logo
আপডেট : ৬ অক্টোবর, ২০২২ ২০:৫১
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কাছে প্রধানমন্ত্রীর প্রশ্ন, বাংলাদেশের সন্ত্রাস দমনে তারা কি নাখোশ?
নিজস্ব প্রতিবেদক

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কাছে প্রধানমন্ত্রীর প্রশ্ন, বাংলাদেশের সন্ত্রাস দমনে তারা কি নাখোশ?

ঢাকা: যাদের দিয়ে বাংলাদেশে সন্ত্রাস দমন করা হয়েছে, তাদের উপরই নিষেধাজ্ঞা মানে সেই সন্ত্রাসীদের মদদ দেওয়া।- এমনটাই মনে করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কাছে প্রশ্ন রেখেছেন, তাহলে তারা কি বাংলাদেশের সন্ত্রাস দমনে নাখোশ?

 

যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যে সদ্য সমাপ্ত রাষ্ট্রীয় সফর সম্পর্কে সংবাদ সম্মেলনে তিনি এ প্রশ্ন রাখেন। বৃহস্পতিবার বিকেল ৪টায় গণভবনে এ সংবাদ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়।

 

র‌্যাবের উপর নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, নিষেধাজ্ঞা তারা কতটুকু তুলবে আমরা জানি না। তবে নিষেধাজ্ঞা দিয়ে তারা ক্ষতি যেটা করেছে, আমরা যাদের দিয়ে এদেশে সন্ত্রাস দমন করেছি, তাদের উপর নিষেধাজ্ঞা দেওয়ার অর্থটা কি? সন্ত্রাসীদের মদদ দেওয়া। আমার এটাও প্রশ্ন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কাছে, তাহলে  সন্ত্রাস দমনে কি তারা নাখোশ?’

 

আমেরিকার পরামর্শেই র‌্যাবের সৃষ্টি উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘র‌্যাবের উপর তারা যখন নিষেধাজ্ঞা দিলো, আমার প্রশ্ন হচ্ছে- র‌্যাব সৃষ্টি করেছে কে? র‌্যাব সৃষ্টি তো আমেরিকারই পরামর্শ। আমেরিকাই র‌্যাব সৃষ্টি করতে পরামর্শ দিয়েছে। তাদের ট্রেনিং দেয়। তাদের অস্ত্রশস্ত্র, তাদের হেলিকপ্টার, এমনি তাদের ডিজিটাল সিস্টেম, আইসিটি সিস্টেম, সবই আমেরিকার দেওয়া। আমেরিকা যখন নিষেধাজ্ঞা দেয় বা কোনো কথা বলে বা অভিযোগ আনে, তখন একটাই কথা আমার, যেমন ট্রেনিং দিয়েছে, তেমন তারা কার্যক্রম করেছে। এখানে আমাদের করার কি আছে। আপনাদের ট্রেনিং যদি একটু ভালো হতো। তাহলে নয় কথা ছিলো।’

 

বাংলাদেশে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থা অপরাধ করলে বিচার হলেও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বিচার হয়না উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ‘আমাদের দেশে এখনো আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থা, সে র‌্যাবই হোক, পুলিশ হোক, কেউ যদি অপরাধ করে, তার কিন্তু বিচার হয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে আপনারা দেখেছেন পুলিশ ইচ্ছে করে গুলি করে মারলেও তাদের কিন্তু সহসা বিচার হয় না। একটা বিচার হলো, যখন আমেরিকার সবাই আন্দোলনে নামলো। তখন ওই একটাই বিচার বোধহয় সারাজীবনে তারা করতে পারছে। তারা তো কথায় কথায়... । আমাদের কতজন বাঙ্গালি মারা গেছে। সেখানে কিন্তু তারা কিছু বলে না। সেকথা গুলো আমি স্পষ্ট তাদের বলেছি। আমি কিন্তু বসে থাকিনি।’

 

আমেরিকার তীব্র সমালোচনা করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘৪০ বছর ধরে আফগানিস্তানে তালেবানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে সেই তালেবানের হাতেই ক্ষমতা দিয়ে ভেগে চলে আসলো আমেরিকার সৈন্যরা। বাইডেন সাহেব তুলে নিয়ে গেলেন সবাইকে, আবার সেই রাষ্ট্র চলে গেলো আফগানিস্তানের তালেবানের হাতে। ৪০ বছর তো তারা যুদ্ধ করলো। নিজেদের ব্যর্থতার কথা তারা বলে না তো।’

 

আমেরিকার একটু নিজেদের চিন্তা নিজেদের করা উচিত উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, ‘ভিয়েতনামে ৩০ বছর যুদ্ধ করলো। বাংলাদেশে পাকিস্তানিদের মদদ দিলো, সেভেন ফিলিপ পাঠাতে চাইলো, আমরা কিন্তু আমাদের দেশ স্বাধীন করেছি। তো তাদের নিজেদের চিন্তা নিজেদের একটু করা উচিত। এখন আবার ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধে সমানে মদদ দিয়ে যাচ্ছে। নিষেধাজ্ঞা দিচ্ছে। নিষেধাজ্ঞা দিয়ে কার ক্ষতি হচ্ছে? সাধারণ মানুষের ক্ষতি হচ্ছে। কথায় কথায় নিষেধাজ্ঞা দেবে, একটা দেশ আরেকটা দেশকে নিষেধাজ্ঞা দেয়, এটা কেমন কথা। আমি কিন্তু আমার বক্তৃতায় এ কথা স্পষ্ট ভাবে বলে আসছি। এটাও বলেছি যে এই যুদ্ধ থামাতে হবে।’

 

কিছু বিষয় নিয়ে বাংলাদেশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের টানাপোড়ন সম্পর্কের বিষয়ে এই প্রশ্নের জবাবের শুরুতেই প্রধানমন্ত্রী বলেন, সকলের সাথে বন্ধুত্ব, কারো সাথে বৈরিতা নয়- আমরা এই নীতিতে বিশ্বাস করি। রাষ্ট্রে রাষ্ট্রে সমস্যা থাকতে পারে, থাকে। কিন্তু কারো সঙ্গে আমরা ঝগড়া-বিবাদে যাই না। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সময়ে সময়ে আমাদের উপর নানা ধরনের নিষেধাজ্ঞা, একসময় জিএসপি বাদ দিলো, নানা রকমের ঘটনা ঘটায়। দুর্ভাগ্যের বিষয় হলো আমাদের দেশেরই কিছু লোক, এটাই হচ্ছে সবচেয়ে দুর্ভাগ্যজনক, আমাদের দেশের কিছু লোক তারা যেসব স্টেটে থাকে, যেখানে যেখানে থাকে, সেখানকার স্থানীয় সিনেটর, কংগ্রেসম্যান -তাদের কাছে নানা রকম বানোয়াট মিথ্যা তথ্যও দিয়ে থাকে। দিয়ে দিয়ে একটা পরিবেশ সৃষ্টি করে। যারা এসব করে তারা কোনো না কোনো অপরাধে অপরাধী বলে উল্লেখ করেন প্রধানমন্ত্রী।

 

তিনি বলেন, মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় যারা স্বাধীনতা বিরোধী, যুদ্ধাপরাধী; আমরা অনেকের বিচার করেছি। তাদের সন্তানরাও আছে। অনেকে পলাতক আছে। তাদের বিরাট অর্থের মালিক। ২১ বছর ক্ষমতায় ছিলো। বাংলাদেশ শোষণ করে বহু অর্থ তারা পাচার করে নিয়ে গেছে। তারাও বাংলাদেশের বিরুদ্ধে সব সময় সোচ্চার থাকে। নানা ধরনের অপপ্রচার চালায়। কাজেই এরকম বহু ঘটনাই আছে।’

 

গুমের প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘কয়েকটা আন্তর্জাতিক সংস্থা খুব তুললো- গুম-খুন গুম-খুন । গুমের হিসাব যখন তুললো, তখন দেখা গেলো সবচেয়ে বেশি গুম জিয়াউর রহমানের আমলে শুরু। তারপর থেকে তো চলছেই। তারপর আমরা যখন তালিকা চাইলাম, ৭৬ জনের তালিকা পাওয়া গেলো। আর এই ৭৬ জনের মধ্যে কি পাওয়া গেছে তা আমরা নিজেরা ভালো জানেন।’

 

‘আমাদের দেশে এমনও আছে আরেকজনকে শায়েস্তা করতে মাকে লুকিয়ে রেখে, গুম করেছে, মাকে খুন করেছে, সেঘটনাও বেরিয়ে যাচ্ছে। আমি সংবাদিকদের ধন্যবাদ জানাই যে, সেগুলো আপনারা খুজে খুজে বের করেন। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তাকে ধরেও । কেউ বোনকে লুকিয়ে রেখে গুম হয়ে গেছে...। কেউ ঢাকা থেকে ভালো একজন আতেলের কথা, নাম আর বলতে চাই না। ঢাকা থেকে চলে গেলেন খুলনা, বলে গেলেন, তাকে গুম করা হয়েছে। দেখা গেলো ঘুরে বেড়াচ্ছে নিউমার্কেটে খুলনার। নিউ মার্কেটে তাকে পাওয়া গেলো খুজে। এরকম ঘটনা আছে। আর যে তালিকা আছে তাতে দেখা গেছে ভারত থেকে কিছু নাগরিক, পালাতক আসামী। তাদের নামও সেই তালিকায়। এটা কেমন করে হয়? সেখানেও কয়েকটা চরমপন্থি। তারা ভারতে যেহেতু, ভারত থেকেই তারা পালিয়েছে, কারণ সেখানে তাদের বিরুদ্ধে হুলিয়া জারি। তারা গ্রেপ্তার হবে। তারা সব বাংলাদেশেও ওই তালিকার মধ্যে তাদেরও নাম দেওয়া। কাজেই রকম ভাবে আরো বেশ কিছু নাম। এমন কি কোনো কোনো নাম গুমের তালিকায় আছে, কিন্তু সে হয়তো আমেরিকায়ই লুকিয়ে আছে। সেরকমও তো তথ্য আছে। সেই বিষয় গুলি আমরা তো তাদের সামনে তুলে ধরেছি।’

 

বিএনপি প্রতি সপ্তাহে কোনো না কোনো বিদেশি রাষ্ট্রদূতের কাছে যাচ্ছে; নির্বাচন নিয়ে কথা বলছে। নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতার পরিবর্তন হবে, নাকি বিদেশি দূতাবাসের মাধ্যমে সরকার পরিবর্তন হবে?- এমন প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘বিএনপিকে জিজ্ঞেস করলে ভালো হয় নির্বাচন কে করে দিয়ে যাবে। বিএনপি ভুলে গেছে তাদের অতীতের কথা। বিএনপির সৃষ্টি যেভাবে, একটি মিলিটারি ডিকটেটরের পকেট থেকে বিএনপির সৃষ্টি। তারপর নির্বাচনের যে প্রহসন, এটা তো তাদেরই সৃষ্টি। বরং আমরা নির্বাচনটাকে এখন জনগণের কাছে নিয়ে গেছি।’

 

তিনি বলেন, ‘ছবিসহ ভোটার তালিকা হচ্ছে। স্বচ্ছ ব্যালট বাক্স দেওয়া হচ্ছে। মানুষ যেন তার ভোটটা দিতে পারে, সে পরিবেশ বা ভোট সম্পর্কে মানুষের যে সচেতনতা, এটা কিন্তু আওয়ামী লীগই সৃষ্টি করেছে।’

 

খুটির জোর না থাকায় বিএনপি বিদেশিদের কাছে ধর্ণা দিয়ে বেড়াচ্ছে উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, ‘বিএনপি ধর্ণা দিয়ে বেড়াচ্ছে। যদি মাটিতে জোর থাকতো। নিজের দেশের মাটিতে যদি ওদের সেরকম সমর্থন থাকতো, ওই যে বলে না খুটায় যদি জোর থাকতো, তাহলে বিদেশে ধর্ণা দেওয়া প্রয়োজন হতো না। জনসমর্থন ও জনগণের ওপর আস্থা থাকলে, বিশ্বাস থাকলে তারা (বিএনপি) জনগণের কাছে যেত; বিদেশিদের কাছে দৌড়ে বেড়াত না। এটাই হলো বাস্তবতা। ওদের সেই শক্তি নেই বলেই..।’

 

কোন মুখে তারা জনগনের কাছে ভোট চাইতে যাবে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘আগুন দিয়ে পোড়ানো, মানুষ খুন করা, বোমা মারা, গ্রেনেড মারা—সব জায়গায় তো আছে। তারা যদি সামনে এসে দাঁড়ায়, তখন কী জবাব দেবে বিএনপি। এ জন্যই তারা বিদেশিদের কাছে ধরনা দিয়ে বেড়ায়। দেশের মানুষের কাছে যায় না।’
‘আমরা তো বাধা দিচ্ছি না। আন্দোলন করেন, সংগ্রাম করেন। যত আন্দোলন করবেন তত ভালো। কিন্তু পারে না তো। কী করব।’

 

যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রে ১৮ দিনের সফর শেষ করে ৪ অক্টোবর দেশে ফেরেন প্রধানমন্ত্রী।

 

এর আগে, ১৫ সেপ্টেম্বর তিনি যুক্তরাজ্যে রাষ্ট্রীয় সফরে লন্ডনে যান এবং সেখানে রানী দ্বিতীয় এলিজাবেথের রাষ্ট্রীয় অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া এবং রাজা তৃতীয় চার্লস আয়োজিত সংবর্ধনায় যাগদান করেন।

 

তিনি ১৯ সেপ্টেম্বর, নিউইয়র্কের উদ্দেশ্যে লন্ডন ত্যাগ করেন।

 

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থানকালে, তিনি ২৩ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের ৭৭তম অধিবেশনে ভাষণ দেন এবং এর পাশাপাশি বিভিন্ন অনুষ্ঠানে অংশ নেন।

 

ভোরের আকাশ/আসা