুঁকে পড়েন। তৈরি হতে থাকে সস্তা গল্পের ছবি। শুরু হয় মুনমুন, ময়ুরী, পলি, শাহারাদের যুগ। এসব নায়িকাকে পর্দায় খোলামেলা উপস্থাপন করা হয়। এ শ্রেণির দর্শক তা লুফে নেয়। ফলে প্রতিযোগিতায় টিকতে না পেরে চলচ্চিত্র পাড়া থেকে বিদায় নিতে থাকে মূলধারারা শিল্পীরা। কাজ হারাতে থাকেন ভালো গীতিকার, কাহিনীকার, পরিচালক প্রয়োজকরা। ফলে চলচ্চিত্রে বৈরী হাওয়া বইয়ে শুরু করে।

এ প্রসঙ্গে নায়িকা মুনমুন বলেন, আমা ছিলাম শিকার। আমি কখনো চলচ্চিত্রে অশ্লীল দৃশ্যে অভিনয় করিনি। যতটুকু করেছি তা বাধ্য হয়ে। পরিচালকরা আমাদের বাধ্য করেছেন। কাহিনীতে যা নেই তা জুড়ে দেয়া হয়েছে। বাকিটা করা হয়েছে আমার ড্যামি ব্যবহার করে। সাধারণ মানুষ যা বোঝেন না। এদিকে ভালো ছবি তৈরি না হওয়ার কারণে দর্শক হলবিমুখ হয়। হল মালিকরাও ধীরে ধীরে প্রেক্ষাগৃহ বন্ধ করতে বাধ্য হয়। পরবর্তীতে দেশে ঝুঁকে পড়ে আকাশ চ্যানেলে। দেশি সংস্কৃতি ভুলে সবাই গ্রহণ করতে থাকে ভিনদেশি সংস্কৃতি। ফলে দেশিও চলচ্চিত্র সোনালি দিন হারাতে থাকে।

তিনি বলেন, চলচ্চিত্রের সুদিন হারানোর শেষ পেরেক হিসাবে কাজ করে ইউটিউব ও ইন্টারনেট। ইউটিউবে চাহিদার পর্যপ্ত বিদেশে ছবি পাওয়ার কারণে মুখ থুবড়ে পড়ে বাংলা ছলচ্চিত্র। তবে এটা মানতে রাজি নয় চলচ্চিত্র বিশ্লেষকরা। তাদের মতে ভালো চলচ্চিত্র তৈরি হলে এখনো হলে দর্শক আসবে। সম্প্রতি ডুব, পরান, হাওয়ার মতো কিছু চলচ্চিত্র সে ইঙ্গিত দিচ্ছে। তাদের প্রশ্ন পাশের দেশ ভারতে যদি এখনো একটি সিমেনা শত শত কোটি টাকা ব্যবসা করতে পারে, তাহলে আমরা কেন পারব না।

এ প্রসঙ্গে চলচ্চিত্র পরিচালক দেলোয়ার জাহান ঝন্টু বলেন, চলচ্চিত্র তৈরি করতে হলে মেধার দরকার। শুধু পড়াশোনা করে আসলেই হবে না। নিজের মস্তিস্কে কিছু থাকা লাগবে। সৃষ্টি কাজগুলো এভাবেই তৈরি হয়। চলচ্চিত্রের প্রতিটি কাজই কঠিন। এখন যারা এ কাজগুলো করছেন তাদের বেশিরভাগই কম সময় নেই। কম শিল্পী কম বাজেট নিয়ে ছবি তৈরি করে। ভালো গল্প নিয়ে ভালো শিল্পী নিয়ে কাজ করলে অবশ্যই ভালো কিছু করা সম্ভব।