ঢাকা: ৫৫ হাজার বর্গমাইলের এই ভূখণ্ডে জালের মতো বিছিয়ে রয়েছে নদী। নদীমাতৃক দেশের বেশিরভাগ নদীই ব্যাপক ভাঙনপ্রবণ। প্রতিবছর নদীভাঙনের শিকার হয়ে সর্বস্বান্ত হয় লাখো মানুষ। নদীর করাল গ্রাসে কৃষিজমি, বসতবাড়ি, সড়ক, বাঁধ, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, হাটবাজার, কবরস্থান, এতিমখানাসহ অন্যান্য অবকাঠামো ধ্বংস হয়ে যায়।
স্যাটেলাইট ইমেজ ব্যবহার করে দেশে প্রতিবছর নদীভাঙনের পূর্বাভাস দিয়ে থাকে পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের সেন্টার ফর এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড জিওগ্রাফিক ইনফরমেশন সার্ভিসেস (সিইজিআইএস)। তাদের হিসাব মতে, স্বাধীনতার পর থেকে নদীভাঙনের কারণে ২ লাখ হেক্টরের বেশি কৃষিজমি মানচিত্র থেকে মুছে গেছে।
ঋতু বৈচিত্র্যের ধরন অনুযায়ী, জুন মাসের পরপরই বর্ষা আসে। বন্যার পানিতে নদীর দুকূল ছাপিয়ে বিস্তীর্ণ এলাকা প্লাবিত হয়ে পড়ে। চলে জুলাই-আগস্ট পর্যন্ত। কিন্তু সেপ্টেম্বর-অক্টোবর শুরু হলে নদীর পানি যেমন নেমে যেতে থাকে, তেমনি শুরু হয় নদীভাঙন। এখন বিভিন্ন নদীর পানি কমে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বাড়ছে নদীভাঙন। দেশের বিভিন্ন এলাকায় নদীভাঙনের কবলে পড়ে সর্বস্বান্ত হচ্ছেন অনেকেই।
এ বছর সেন্টার ফর এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড জিওগ্রাফিক ইনফরমেশন সার্ভিসেস (সিইজিআইএস) থেকে ভাঙনের পূর্বাভাস দেয়া হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, চলতি মৌসুমে দেশের প্রায় ১ হাজার ৮০০ হেক্টর জমি নদীভাঙনের কবলে পড়তে পারে। পূর্বাভাসে বলা হয়েছে, চলতি মৌসুমে দেশের নদী অববাহিকার ১২ জেলার ১৭টি এলাকা ভাঙনের ঝুঁকিতে রয়েছে। এতে বসতবাড়িসহ সড়ক, বাঁধ, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, হাটবাজার, কবরস্থান, এতিমখানাসহ অন্যান্য অবকাঠামো মুছে যেতে পারে মানচিত্র থেকে। তবে সিইজিআইএসের ভারপ্রাপ্ত নির্বাহী পরিচালক মালিক ফিদা আব্দুল্লাহ খান অবশ্য বলেন, স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ের সঙ্গে বিবেচনা করলে বর্তমান সময়ে দেশে নদীভাঙনের প্রবণতা অনেক কমেছে। মূলত সরকারের নেয়া নানা উদ্যোগের ফলে গত দেড় যুগে নদীভাঙনের ঝুঁকির মাত্রা অনেকটা কমিয়ে আনা গেছে।
তিনি বলেন, এই প্রতিষ্ঠান থেকে নদীভাঙনের পূর্বাভাস দেয়া হচ্ছে ২০০৫ সাল থেকে। প্রথম দিকে নদীভাঙনের মতো এ রকম ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা ছিল অন্তত ৫০টি। এখন তা ১৭টিতে নেমে এসেছে। পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের বিভিন্ন তীর রক্ষা উদ্যোগের ফলে এটা সম্ভব হয়েছে।
সেন্টার ফর এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড গ্রাফিক ইনফরমেশন সার্ভিসের (সিইজিআইএস) সমীক্ষা প্রতিবেদনে দেখা গেছে, ১৯৭৩ সাল থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত দেশের প্রধান নদীগুলোর ভাঙনের কবলে পড়ে ২ লাখ হেক্টর জমি মানচিত্র থেকে মুছে গেছে। তাদের হিসাব অনুযায়ী দেশে সবচেয়ে ভাঙনপ্রবণ নদী হলো যমুনা। ১৯৭৩ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত যমুনা নদীর ভাঙনের কবলে পড়েছে দেশের ৯০ হাজার ৩৬৭ হেক্টর এলাকা। যমুনার ভাঙনের সবচেয়ে বেশি শিকার হয়েছে সিরাজগঞ্জ জেলা। এ সময়ের মধ্য যমুনার গর্ভে বিলীন হয়েছে জেলার ২২ হাজার ৭৮৪ হেক্টর এলাকা। যমুনার সবচেয়ে কম ভা ঙনপ্রবণ এলাকা হলো পাবনা।
গঙ্গা নদীর ভাঙন : পানি উন্নয়ন বোর্ডের হিসাব অনুযায়ী চাঁপাইনবাবগঞ্জের ভেতর দিয়ে প্রবেশের পর আরিচার কাছে যমুনা নদীর সঙ্গে মিলিত হওয়ার আগ পর্যন্ত নদী গঙ্গা হিসেবে পরিচিত। যমুনার মতো এ নদীও যথেষ্ট ভাঙনপ্রবণ। প্রতিবছর এ নদীর ভাঙনের করাল গ্রাসের শিকার হচ্ছে চাঁপাইনবাবগঞ্জ, রাজশাহী, নাটোর, কুষ্টিয়া, পাবনা ও রাজবাড়ী জেলা। ১৯৭৩ সাল থেকে আজ পর্যন্ত এ নদীর গর্ভের বিলীন হয়েছে ২৯ হাজার ৮৪১ হেক্টর এলাকা। তবে পদ্মার ভাঙনের সবচেয়ে বেশি শিকার কুষ্টিয়া জেলা।
পদ্মা নদীর ভাঙন : পানি উন্নয়ন বোর্ডের হিসাব অনুযায়ী আরিচা থেকে গঙ্গা ও যমুনার মিলিত স্রোত পদ্মা নদী হিসেবে পরিচিত, যা চাঁদপুরের কাছে মেঘনায় মিলিত হয়েছে। এ নদীর দৈর্ঘ্য একশ কিলোমিটার। এ নদী ভাঙনপ্রবণ হিসেবে পরিচিত। সিইজিআইএসের সমীক্ষা অনুযায়ী, ১৯৭৩ থেকে ২০১৪ সালের এপ্রিল পর্যন্ত নদী ভাঙনের শিকার হয়েছে ৩৩ হাজার ২২৯ হেক্টর ভূমি এলাকা।
নিম্নপ্রবাহিত মেঘনায় ভাঙন : পদ্মা নদী এবং আপার মেঘনার মিলিত স্রোত নিম্নপ্রবাহিত মেঘনা নদী হিসেবে পরিচিত। এ নদীটি বঙ্গোপসাগরে গিয়ে মিলিত হয়েছে। সিইজিআইএসের হিসাব অনুযায়ী নিম্নপ্রবাহিত মেঘনায় সবচেয়ে বেশি ভাঙনকবলিত এলাকা হিসেবে পরিচিত বরিশাল জেলা। এ সংস্থার হিসেব মতে, ১৯৭৩ থেকে ২০১৪ সালের এপ্রিল পর্যন্ত এ নদীর ভাঙনের শিকার হয়েছে ২৫ হাজার ৮২০ হেক্টর ভূমি এলাকা। সেন্টার ফর এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড গ্রাফিক ইনফরমেশন সার্ভিসেস এর স্যাটেলাইট ইমেজ ব্যবহার করে এই জরিপ পরিচালনা করে থাকে। মূলত তারা বর্ষায় ও বর্ষার পরে ভাঙনপ্রবণ এলাকা জরিপ করে এই পূর্বাভাস দিয়ে থাকে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নদীভাঙন দেশের একটি নিয়মিত দুর্যোগ। নদী ভাঙনে ক্ষয়ক্ষতি ধীরে ধীরে হলেও অন্যান্য আকস্মিক ও প্রলয়ঙ্করী দুর্যোগ অপেক্ষা অধিক ধংসাত্মক ও সুদূরপ্রসারী। তাদের মতে, নদীভাঙনের বেশিরভাগই প্রাকৃতিক। তবে পাশাপাশি মানুষের কারণেও প্রতিবছর নদীভাঙনের শিকার হতে হচ্ছে। দেশের আর্থসামাজিক, ভৌগোলিক ও পরিবেশগত পটভূমিতে এটি চলমান সমস্যা। এর ফলে প্রতিবছর প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে ১০ লাখ লোক ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। আশ্রয়হীন হচ্ছে প্রায় ১ লাখ ৩০ হাজার মানুষ। দেশের বিখ্যাত জলবায়ু বিশেষজ্ঞ ড. আতিক রহমান বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবের কারণেই নদীভাঙনের মতো দুর্যোগ বাড়ছে। তিনি বলেন, বিশ^ উষ্ণায়ন বেড়ে যাওয়ায় হিমালয়ের বরফ দ্রুত গলছে। বরফ গলা পানি পলি বহন করে নিয়ে দেশের নদী ভরাট করছে। ফলে বিস্তীর্ণ এলাকা প্লাবিত হচ্ছে। পানি নেমে যাওয়ার সময় নদীর পাড় ভেঙে সর্বস্বান্ত হচ্ছে সাধারণ মানুষ।
যেসব নদী ভাঙনপ্রবণ : পানি উন্নয়ন বোর্ড জানায়, বাংলাদেশের অভ্যন্তর দিয়ে ২৫৪টি আন্তর্জাতিক নদী প্রবেশ করেছে। এর মধ্যে প্রধান নদীগুলো হলো- গঙ্গা, যমুনা, পদ্মা ও মেঘনা। এ চারটি নদীই সবচেয়ে বেশি ভাঙনের শিকার হচ্ছে। দেশের মধ্যে সবচেয়ে ভাঙনপ্রবণ নদী হলো যমুনা। এ ছাড়া মেঘনা, পদ্মা, তিস্তা, ধরলা, আত্রাই, পুরাতন ব্রহ্মপুত্র, কুশিয়ারা, খোয়াই, সুরমা, মনু, জুরী, সাঙ্গু, ধলাই, গোমতী, মাতামুহুরি, মধুমতী, সন্ধ্যা, বিশখালী প্রভৃতি নদীও যথেষ্ট ভাঙনপ্রবণ। দেশের এসব নদীর প্রায় ১৩০ স্থানে প্রতিবছর উল্লেযোগ্যভাবে নদীভাঙনের ঘটনা ঘটছে। যমুনা নদী ভাঙনের সবচেয়ে বেশি শিকার হচ্ছে সিরাজগঞ্জ জেলা, গঙ্গায় কুষ্টিয়া জেলা, পদ্মায় শরীয়তপুর জেলা এবং নিম্নপ্রবাহিত মেঘনার শিকার হচ্ছে বরিশাল জেলা। বিশেষজ্ঞরা বলেন, নদীর পাড় গঠনের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের কারণে সবচেয়ে বেশি ভাঙনপ্রবণ হলো যমুনা নদী।
ভোরের আকাশ/আসা