ঢাকা: প্রতি বছর অক্টোবর মাসের প্রথম সোমবার বিশ্ব শিশু দিবস পালন করে থাকে। এ বছর আজ সোমবার (০৩ অক্টোবর) সারা দেশে পালিত হবে বিশ্ব শিশু দিবস। একইসঙ্গে শিশুর অধিকার, সুরক্ষা এবং শিশুর উন্নয়ন ও বিকাশে সংশ্লিষ্ট সকলকে অধিকতর উদ্যোগী ও সচেতন করার লক্ষ্যে ৪ থেকে ১১ অক্টোবর পর্যন্ত পালন করা হবে শিশু অধিকার সপ্তাহ। মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয় প্রতি বছরের মতো এবছরও দেশব্যাপী যথাযথ মর্যাদায় বিশ্ব শিশু দিবস ও শিশু অধিকার সপ্তাহ উদযাপন করার লক্ষ্যে বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করেছে। বিশ্ব শিশু দিবস ২০২২ এর প্রতিপাদ্য ‘গড়বে শিশু সোনার দেশ, ছড়িয়ে দিয়ে আলোর রেশ’। তবে স্লোগান এটা হলেও বাস্তবতা ভিন্ন। নানা করণে এখন বিপন্ন ছেলে-মেয়েদের শৈশব।
শৈশবকালকে বলা হয় জীবনের শ্রেষ্ঠ সময়। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে মানুষের ভাবনায় পরিবর্তন আসে। আসে নানা দায়িত্ব। সুখস্মৃতির পাশাপাশি জীবনের সঙ্গে যুক্ত হয় নানা ধরনের বিরহব্যাথা। সময় গড়ানোর সঙ্গে বদলে যায় রঙিন জগৎ। সবাইকেই বাস্তবতায় মিশে যেতে হয়। চোখ থেকে খসে পড়ে রঙিন চশমা। এখন সময় বদলেছে। শিশুরা বুঝতে পারেনা জীবনের সোনালি সময় কী। কাকে বলে শৈশবকাল। কারণ তাদের শৈশব এখন সুতায় বাঁধা প্রজাপতির মতো। নিদিষ্ট গণ্ডির মধ্যেই সীমাবদ্ধ যার পৃথিবী।
নব্বই বছরের একজন বৃদ্ধকে যদি ১০ বছর আগে কী হয়েছিলো জানতে চাওয়া হয় তিনি সব ঠিক ঠিক বলতে পারবেননা। কিন্তু শৈশব স্মৃতি আওড়াতে বললে অবলিলায় বলতে পারেন। কারণ এ স্মৃতি কেউ ভুলতে পারেনা। জীবনের সোনালি সময়টা বাঁধা থাকে স্মৃতির ফ্রেমে। কিন্তু এখনকার শিশুরা অতিবাহিত করছে এক ভিন্ন শৈশব। তাদের খেলাধুলা নেই, বিনোদন নেই, নেই বিন্দুমাত্র অবসর। গাঁদা গাঁদা বই, স্কুল, কোচিং, হাউস টিউটর, গানের ক্লাস, আরবি শিক্ষক, অঙ্কন শিক্ষক আর হোম ওয়ার্ক এসব করতে করতে শিুদের সময় চলে যায়। শহর দূরের কথা গ্রামের শিশুরা এখন জানে না কখন সূর্য উঁকি দিচ্ছে আর কখন অস্ত যাচ্ছে। সবুজ পাতার মধ্যে কীভাবে দুপুরের রোদ্দুরটুকু হারিয়ে যায় এর খবরো জানে না তারা। তারা জানে না কাকে বলে ডাঙ্গুলি, কানামাছি, দাঁড়িয়াবান্ধা,হাডুডু, গোল্লাছুট, বউচি খেলা। স্মার্ট ফোন, অভিভাবকদের কড়া রুটিন, শিক্ষকদের চাপ সবমিলে এক বিবর্ণ শৈশব তাদের।
শৈশবকালের নিদ্দিষ্ট কোন বয়স পরিসীমা নেই। সাধারণত জন্মের পর থেকে শৈশবকাল শুরু হয় এবং বয়ঃসন্ধিকালে শেষ হয়। বিশে^র অনেক দেশে শৈশবকালের একটি বয়স সীমা বেধে দেয়া হয়েছে যা অতিক্রম করার পর তারা পূর্নবয়স্ক হিসাবে বিবেচিত হয়। এ বয়স সীমা বিভিন্ন দেশভেদে ১৫-২১ বছরের মধ্য কিন্তু অধিকাংশ দেশে তা ১৮ বছর ।
শৈশব মানেই চোখের সামনে ভেসে আসে কতনা মধুর স্মৃতি। লুকোচুরি খেলা থেকে শুরু করে, গোল্লাছুট, চি-বুড়ি, কুতকুত, দাঁড়িয়া খেলা, সাতধাপ্পা, চোর-পুলিশ খেলা, রাস্তা-পাকে খেলার মতো মজার সব খেলার স্মৃতি। যুগের পরিক্রমায় কিংবা সময়ের আবর্তনে নয়তো মানুষের চিন্তা-চেতনার উন্নতি যে কারণেই হোক না কেনো নিজেদের অজান্তে আমরা হারিয়ে ফেলেছি অনেক মূল্যবান কিছু। আধুনিকতা আমাদের স্মৃতির পাতাকে অন্তসারশূন্য অবস্থায় নিয়ে ঠেকাতে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে নিরলসভাবে।
আগের প্রজন্মের শৈশব : চল্লিশ, পঞ্চাশ, সত্তর বা আশির দশকের কথা না হয় বাদই গেলো। নব্বই দশকের ছেলে মেয়েদের শৈশব ছিল সোনালি শৈশব। হাজারো প্রাকৃতিক সমারোহে আবৃত ছিল সে শৈশব। তখনকার সময়ে জন্ম নেয়া প্রতিটি মানুষের কাছে শৈশবের গল্প মানেই সকাল-সন্ধ্যায় দাদা-দাদির কোলে বসে নানা রকম মজার গল্প শোনা। বিকেলে বাড়ির সামনে পড়ে থাকা জমিতে পাড়ার সব ছেলেমেয়েরা জড়ো হয়ে লুকোচুরি, গোল্লাছুট, চি-বুড়ি, কুতকুত, সাতধাপ্পা, চোর-পুলিশ খেলা, রাস্তা-পাকে খেলা। আবার শিমুল ফুল কুড়াতে যাওয়া, ফটকল ফোটানোর জন্য। পাড়ার কারো কিংবা নিজেদের কুলগাছের কুল-বরই কুড়ানো। শীতের সকালে ঘুম থেকে উঠেই খেজুরগাছ থেকে গাছির রস পাড়ার দৃশ্য দেখতে ছুটে যাওয়া। গরমের দিনে পাড়ার নামকরা মিষ্টি গাছের আম কুড়ানো। পাড়ার অন্য ছেলেমেয়েদের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে কে আগে যেতে পারে। দুপুরে পাড়ার সব ছেলেমেয়েরা এক হয়ে নদীতে কিংবা পুকুরে লাফালাফি, ঝাঁপাঝাঁপি করা। মা, কিংবা বাবার তাড়া খেয়ে পানি থেকে উঠে বাড়ি দৌড়ানো। খেলার মাঠে গিয়ে ক্রিকেটের সময় ক্রিকেট খেলা, ফুটবলের সময় ফুটবল। সন্ধ্যায় পড়াশোনা, টিভি দেখা তার পর ঘুম।
বর্তমান প্রজন্মের শৈশব : ভালো রেজাল্ট আর শিক্ষিত এ দুই তকমা লাগানোর জন্য প্রতিটি অভিভাবকই এখন হন্যে প্রায়। আগে বলা হতো শিশুর বয়স হলে ছয়, ভর্তি কর বিদ্যালয়। আর এখন সেটা অনেকটা এমন যে ‘বাচ্চা যখন জন্ম নেয়, প্রাইভেট তার চালু হয়’। তিন বছরের শিশুর জন্যও সকাল-বিকাল দুই বেলা টিউটর রেখে দেয়ার ঘটনা দেখায় যায়। এরপর সকালে প্রাইভেট। স্কুল শেষে বিকালে প্রাইভেট। স্কুলের কাজ, প্রাইভেটের কাজ এগুলো করতে করতে দিন শেষ। ছেলেমেয়েদের বিনোদন বলে কিছু নেই। নানা রকম সিলেবাস আর কারিকুলামের বেড়াজালে বিলীণ হয়ে গেল রঙিন সেই শৈশব। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে স্মার্ট ফোন। সাম্প্রতিক সময়ে শিশু-কিশোরদের প্রযুক্তিতে আসক্তি আশঙ্কাজনকহারে বেড়ে গেছে। দেশে ৫ থেকে ১৮ বছর বয়সসীমায় মোবাইল ব্যবহারকারীর হার ৫৫ দশমিক ৮৯ শতাংশ। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো আয়োজিত জনশুমারি ও গৃহগণনা-২০২২-এর প্রাথমিক প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে। ১৮ বছর ও তার চেয়ে বেশি বয়সিদের মধ্যে ৭২ দশমিক ৩১ শতাংশ মানুষের ব্যক্তিগত মোবাইল ফোন রয়েছে। একইভাবে ২০২২ সালের গত তিন মাসে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা ৫ থেকে ১৮ বছর বয়সিদের মধ্যে মোট ৩০ দশমিক ৬৮ শতাংশ। এবং ১৮ বছর থেকে বেশি বয়সিদের মধ্যে ৩৭ দশমিক ১ শতাংশ জনসংখ্যা ইন্টারনেট ব্যবহার করেছে।
শিশুরা এখন ঘুম থেকে উঠে চোখ মুছতে মুছতে গিয়ে আব্বু কিংবা আম্মুর ফোন ধরে। এরপর শুরু হয় গেম খেলা, নয়তো কার্টুন দেখা। স্কল থেকে বাড়ি ফিরে বই রেখে ড্রেস না খুলেই বসে পড়ে ফোন নিয়ে। এটা তো গেল প্রাইমারি লেবেলের ছেলেমেয়েদের কথা। মাধ্যমিক পর্যায়ে পড়ুয়া ছেলেমেয়েদের বেলায় এটা আরো ভয়ানক। এখন স্কুলপড়ুয়া ছেলেমেয়েদেরও নিজস্ব টাচ ফোন থাকে। স্কুলে গিয়ে যখনই একটু সুযোগ হয় ফোন নিয়ে শুরু হয় গেমিং কিংবা ভিডিও দেখা। টিফিনে তো আছেই। ছুটি হলে অনেক ছেলে-মেয়ে বাড়িই ফেরে না। পথে বসেই শুরু করে দেয় গেমিং। যা শিশুদের বিপথে নেয়ার পাশাপাশি শৈশব বিপন্ন করছে।
শিক্ষকদের চাপ : বর্তমান প্রজন্মের শৈশব বিপন্নের আর একটি উল্লেখযোগ্য কারণ শিক্ষকদের দেয়া মানসিক চাপ। শিক্ষকরা ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে অসুস্থ প্রতিযোগিতার মনোভাব তৈরি করেন। ফলে অবসর সময় পেলে সে টুকু বাড়তি লেখা পড়ার পেছনে ব্যয় করতে বাধ্য হয় শিশুরা। পক্ষান্তরে শিশুদের কাছে প্রাইভেট না পড়লে নাম্বার কম দেয়ার নজিরও রয়েছে। সঙ্গে রয়েছে অপমান করার ঘটনা। কিছুদিন আগে অপমান সইতে না পেরে পারপিতা ফাইহা নামে হলিক্রস স্কুলের নবম শ্রেণির শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছে। উচ্চতর গণিতে ফেল করায় পারপিতার মা-বাবাকে স্কুলে নিয়ে যেতে বলা হয়। অভিভাবকদের ডেকে নিয়ে তাকে অপমান করা হবে- এমন ভয়ে কয়েক দিন ধরে আতঙ্কগ্রস্ত ছিল ওই শিক্ষার্থী। তাই বাবা-মাকে সে এ বিষয়ে কিছু জানায়নি। সর্বশেষ এই অপমানের ভয়ে পারপিতা আত্মহত্যা করেছে বলে অভিযোগ উঠেছে। তবে এ বিষয়ে পারপিতার সহপাঠীরা বলছে ভিন্ন কথা। তারা বলে, হলিক্রসে সিওডি শাখার এক শিক্ষক উচ্চতর গণিতের ক্লাস নেন। তিনি আবার এ বিষয়ে নিজের বাসায় প্রাইভেটও পড়ান। সি শাখার ফার্স্ট গার্ল পারপিতাকে ওই শিক্ষক তার কাছে প্রাইভেট পড়তে বলেছিলেন। কিন্তু পারপিতা তাতে রাজি না হওয়ায় ওই শিক্ষক তাকে ইচ্ছে করে প্রথম ও দ্বিতীয় সাময়িকে ফেল করিয়ে দেন।
বিষয়টি নিয়ে কথা বললে বিশিষ্ট সাহিত্যিক ও বাংলা একাডেমির সভাপতি সেলিনা হোসেন বলেন, শিশুর মানসিক বিকাশ ঘটার জন্য তাকে কখনো চাপে রাখা উচিত নয়। তাকে সব শিখাতে হবে আনন্দের সঙ্গে। পড়ালেখার পাশাপাশি তাদের খেলাধুলা ও বিনেদোনের ব্যবস্থা করতে হবে। এ বিষয়ে সবার আগে পরিবারকে এগিয়ে আসতে হবে।
এদিকে মহিলা ও শিশু বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী ফজিলাতুন নেসা ইন্দিরা আজ সকাল সাড়ে ৯টায় বাংলাদেশ শিশু একাডেমি মিলনায়তনে অনুষ্ঠিতব্য বিশ^ শিশু দিবস ও শিশু অধিকার সপ্তাহ ২০২২ এর উদ্বোধন অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে যোগদান করবেন। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করবেন মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. হাসানুজ্জামান কল্লোল।
ভোরের আকাশ/এমআরএন/জেএস/