ঢাকা: রসনাবিলাসী বাঙালির কাছে মাছের মধ্যে ইলিশের কদর একটু বেশিই। সুস্বাধু এ মাছের চাহিদা শুধু এপার বাংলায় নয়, ওপারে ভারতেও চাহিদা সমপরিমাণ। তাই তো টন টন ইলিশ প্রতিবেশী দেশে পাঠানো হয় রাষ্ট্রীয় পর্যায় থেকে। শুধুই উপঢৌকন হিসেবে নয়, প্রতিবেশী রাষ্ট্রের মানুষ যাতে ইলিশের স্বাদ নিতে পারেন, সে জন্য ইলিশ রপ্তানির ব্যবস্থাও করে দিয়েছে সরকার। এ কারণে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বাজারে বেড়ে গেছে ইলিশের দাম। দাম বাড়লে তাতে কী? শিগগিরই রাজধানীবাসীর জন্য আসতে যাচ্ছে সুখবর। গত দুদিন থেকে রাজধানীতে ঢুকতে শুরু করেছে পর্যাপ্ত ইলিশ। ভোলার চরফ্যাশন, লক্ষ্মীপুরের রামগতি এবং কক্সবাজারসহ কুয়াকাটার মহিপুর থেকে বিপুল পরিমাণ ইলিশ ঢুকছে রাজধানীর বাজারগুলোয়। ওইসব স্থানে ইলিশের দাম পড়তির দিকে থাকায় এর প্রভাব পড়বে রাজধানীতেও। আগের চেয়ে কম দামে মিলবে ইলিশ। আগামী অন্তত ১০ দিন কম দামে ইলিশ খেতে পারবে ঢাকাসহ সারা দেশের মানুষ- এমনটাই আভাস পাওয়া গেছে ওইসব আড়ত ব্যবসায়ীর কথায়।
আড়তদাররা জানান, এরই মধ্যে বিপুল পরিমাণ ইলিশ রাজধানীতে ঢোকা শুরু করেছে। সাগরে বেশি ইলিশ ধরা পড়ার কারণে সরবরাহ বেড়েছে। ব্যবসায়ীরা বলছেন, ঢাকার যাত্রাবাড়ীর অংশেই প্রতিদিন ১৫-২০ কোটি টাকার ইলিশ বিক্রি হয়। বাজারে এখন দেড় কেজি, দুই কেজি; এমনকি আড়াই কেজি ওজনের বড় বড় ইলিশ মাছ আসছে। ইচ্ছা করলে যে কেউ বাজার থেকে বড় সাইজের ইলিশ কিনে তার স্বাদ গ্রহণ করতে পারবেন। তবে দাম অন্য বছরের তুলনায় কিছুটা বেশি।
বর্তমানে বাজারে ইলিশের দাম বাড়ার কারণ হিসেবে ব্যবসায়ীরা বলছেন, জ্বালানি তেলের দাম বাড়াসহ ইলিশ ধরার পয়েন্টগুলোয় জেলেরা কম মাছ পাওয়ায় ভরা মৌসুমে দাম কিছুটা বাড়তি। তবে দুর্গাপূজার কারণে চাহিদা অনুযায়ী সরবরাহ বাড়ায় ইলিশের দাম আরো কিছুটা কমতে পারে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
ইলিশের অন্যতম বড় আড়ত ভোলার চরফ্যাশনে যোগাযোগ করে দেখা গেছে, আড়তগুলোয় ইলিশের দাম বেশি। যার প্রভাব ঢাকার বাজারে এসে পড়েছে। ঢাকা পর্যন্ত আসতে ট্রান্সপোর্ট খরচের কারণে দাম এক দফা বাড়ে। তারপর ঢাকার আড়তদাররা এ মাছ পাইকারি এবং খুচরা ব্যবসায়ীদের কাছে বিক্রি করেন। এখানে আরেক দফা দাম বাড়ে। তবে গত দুদিন নদীতে বেশি ইলিশ ধরা পড়ায় সামনে দাম কমার আশ্বাস দিয়েছেন ভোলার আড়তদাররা। বর্তমানে ভোলায় দেড় কেজির ওপরে ইলিশের হালি বিক্রি হচ্ছে ৫ হাজার ৫০০ থেকে ৬ হাজার টাকার মধ্যে। ১ কেজি থেকে ১ কেজি ৩০০ গ্রামের কম ওজনের ইলিশ বিক্রি হচ্ছে ৩ হাজার থেকে ৩ হাজার ৫০০ টাকার মধ্যে। ছোট সাইজের ইলিশ বা জাটকার হালি বিক্রি হচ্ছে ৩০০-৩৫০ টাকা করে।
গতকাল রোববার ওয়ারীর স্থানীয় পাইকার মো. আসলাম মিয়া ও মো. রিপন একসঙ্গে এসেছেন যাত্রাবাড়ী সুরেশ্বরী মৎস্য বাজার মার্কেটে। সকাল ১০টা থেকে দুপুর ১২টা পর্যন্ত ১ লাখ ৬০ হাজার টাকায় ২০০ কেজি ইলিশ কিনেছেন তারা। ওয়ারিতে স্থানীয়ভাবে বিক্রির জন্যই তাদের এত ইলিশ কেনা। প্রায় প্রতিদিন তারা যাত্রাবাড়ীর এ আড়তে আসেন মাছ কেনার জন্য। কিছুদিন ধরে বাজারে ইলিশ মাছের সরবরাহ কম থাকায় এবং দাম বেশি হওয়ায় তারা কাক্সিক্ষত পরিমাণ মাছ কিনতে পারেননি। তবে বাজারে আবারো প্রচুর মাছ আসতে শুরু করায় রোববার তারা কাক্সিক্ষত চাহিদা অনুযায়ী মাছ পেয়েছেন। তারা সর্বনিম্ন ৫৯০ টাকা কেজি থেকে সর্বোচ্চ ১ হাজার ২৪০ টাকা কেজি দরে মাছ কিনেছেন।
স্থানীয় খুচরা বাজারে এ মাছ কত দামে বিক্রি করবেন- জানতে চাইলে ওয়ারির স্থানীয় পাইকার মো. আসলাম মিয়া বলেন, এক থেকে দেড় কেজির বেশি ওজনের যেসব মাছ ১২৪০ টাকা করে কেনা হয়েছে, সেগুলো স্থানীয়ভাবে বিক্রি করা যাবে ১ হাজার ৪০০ থেকে ১ হাজার ৫০০ টাকা করে। আর ৫৯০ থেকে ৮০০ টাকায় কেনা ১ কেজির কম ওজনের মাছ বিক্রি করা হবে ৯০০ থেকে ১ হাজার টাকায়।
ইলিশ মাছের ভরা মৌসুমে স্থানীয়ভাবে ইলিশ মাছের দাম বেশি কেন- জানতে চাইলে যাত্রাবাড়ী সুরেশ্বরী মৎস্য বাজার মার্কেট আড়তদার সমিতির সহসভাপতি মো. আব্দুল মান্নান হাওলাদার বলেন, দাম বেশি হওয়ার অনেক কারণ। এর মধ্যে প্রধান কারণ হলো- ভারতে মাছ রপ্তানির জন্য সরকার এলসি খোলার অনুমতি দিয়েছে। সেখানে ৭০০ গ্রাম থেকে দেড় কেজি ওজনের মাছ নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। এ ওজনের মাছের চাহিদা বেশি। এ সাইজের ইলিশ মাছের বড় একটা অংশ ভারতে যাওয়ায় স্থানীয় বাজারে দাম একটু বেশি। তবে বর্তমানে মাছের দাম কেজিতে আগের থেকে ১০০ টাকা কমেছে। বর্তমানে যাত্রাবাড়ীর আটটি মার্কেটে দৈনিক ১৫ থেকে ২০ কোটি টাকার ইলিশ বিক্রি হয়।
তিনি বলেন, বর্তমানে ডিজেলের দাম বাড়তি। সাগরে একটি ট্রলার যখন যায়, সেখানে লোক থাকে ১৫-২০ জন। তাদের খাওয়া-দাওয়াসহ ডিজেল বাবদ ১০-১৫ দিনে খরচ হয় আড়াই থেকে ৪ লাখ টাকা। কিন্তু কাক্সিক্ষত চাহিদা অনুযায়ী মাছ না পাওয়া গেলে আনুপাতিক হারে দাম বেড়ে যায়।
এ ছাড়া আরো একটি কারণ হলো, জেলে থেকে ঢাকার আড়ত পর্যন্ত মাছের দাম নির্ধারণ হয় নিলামের মাধ্যমে। এ নিলামেই মাছের দামের হেরফের হয়ে যায়। তা ছাড়া খুচরা পর্যায়ে ব্যবসায়ীরা তো তাদের ইচ্ছামাফিক দাম হাঁকে।
তিনি আরো বলেন, ৭০০ গ্রাম থেকে ১ কেজির নিচের ওজনের মাছ বিক্রি হচ্ছে কেজি প্রতি ৯০০ টাকা। আর ১ কেজি থেকে ১ কেজি ৩০০ গ্রামের নিচের মাছ বিক্রি হচ্ছে প্রতি কেজি ১ হাজার ১০০ টাকা করে। পাশাপাশি ১ কেজি ৩০০ গ্রাম থেকে দেড় কেজির ওপরের মাছ বিক্রি হচ্ছে প্রতি কেজি ১ হাজার ২৫০ টাকা করে। যাত্রাবাড়ীর আড়তগুলোয় প্রতিদিন ভোর ৬টা থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত মাছ বিক্রি হয়। এখন বাজারে যে পরিমাণ মাছ আসছে, তাতে আগামী কিছুদিনের মধ্যে মাছের দাম কমবে বলে জানান তিনি। দুর্গাপূজার আনুষ্ঠানিকতা ইতোমধ্যে শুরু হয়ে গেছে। তাই বাজারে ইলিশের ব্যাপক চাহিদা। জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সাধারণত ইলিশ ধরার মৌসুম। এ সময় বাজারে নদী এবং সমুদ্রের তাজা ইলিশ পাওয়া যায়। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, দুর্গাপূজা উপলক্ষে এ বছর ২ হাজার ৯৫০ টন ইলিশ ভারতে রপ্তানি করা হবে। আগামী ৩০ সেপ্টেম্বরের মধ্যে প্রতিটি লাইসেন্সধারী ৫০ টন মাছ রপ্তানি করতে পারবেন বলে জানা গেছে।
দুর্গাপূজায় ভারতে মাছের বাজার কেমন- জানতে চাইলে সেভেন স্টার ফিশ প্রসেসিং কোম্পানি লিমিটেডের ব্যবস্থাপক মো. ইমরান হোসেন ইমন ভোরের আকাশকে বলেন, বাজারে যথেষ্ট পরিমাণ মাছ আছে। তবে আমরা যে এলসি খুলছি সে অনুযায়ী দাম পাচ্ছি না। ফলে রপ্তানি করে তেমন লাভ হচ্ছে না।
তিনি বলেন, জেলেরা মাছ ধরে স্থানীয় আড়তদারের কাছে বিক্রি করে। তারা আমাদের কাছে বিক্রি করে। আমরা আবার ভারতে পাঠাচ্ছি। এত হাতবদলের কারণে দাম বেড়ে যাচ্ছে।
তিনি বলেন, দুর্গাপূজায় ভারতে ইলিশ মাছের চাহিদা থাকে অনেক বেশি। কিন্তু পূজা অত্যাসন্ন হওয়ায় এত অল্প সময়ে বিপুল পরিমাণ মাছ ভারতে পাঠানো সম্ভব নয়। তিনি বলেন, মাছ রপ্তানিতে যদি একটু বেশি সময় পাওয়া যেত, তাহলে ব্যবসায়ীরা ভারতে ভালো বাজার পেতেন।
ভোরের আকাশ/আসা