logo
আপডেট : ১ অক্টোবর, ২০২২ ১৪:৩৬
শোষণের শিকার ৩ কোটি প্রান্তিক মানুষ
জাফর আহমদ

শোষণের শিকার ৩ কোটি প্রান্তিক মানুষ

ঢাকা: ক্ষুদ্রঋণ বিতরণের ক্ষেত্রে দেশে বড় ধরনের জাগরণ তৈরি হয়েছে। সুনাম ছড়িয়েছে দেশে দেশে। কিন্তু ঋণ নেয়া স্বল্প আয়ের প্রান্তিক মানুষ শোষণের শিকার হচ্ছেন। এ ঋণের সুদহার কমানোর পথ বের করার তাগিদ দিয়েছেন অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিব শেখ মোহাম্মদ সলিমুল্লাহ। তিনি বলেন, ক্ষুদ্রঋণ গ্রহীতা সবাই পল্লি ও শহরের নিম্ন আয়ের গরিব ও প্রান্তিক মানুষ। সংখ্যায় এসব মানুষ সবচেয়ে বেশি। তারা ঋণ নেন কম, সুদ দিয়ে থাকেন সর্বোচ্চ ২৪ শতাংশ। পরিচালন ব্যয়সহ আরো কী কী পথ অবলম্বন করলে উচ্চ এ সুদ কমানো যায়, তা খুঁজে বের করতে হবে।

 


ক্ষুদ্রঋণের (মাইক্রো ক্রেডিট) সুদহার সর্বোচ্চ। ঋণ বিতরণের সময়েই ঋণের টাকা থেকে কিস্তির টাকা কেটে রাখা হয়। অর্থাৎ ঋণের টাকা থেকেই ফেরত দেয়ার টাকাসহ ২৪ শতাংশ হারে সুদ দেয়া শুরু হয়ে যায়। অন্যদিকে ব্যাংক ও নন-ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ঋণের সুদহার কম; ৯ শতাংশ। এসব ঋণে ৩ থেকে ৬ মাস গ্রেসটাইম থাকে, অর্থাৎ ৩ থেকে ৬ মাস পরে ঋণের কিস্তি দেয়া শুরু হয়। সুযোগ নিয়ে বড় ঋণে যেমন ফেরত দেয়ার হার কম, খেলাপি বেশি। অন্যদিকে ক্ষুদ্র ঋণের প্রায় ৩ কোটি গ্রাহক সর্বস্বান্ত হচ্ছে।

 

বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী মোট ঋণের পরিমাণ ১৩ লাখ ৯৮ হাজার ৫৯২ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ১ লাখ ২৫ হাজার ২৫৭ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের প্রায় ৯ শতাংশ। এর বাইরে আরো প্রায় ৪০ হাজার কোটি টাকা অবলোপন বা মূল হিসাবে রাখা হয়েছে। সবমিলে ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণের হার ১৫ শতাংশ ছাড়াবে। এর মধ্যে ১২টি ব্যাংকের খেলাপি ঋণের হার ১২ থেকে ৯৮ শতাংশ পর্যন্ত। টাকা নিয়ে ফেরত না দেয়া, দুর্নীতি, অব্যবস্থাপনা ও ঋণ কেলেঙ্কারির কারণে বেসিক, আইসিবি ইসলামী, পদ্মা ব্যাংক, ন্যাশনাল ব্যাংক অব পাকিস্তানসহ কয়েকটি ব্যাংক নামমাত্র টিকে আছে। এতে একদিকে লাখ লাখ আমানতকারীর আমানত অনিশ্চয়তায়; অন্যদিকে অর্থনীতিতে পড়েছে নেতিবাচক প্রভাব।

 

ক্ষুদ্রঋণের নিয়ন্ত্রক সংস্থা মাইক্রোক্রেডিট রেগুলেটরি অথরিটির (এমআরএ) সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, দেশের শহর ও পল্লি অঞ্চলের ২ কোটি ৭৮ লাখ গ্রাহক প্রায় ১ লাখ ৫১ হাজার ২০০ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছে। এর মধ্যে খেলাপি ঋণের হার ২ শতাংশের নিচে। ৭৪৬ ক্ষুদ্রঋণ সংস্থার মোট ৩ কোটি ৫২ লাখ গ্রাহক রয়েছে। এসব গ্রাহকের সঞ্চয়স্থিতি ৪২ হাজার ২৩৯ কোটি টাকা। এনজিও থেকে নেয়া ঋণের ২৮ শতাংশই গ্রাহকদের।

 

ক্ষুদ্রঋণ সংস্থার সূত্রগুলো জানায়, ক্ষুদ্র ঋণ বিতরণে গ্রুপের সদস্যদের সম্মতির ভিত্তিতে একেকজন গ্রাহককে ঋণের টাকা দেয়া হয়। কোনো সদস্য ঋণ নেয়ার পর পরিশোধ না করলে গ্রুপের অন্য সদস্যদের সহযোগিতায় টাকা আদায় করা হয়। প্রয়োজনে সদস্যরা সমবেতভাবে শক্তি প্রয়োগ করে ঋণের টাকা আদায় করে। নাটোরের লালপুরের বাগাতিপাড়ার ক্ষুদ্র ঋণগ্রহীতা ফোনে ভোরের আকাশকে বলেন, এক এনজিও বা ক্ষুদ্রঋণ সংস্থা থেকে টাকা নিয়ে সময়মতো পরিশাধ করতে অন্য সংস্থা থেকে টাকা নেয়। ঋণ নিয়ে কখনো কখনো কিস্তির টাকা পরিশোধে ব্যর্থ হলে গা ঢাকা দেয়। ক্ষুদ্রঋণ সংস্থা বা এনজিওর ঋণগ্রহণ ও পরিশোধে সারা দেশেই একই চিত্র।

 

অন্যদিকে ব্যাংকের ঋণ ব্যবস্থাপনায় ভিন্ন চিত্র। ঋণের সুদহার যেমন কম, বন্ধকীও অধিকাংশ ক্ষেত্রে ভুয়া, অপ্রতুল। ব্যাংকের টাকা নিয়ে পালিয়ে গেলে পরে আর খোঁজ করে পাওয়া যায় না। বন্ধক রাখা সম্পত্তি বিক্রি করে ঋণের অর্ধেক টাকা হয় না। মামলা করলেও বছরের পর ঘুরতে হয়। বেসিক ব্যাংকের ঋণ কেলেঙ্কারির ক্ষেত্রে এমন ঘটনা ঘটেছে। সোনালী ব্যাংকের ক্ষেত্রেও ঘটছে একই ঘটনা। হলমার্ক কোনো বন্ধক রাখা ছাড়াই ভুয়া কোম্পানির নামে ঋণপত্র খুলে টাকা নিয়ে গেছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে ব্যাংকের যোগসাজশে এমন ঘটনা ঘটানো হয়েছে। বিডিবিএল, জনতা ব্যাংক, আইসিবি ইসলামী, পিপলস লিজিং, ইন্টারন্যাশনাল ফাইন্যান্স অ্যান্ড লিজিং কোম্পানিতে এমন ঘটনা ঘটেছে।

 

এ বিষয় ইন্টারন্যাশনাল ফাইন্যান্স অ্যান্ড লিজিংয়ের আমানতকারীর টাকা উদ্ধারে উচ্চ আদালতের নিয়োজিত চেয়ারম্যান মো. নজরুল ইসলাম খান বলেন, ঋণ নেয়ার সময় অনেক ক্ষেত্রেই প্রতিষ্ঠানকে যাচাই-বাছাই করা হয়নি। মর্ডগেজ রাখার ক্ষেত্রেও সঠিক মূল্য নিরূপণ করা হয়নি। অনেকে ঋণ নিয়ে দেশের বাইরে চলে গেছে। আর প্রতিষ্ঠানের খারাপ জানার পর টাকা ফেরত দেয়ার মতো সক্ষমরাও আর টাকা ফেরত দিচ্ছে না। টাকা ফেরত না দিতে প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধেই মামলার ঘটনাও ঘটেছে। উল্লেখ্য, অনিয়ম, দুর্নীতি, অব্যবস্থাপনা ও ঋণ কেলেঙ্কারিতে প্রতিষ্ঠানটির ৪ হাজার ১১২ কোটি ঋণের মধ্যে ৩ হাজার ১৫২ কোটি টাকাই খেলাপি হয়ে গেছে। যে ঋণ নিয়মিত আছে, সেটাও ফেরত দিতে চাইছে না।

 

এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের দায়িত্বশীল সূত্র জানায়, যেসব ব্যাংক ও নন-ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠানের খেলাপি ঋণের হার বেশি, সেসব ব্যাংকের ক্ষেত্রে প্রায়ই এ ঘটনা ঘটেছে। খাতা-কলমে ঋণ থাকলেও আদায় হয় না। বছরের পর বছর ঋণের টাকা না দিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে, ক্ষেত্রবিশেষে খেলাপি সম্পর্কিত কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশনার বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে রিট করে আবারো ঋণ নিচ্ছে, যা ক্ষুদ্রঋণের ক্ষেত্রে অসম্ভব। ক্ষুদ্রঋণের গ্রাহক এটা ভাবতেও পারে না।

 

যারা ক্ষুদ্রঋণ নিচ্ছেন, তারা মহাজনি আরো বেশি সুদের বিকল্প হিসেবে নিয়ে থাকেন। যেখানে ব্যাংক পৌঁছে না, গ্রামের মহাজনই ভরসা। সুদহার কমানোর মধ্য দিয়ে ক্ষুদ্রঋণ সংস্থাকে সংকটের মধ্যে ফেলে দিলে পল্লি অঞ্চলের এসব ঋণগ্রহীতা আবারো মহাজনি ঋণের খপ্পরে পড়বে বলে মনে করেন বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন। তিনি ভোরের আকাশকে বলেন, প্রথমত ক্ষুদ্র ঋণের সুদহার কমানোর প্রস্তাবের আগে আরো বেশি গবেষণা করতে হবে; দ্বিতীয়ত ক্ষুদ্র ঋণগ্রহীতার কাছে ব্যাংক পৌঁছায় না; মহাজনি ঋণই ভরসা। এর চেয়ে খারাপ হবে কিনা! এবং তৃতীয়ত, সুদহার কমানো হলে এর ইম্প্যাক্ট কী হবে সেটাও দেখতে হবে।

 

ভোরের আকাশ/আসা