logo
আপডেট : ১ অক্টোবর, ২০২২ ১৩:১৪
পাঁচ দিনব্যাপী শারদীয় দুর্গোৎসব শুরু
নিজস্ব প্রতিবেদক

পাঁচ দিনব্যাপী শারদীয় দুর্গোৎসব শুরু

ঢাকা: মহাষষ্ঠীর মধ্য দিয়ে আজ থেকে পাঁচ দিনব্যাপী শুরু হচ্ছে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব শারদীয় দুর্গাপূজা। ৫ অক্টোবর বিজয়া দশমীতে প্রতিমা বিসর্জনের মধ্যদিয়ে শেষ হবে সার্বজনীন এ উৎসব। অসুর শক্তি বিনাশকারী দেবী দুর্গার আরাধনার প্রস্তুতি ইতোমধ্যে শেষ হয়েছে। ঢাকঢোল, কাঁসা এবং শঙ্খের আওয়াজে মুখর হয়ে উঠেছে বিভিন্ন মণ্ডপ। স্থাপন করা হয়েছে দেবীর প্রতিমা। সাজসজ্জার কাজও শেষ পর্যায়ে। দুই বছর করোনার বিধিনিষেধের পর এবারের দুর্গোৎসবকে কেন্দ্র করে দেশজুড়ে রীতিমতো সাজসাজ রব। বইছে উৎসবের আমেজ। ঢাকাসহ জেলা-উপজেলায় পূজার শেষ মুহূর্তের কেনাকাটা চলছে।

 

দুর্গোৎসব উপলক্ষে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পৃথক বাণী দিয়েছেন। এ ছাড়া বিরোধী দল জাতীয় পার্টি, বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও সংগঠনের নেতারা দুর্গাপূজা উপলক্ষে দেয়া বাণীতে সবাইকে শুভেচ্ছা জানিয়েছেন।

 

বিশুদ্ধ পঞ্জিকা অনুযায়ী ১ অক্টোবর শনিবার ষষ্ঠী, ২ অক্টোবর সপ্তমী, ৩ অক্টোবর অষ্টমী, ৪ অক্টোবর নবমী ও ৫ অক্টোবর বিজয়া দশমী। এবার দেবী দুর্গা হাতির পিঠে চড়ে পৃথিবীতে আসবেন। এতে ঝড়-বৃষ্টি হবে, শস্য-ফসল উৎপাদন বৃদ্ধি পাবে। অন্যদিকে বিদায় নেবেন নৌকায়। যার ফল হচ্ছে, বন্যা হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। যাওয়ার লক্ষণ শুভ না হলেও ভক্তের বিশ্বাস, দেবী মঙ্গলময়ী। তিনি জগতের মঙ্গলই করবেন। সন্তানদের আশীষ দেবেন দু’হাত ভরে।

 

আজ সকাল সাড়ে ৭টায় কল্পারম্ভ এবং বোধন আমন্ত্রণ ও অধিবাসের মধ্যদিয়ে উৎসবের প্রথম দিন ষষ্ঠী পূজা সম্পন্ন হবে। এদিন সকাল থেকে চণ্ডীপাঠে মুখর থাকবে সব মণ্ডপ এলাকা। উৎসবের দ্বিতীয় দিন আগামীকাল রোববার মহাসপ্তমীর পূজা অনুষ্ঠিত হবে সকাল সাড়ে ৬টায়। সোমবার মহাঅষ্টমীর পূজা অনুষ্ঠিত হবে সকাল সাড়ে ৯টায় এবং বেলা ১১টায় অনুষ্ঠিত হবে কুমারী পূজা। সন্ধিপূজা শুরু হবে বিকেল ৪টা ৪৪ মিনিটে এবং শেষ হবে বিকেল সাড়ে ৫টার মধ্যে।

 

মঙ্গলবার সকাল সাড়ে ৬টায় শুরু হবে নবমী পূজা। পুষ্পাঞ্জলি দেয়া হবে সকাল সাড়ে ১০টায়। পরদিন বুধবার সকাল ৬টা ৩০ মিনিটে দশমী পূজা শুরু, পুষ্পাঞ্জলি সকাল ৮টায় এবং পূজা সমাপন ও দর্পণ বিসর্জন হবে সকাল ৮টা ৫০ মিনিটের মধ্যে।

 

বাংলাদেশ পূজা উদযাপন পরিষদ সূত্রে জানা যায়, এসব মণ্ডপে শারদীয় উৎসব নির্বিঘ্নে উদযাপন করার জন্য প্রশাসনের পাশাপাশি প্রতিটি পূজা উদযাপন কমিটিও নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। প্রতিটি মণ্ডপে লাগানো হচ্ছে সিসিটিভি ক্যামেরা এবং স্বেচ্ছাসেবক দলের কমিটি করা হচ্ছে মণ্ডপের নিরাপত্তার জন্য।

 

অন্যদিকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর সূত্রে জানা যায়, এ বছরের শারদীয় দুর্গোৎসব শান্তিপূর্ণভাবে যাতে সনাতন ধর্মাবলম্বীরা উদযাপন করতে পারে, সে জন্য কয়েক স্তরবিশিষ্ট নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশের মণ্ডপগুলোতে নিরাপত্তা নিশ্চিতে র‌্যাব ও পুলিশ থাকবে। প্রতিটি মণ্ডপে পূজা চলাকালে নিরাপত্তার কাজে আনসার সদস্যরা মোতায়েন থাকবেন।

 

ঢাকেশ্বরী জাতীয় মন্দির, রমনা কালীমন্দির, সিদ্ধেশ্বরী মন্দিরের দুর্গা মণ্ডপের মতো স্থায়ী মণ্ডপগুলোতে প্রতিমা স্থাপনের কাজ হয়ে গেছে। শুক্রবার বিকেলে দেখে গেছে, পুরান ঢাকার শাঁখারিবাজার, তাঁতীবাজার ও সূত্রাপুরসহ বিভিন্ন অস্থায়ী মণ্ডপে চূড়ান্ত প্রস্তুতি চলছে। দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে নির্মাণ করা প্রতিমা ট্রাকে করে এনে স্থাপনা করা হচ্ছে মণ্ডপগুলোতে।

 

শাঁখারি ও তাঁতীবাজার এলাকায় পূজার সাজসজ্জা ও প্রয়োজনীয় পণ্য বিক্রির দোকানগুলোতে দম ফেলার সময় নেই বিক্রেতাদের। দেবীর গহনা, হাতের শাঁখা-পলা, মালা, নূপুর, মুকুট, তীর, ধনুক, চক্র, গদা, খড়্গ, ত্রিশূল, অসুরের অস্ত্র, দেবীর শাড়ি, ব্লাউজের কাপড়, মাথার চুল কিনতে রাজধানীসহ আশপাশের বিভিন্ন এলাকা থেকে শাঁখারীবাজারে ভিড় করছেন আয়োজকরা। সাজঘর, পোশাক ঘর, নাগ ভাণ্ডার, পদ্মভাণ্ডার, লক্ষ্মীভাণ্ডারসহ বিভিন্ন দোকানে থরে থরে সাজানো আছে এসব জিনিস। ক্রেতাদের চাহিদা মেটাতে রীতিমতো হিমশিম খেতে হচ্ছে দোকানদারদের।

 

পণ্ডিত অসিত চক্রবর্তী বলেন, বোধনের মধ্য দিয়ে আজ শনিবার শুরু হচ্ছে হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের প্রধান ধর্মীয় উৎসব শারদীয় দুর্গোৎসব। তিথি অনুযায়ী ওই দিন সায়ংকালে (সন্ধ্যায়) অনুষ্ঠিত হবে দেবী দুর্গার বোধন, আমন্ত্রণ ও অধিবাস। মন্দির ও মণ্ডপে স্থাপন করা হবে বোধনের ঘট। ভক্তের ভক্তি, নিষ্ঠা আর পূজার আনুষ্ঠানিকতায় মাতৃরূপে দেবীদুর্গা অধিষ্ঠিত হবেন মণ্ডপে মণ্ডপে। ভক্তের প্রার্থনার মধ্য দিয়ে জাগরিত হবে বিশ্ব থেকে অশুভকে বিদায় দেয়ার পণ।

 

সনাতন সম্প্রদায়ের বিশ্বাস, প্রতিবছর বিভিন্ন বাহনে সপরিবারে শ্বশুরবাড়ি কৈলাস থেকে কন্যারূপে দেবী মর্ত্যলোকে (পৃথিবী) আসেন বাপের বাড়ি বেড়াতে। দেবীর ১০ হাত। দেবীকে আমরা দেখি যুদ্ধের সাজে। যুদ্ধের সময় দেবীর ডানদিকের পাঁচটি বাহুতে ওপর থেকে নিচে থাকে ত্রিশূল, খড়গ, চক্র, তীক্ষ্ণ বাণ ও শক্তি নামক অস্ত্র। বাম দিকের পাঁচটি বাহুতে নিচ থেকে ওপরে খেটক (ঢাল), ধনুক, নাগপাশ, আঙ্কুশ, ঘণ্টা। অস্ত্র দিয়ে তিনি যুদ্ধ করে দুষ্টের দমন আর শিষ্টের পালন করেন। দেবী যখন মমতাময়ী মায়ের রূপ নেন তখন তার হাতে থাকে কল্যাণের প্রতীক পদ্ম, শঙ্খসহ দশটি অস্ত্র। দেবীর গায়ের রং অতসী ফুলের মতো উজ্জ্বল। পূর্ণিমার চাঁদের মতো তার মুখ। তিনি ত্রিনয়না। মাথার একপাশে বাঁকা চাঁদ। সিংহ তার বাহন। দেবীর ডানে ধনদাত্রী লক্ষ্মী, পাশে সিদ্ধিদাতা গণেশ। দেবীর বামপাশে বিদ্যাদায়িনী সরস্বতী এবং তার পাশে শৌর্য-বীর্যের প্রতীক কার্তিক।

 

পুরাণ মতে, রাজা সুরথ প্রথম দেবী দুর্গার আরাধনা শুরু করেন। বসন্তকালে তিনি এই পূজা আয়োজন করেছিলেন বলে দেবীর এ পূজাকে বাসন্তী পূজা বলা হয়। কিন্তু রাজা রাবণের হাত থেকে স্ত্রী সীতাকে উদ্ধারের জন্য রাজা দশরথের পুত্র রামচন্দ্র শরৎকালে দুর্গাপূজার আয়োজন করেছিলেন। তাই শরৎকালের এই পূজাকে হিন্দুমতে অকাল বোধনও বলা হয়। বাঙালির হৃদয়ে শরৎকালের দুর্গার অধিষ্ঠান কন্যারূপে।

 

বাংলাদেশ পূজা উদযাপন পরিষদের তথ্য অনুযায়ী, গত বছর দেশে দুর্গাপূজার সংখ্যা ছিল ৩২ হাজার ১১৮টি। এবার এ সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৩২ হাজার ১৬৮টিতে, যা গত বছরের চেয়ে ৫০টি বেশি। ঢাকা মহানগরে পূজার সংখ্যা ২৪২টি- যা গত বছরের চেয়ে ৭টি বেশি

 

পূজা উদযাপন পরিষদের সভাপতি জে এল ভৌমিক বলেন, বাঙালি হিন্দুদের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব দুর্গাপূজা শনিবার থেকে শুরু হবে, যা আগামী ৫ অক্টোবর প্রতিমা বিসর্জনের মধ্য দিয়ে শেষ হবে।

 

তিনি বলেন, ‘গত বছরের ঘটনার প্রেক্ষাপটে এ বছর সরকার চাচ্ছে, কোনো অবস্থাতেই যেন কোনো অঘটন না ঘটে। আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলো গত বছরের তুলনায় এবার অনেক বেশি সক্রিয়। আমাদের ৩২ হাজার ১৬৮টি মন্দিরের সুরক্ষা দেয়ার জন্য আমরা এ বছর প্রত্যেক মন্দিরে স্বেচ্ছাসেবক নিয়োগ করছি, যারা রাতেও পাহারা দেবে।’

 

দুর্গোৎসব উপলক্ষে বাংলাদেশ পূজা উদযাপন পরিষদ, মহানগর সার্বজনীন পূজা উদযাপন কমিটির নেতারা হিন্দু সম্প্রদায়সহ ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে দেশের সব নাগরিককে শারদীয় দুর্গাপূজার শুভেচ্ছা জানিয়েছেন।

 

সম্প্রীতি বাঙালির চিরকালীন ঐতিহ্য : রাষ্ট্রপতি

পাঁচ দিনব্যাপী দুর্গোৎসব উপলক্ষে দেয়া বাণীতে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ বলেন, বাঙালি হিন্দুদের প্রধান ধর্মীয় উৎসব দুর্গাপূজা। দুর্গাপূজার সঙ্গে মিশে আছে চিরায়ত বাংলার ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি। আবহমানকাল ধরে এদেশের হিন্দু সম্প্রদায় বিপুল উৎসাহ-উদ্দীপনা ও উৎসবমুখর পরিবেশে নানা উপাচার ও অনুষ্ঠানাদির মাধ্যমে দুর্গাপূজা উদযাপন করে আসছে। দুর্গাপূজা কেবল ধর্মীয় উৎসব নয়, সামাজিক উৎসবও। দুর্গোৎসব উপলক্ষে ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব, পরিবার-পরিজন, পাড়া-প্রতিবেশী একত্রিত হন, মিলিত হন আনন্দ-উৎসবে। তাই এ উৎসব সর্বজনীন। এ সর্বজনীনতা প্রমাণ করে, ধর্ম যার যার, উৎসব সবার।

 

তিনি বলেন, করোনা মহামারির ধাক্কা কাটিয়ে উঠতে না উঠতেই রাশিয়া-ইউক্রেন সংকটের কারণে গোটা বিশ্বের অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। বিশ্বব্যাপী দেখা দিয়েছে মূল্যস্ফীতির ঊর্ধ্বগতি। এর ফলে নিম্ন আয়ের অনেক মানুষ নানা সীমাবদ্ধতার মাঝে দিনাতিপাত করছেন।

রাষ্ট্রপতি সমাজের দুস্থ ও অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়ানোর জন্য ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সবার প্রতি আহ্বান জানান।

 

এই দেশ আমাদের সবার : প্রধানমন্ত্রী

 

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির বন্ধন অটুট রেখে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ক্ষুধা-দারিদ্র্যমুক্ত ও সুখী-সমৃদ্ধ স্বপ্নের সোনার বাংলাদেশ গড়ে তোলার আহ্বান জানিয়েছেন।

 

তিনি বলেন, ‘আসুন, মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির বন্ধন অটুট রেখে আমরা ঐক্যবদ্ধভাবে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ক্ষুধা-দারিদ্র্যমুক্ত ও সুখী-সমৃদ্ধ স্বপ্নের সোনার বাংলাদেশ গড়ে তুলি। শারদীয় দুর্গাপূজা উপলক্ষে এক বাণীতে এ আহ্বান জানান প্রধানমন্ত্রী। এ উপলক্ষে তিনি দেশের হিন্দু ধর্মাবলম্বী সব নাগরিককে আন্তরিক শুভেচ্ছা জানিয়ে বলেন, দুর্গাপূজা শুধু হিন্দু সম্প্রদায়ের উৎসবই নয়, এটি এখন সার্বজনীন উৎসব। অশুভ শক্তির বিনাশ এবং সত্য ও সুন্দরের আরাধনা শারদীয় দুর্গোৎসবের প্রধান বৈশিষ্ট্য।

 

শেখ হাসিনা বলেন, ‘আবহমানকাল ধরে বাংলাদেশ সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দেশ। ‘ধর্ম যার যার, উৎসব সবার’- এ মন্ত্রে উজ্জীবিত হয়ে বাংলাদেশে আমরা সব ধর্মীয় উৎসব একসঙ্গে পালন করি। আমাদের সংবিধানে সব ধর্ম ও বর্ণের মানুষের সমান অধিকার সুনিশ্চিত করা হয়েছে। সবাই মিলে মুক্তিযুদ্ধ করে বাংলাদেশ স্বাধীন করেছি। এই দেশ আমাদের সবার। বাংলাদেশ ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সব মানুষের নিরাপদ আবাসভূমি। প্রত্যেকে যার যার ধর্ম স্বাধীনভাবে পালন করছে। বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার জাতি-ধর্ম-বর্ণ-গোষ্ঠী নির্বিশেষে সবার উন্নয়ন করে যাচ্ছে। সব ধর্মের মানুষ সমভাবে উন্নয়নের সুফল উপভোগ করছে।

 

ভোরের আকাশ/আসা