ঢাকা: নারায়ণগঞ্জে রূপগঞ্জের ভুলতা-গাউসিয়া এলাকার এক মূর্তিমান আতঙ্কের নাম আফজাল হোসেন ভূঁইয়া। খুন, চাঁদাবাজি, মাদক ব্যবসা, জমি দখলসহ নানা অপরাধে জড়িত তিনি। রয়েছে তার নিজস্ব সন্ত্রাসী ও দালাল বাহিনী। একসময় ছিলেন ট্রাকচালক। বর্তমানে শতকোটি টাকার মালিক আফজাল। তার নির্যাতনের শিকার হয়ে অনেকেই এখন এলাকাছাড়া।
জাল-জালিয়াতি এবং ভুয়া দলিলে কেড়ে নিয়েছেন অনেকের সামান্য আশ্রয়টুকুও। পৈতৃক ভিটামাটি হারিয়ে কেউ কেউ হয়েছেন বাস্তুহারা। আফজাল গংয়ের বিরুদ্ধে কথা বললে বা প্রতিবাদ করলে অপহরণসহ খুন-জখমের শিকার হন জমির মালিকরা। সরেজমিন রূপগঞ্জের ভুলতা-গাউসিয়া এলাকায় এসব তথ্য জানা গেছে।
জানা গেছে, ভূমিদস্যু আফজালের প্রতারণার শিকার হয়েছেন এলাকার অনেকেই। এ ভূমিদস্যু পুলিশের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তার নাম ব্যবহার করে দখল করেছেন বেশকিছু লোকের জমি। এর মধ্যে রয়েছে সিএস ও এসএ ৮৭৯ এবং আরএস ১৪৬০ দাগের ৪৪ শতাংশ জমি। এছাড়া চাঁদপুরের বাসিন্দা সৌদিপ্রবাসী আবদুল আহাদ মিয়ার ৫ শতাংশ, আমলাবরের বাসিন্দা মৃত হান্নান ফকিরের ১০ শতাংশ, মোবারক মিয়ার ৫ শতাংশ এবং মো. শাহীন মিয়ার ৫ শতাংশ জমি দখলের অভিযোগ রয়েছে আফজালের বিরুদ্ধে।
এরকম অনেকেরই জমি দখলের অভিযোগ তার বিরুদ্ধে। আফজালের ভূমিদস্যুতার বিষয়ে কথা হয় ভুক্তভোগী মৃত হান্নান ফকিরের শ্যালক মো. মোকতার হোসেনের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘চার বছর আগে আমার দুলাভাই আফজালের কাছ থেকে ১০ শতাংশ জমি কেনেন। দুলাভাই যখন বালু ভরাট করে বাউন্ডারি দিতে যান, তখন আফজাল এসে বাধা দেন। আফজালের দাবি, এ জমি তিনি হান্নান ফকিরের কাছে বিক্রি করেননি। এ জমি তিনি পুলিশ কর্মকর্তার কাছে বিক্রি করেছেন। এরপর আফজাল আমার দুলাভাইকে নানাভাবে ভয়ভীতি এবং হুমকি দিতে থাকেন। আমার দুলাভাইয়ের কিডনি এবং হার্টের রোগ ছিল। জমি হারানোর শোকে আমার দুলাভাই মারা যান।’
আরেক ভুক্তভোগী আমলাবরের বাসিন্দা আলীনূর বলেন, আমি ২০০২ সালে ৩ কাঠার একটি জমি কিনি। ৪ বছর আগে এ জমি দেখিয়ে আমি যমুনা ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়েছি। আমার জমির দলিল যদি ভুয়া হতো, তাহলে ব্যাংক আমাকে ঋণ দিত না। আফজাল ভুয়া দলিল বানিয়ে আমার ৩ কাঠা জমি দখল করেছে। তিনি আরো দুজনের ৭ কাঠা জমি দখল করেছেন।
আলীনূর আরো বলেন, আফজাল একটি চক্রের সঙ্গে মিলে আইনের ফাঁকফোকরে ভুয়া কাগজপত্র বানিয়ে এলাকার অনেকের সঙ্গে প্রতারণা করেছেন। আফজাল জমিগুলো দখল করতে পুলিশের বড় কর্মকর্তাদের নাম ব্যবহার করেন। অনুসন্ধানে জানা যায়, ভূমিদস্যু আফজালের নিয়ন্ত্রিত দালাল চক্রটি প্রথমে একটি জমি টার্গেট করে। এরপর সেই জমির প্রকৃত মালিকের নামের সঙ্গে অন্য জেলার যে ব্যক্তির নাম ও পিতার নামের মিল রয়েছে, তাকে খুঁজে বের করে। পরে তাকে জমির মালিক বানিয়ে তার নামে কাগজপত্র তৈরি করে। সেই জাল কাগজের ভিত্তিতে দলিল বানিয়ে চক্রটি জমি দখল করে। এরপর তা বিক্রি করে। এভাবেই আফজাল হাতিয়ে নিচ্ছেন মানুষের কোটি কোটি টাকার সম্পদ।
অনুসন্ধানে আরো জানা গেছে, জনৈক রতন চন্দ্র দেকে ভুয়া মালিক সাজিয়ে ২০২০ সালের ১৪ জুলাই ৪৬৭৪ নম্বর দলিলমূলে নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ উপজেলার পানাব মৌজার সিএস ও এসএ ২৬২, আরএস ৩৪২ দাগের ৬০ শতাংশ জমির মধ্য থেকে ৪৭ শতাংশ জমির মালিক হন মো. আফজাল হোসেন ভূইয়া গং। এরপর এ জমি আফজাল আড়াইহাজারের লাক মিয়ার কাছে চলতি বছর ৬ জানুয়ারি ৬০৫ নম্বর দলিলমূলে হস্তান্তর করেন। অনুসন্ধানে জানা গেছে, পানাব মৌজার জেএল নম্বর এসএ ১৬৪ ও আরএস ১৭১/১৭২ এবং সিএস ও এসএ ২৬২, আরএস ৩৪২ দাগের ওই ৬০ শতাংশ জমির প্রকৃত মালিক ছিলেন একই এলাকার নবীন চন্দ্র দের ছেলে কৈলাশ চন্দ্র দে। এই কৈলাশ চন্দ্র দের মৃত্যুর পর ওয়ারিশ সূত্রে জমির মালিক হন তার তিন ছেলে, যতীন্দ্র চন্দ্র দে, দীনেশ চন্দ্র ও ফনিন্দ্র চন্দ্র দে। তাদের নামে জমির রেকর্ডও হয়েছে। এ ছাড়া একই দাগের জমির কিছু অংশের মালিক হন আলী উছমান ও আলী হোসেন। এ জমি বিভিন্ন পর্যায়ে মালিকানা বদল হয়ে সর্বশেষ ক্রয় সূত্রে মালিক হন রূপগঞ্জ উপজেলার বড়মনোহরদী গ্রামের আয়েছ আলী। তিনি ৬০ শতাংশ জমির মধ্যে ৪০ শতাংশের মালিক হন। (দলিল নম্বর-৫২৪, তারিখ ২৬/০১/১৯৮২)। তার মৃত্যুর পর ওই জমির মালিক হন তার পাঁচ ছেলে ও এক মেয়ে। এরা হলেনÑ ফটিক মিয়া, রফিক মিয়া, মো. মোজাম্মেল, মো. ইউসুফ মিয়া ও মো. সফিকুল মিয়া এবং হাসনেরা বেগম।
অনুসন্ধানে আরো জানা যায়, কৈলাশ চন্দ্র দের উত্তরসূরি হিসেবে রতন চন্দ্র দেকে সাজাতে মো. আফজাল গং ২০২০ সালের ১৭ জুন ও ২৮ জুন গাজীপুরের কাপাসিয়া ইউনিয়ন পরিষদ থেকে চারটি ওয়ারিশ সনদ নেন। কৈলাশ চন্দ্র দে এবং তার তিন ছেলে যতীন্দ্র চন্দ্র দে, দীনেশ চন্দ্র দে ও ফনীন্দ্র চন্দ্র দের নামে যথাক্রমে ২০২০৩৩১৩৬৪৩০০২৭৪৫, ২০২০৩৩১৩৬৪৩০০২৭৪৬, ২০২০৩৩১৩৬৪৩০০২৭৬১ এবং ২০২০৩৩১৩৬৪৩০০২৭৬০ নম্বর ওয়ারিশ সনদ নেয়া হয়।
ভুল তথ্য দিয়ে এ চারটি সনদ নেয়ার কথা জানতে পেরে ওই ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য মো. আফজল হোসেন সৈয়দকে প্রধান করে চার সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। পরে এ তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনের ভিত্তিতে গত বছর ২৪ মার্চ চারটি ওয়ারিশ সনদই বাতিল করেন ওই ইউপি চেয়ারম্যান মো. সাখাওয়াত হোসেন প্রধান। গত ১৪ আগস্ট এ বিষয়ে পৃথক চারটি প্রত্যয়নপত্র দিয়েছেন ওই চেয়ারম্যান।
এ বিষয়ে কাপাসিয়া ইউপি চেয়ারম্যান সাখাওয়াত হোসেন প্রধান ভোরের আকাশকে বলেন, মিথ্যা তথ্য দিয়ে ওয়ারিশান সনদ নেয়া হয়েছিল। তদন্তে তা প্রমাণিত হওয়ায় ওই সনদগুলো বাতিল করা হয়েছে।
অনুসন্ধানে জানা যায়, রতন চন্দ্র দের বাবা যতীন্দ্র চন্দ্র, চাচা মনোরঞ্জন চন্দ্র দে ও বসন্ত চন্দ্র দে, দাদা সুরেন্দ্র চন্দ্র দে। রতন দের চাচাতো ভাই পুলিন চন্দ্র দে ও পুলিনের বাবা মনোরঞ্জন চন্দ্র দে। রতন চন্দ্র দের ৬ বোন, রেবা চন্দ্র দে, রিভা চন্দ্র দে, রিনা চন্দ্র দে, সিমা চন্দ্র দে, মিনা চন্দ্র দে ও চিনু চন্দ্র দে। তাদের সর্বসাং বর্জনা, ডাকঘর ও থানা-কাপাসিয়া, জেলা-গাজীপুর।
সরেজমিন কাপাসিয়ার বর্জনায় গিয়ে রতন চন্দ্র দের সঙ্গে কথা হলে তিনি ভোরের আকাশকে জানান, ‘আফজাল তাকে ভুল বুঝিয়ে মিথ্যা প্রলোভন দিয়ে একটি দলিলে স্বাক্ষর নিয়েছিলেন। বিষয়টি জানতে পেরে গাজীপুরের বিজ্ঞ নোটারি পাবলিকের মাধ্যমে তা সংশোধন করেছি। আমি ওই জমির প্রকৃত মালিক নই। এ ছাড়া আমার দাদার নামও কৈলাশ চন্দ্র দে নয়। আমার দাদার নাম সুরেন্দ্র চন্দ্র দে। বাবার নাম মিলে যাওয়ায় আফজাল এ ধরনের অপকর্ম করেছেন।’ ভোরের আকাশের অনুসন্ধানে দেখা গেছে, আসল যতীন্দ্র চন্দ্র দের সঙ্গে ভুয়া ভূমিদস্যু আফজালের বানানো যতীন্দ্র চন্দ্র দের বাবা এবং দুই ভাইয়ের নামের কোনো মিল নেই। পানাব মৌজার স্থানীয় বয়োজ্যেষ্ঠ কালিপদ বাবু, কৃষ্ণ দাস বাবু, শ্রী ক্ষিতিস চন্দ্র ভৌমিক এবং হাজী আনোয়ার হোসেন মোল্লার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, যতীন্দ্র চন্দ্র দের বাবা কৈলাশ চন্দ্র দে তাদের প্রতিবেশী ছিলেন। একে-অপরের সঙ্গে তাদের খুব ভালো সম্পর্ক ছিল। পানাব মৌজার স্থানীয় বয়োজ্যেষ্ঠরা জানান, যতীন্দ্র চন্দ্র দে নিঃসন্তান এবং অবিবাহিত অবস্থায় মারা যান।
ভোরের আকাশ/জেএস/