ঢাকা: আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে সমন্বয় করে অভ্যন্তরীণ বাজারে চিনি ও ভোজ্যতেলের দাম কমানো হলেও তা এখনো বাস্তবায়ন করেননি খুচরা ব্যবসায়ীরা। আমদানিকারক বা পরিবেশক পর্যায়ে দাম কমানো হলেও নানা অজুহাতে ক্রেতাদের নতুন দামে পণ্য দিচ্ছেন না রাজধানী ঢাকাসহ (দুয়েকটি ব্যতিক্রম ছাড়া) সারা দেশের খুচরা ব্যবসায়ীরা। তবে সম্প্রতি চিনির দাম কেজিতে ৬টা বাড়ানো হলে তা সঙ্গে সঙ্গে কার্যকর করে ফেলেন এসব ব্যবসায়ীরা। অন্যদিকে সয়াবিন তেল লিটারে ১৪ টাকা এবং পাম তেলের লিটারে ৮ টাকা দাম কমানো হলেও তা এখনো কার্যকর করছেন না তারা। কারণ হিসেবে কোম্পানির ওপর দায় চাপিয়ে পার পেয়ে যাচ্ছেন দোকানিরা। আর কোম্পানির পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, সিদ্ধান্ত সঠিক সময়ে বাস্তবায়ন করা হয়েছে। মিলগেটে বা ডিলার পর্যায়ে পর্যাপ্ত পণ্য পৌঁছানো হয়েছে। এ নিয়ে কোম্পানি পর্যায়ে কোনো জটিলতা নেই। যার সত্যতা রাজধানীর কয়েকটি বাজার ঘুরে পাওয়া গেছে। এসব কারণে ব্যবসায়ীদের সততা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন অনেক ক্রেতা ও বিশেষজ্ঞরা।
অন্যদিকে সরকারের সিদ্ধান্ত সঠিক বাস্তবায়ন এবং ভোক্তার স্বার্থ সংরক্ষণে বাজার মনিটরিং এবং নিয়মিত অভিযানের পরামর্শ দিয়েছেন সংশ্লিষ্টারা। পাশাপাশি ক্রেতাদের সঠিক দামে পণ্য ক্রয়ের পরামর্শ দিয়ে বাড়তি দাম দেয়া থেকে বিরত থাকতে বলেছেন বিশ্লেষকরা। জানা গেছে, গত বৃহস্পতিবার বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের এক সিদ্ধান্তে প্রতি কেজি খোলা চিনিতে ৬ টাকা বাড়ানো এবং পাম তেলের লিটারে ৮ টাকা দাম কমানো হয়েছে। ফলে বাজারে চিনির কেজি ৯০ টাকা, সুপার পাম অয়েল লিটার ১২৫ টাকা। এর আগে গত ৩ অক্টোবর বোতল সয়াবিন তেলের লিটারে ১৪ টাকা কমিয়ে ১৭৮ টাকা নির্ধারণ করা হয়। ওই সময় চিনির দাম কমানো হলেও তা খুচরা পর্যায়ে বাস্তবায়ন করেননি ব্যবাসয়ীরা।
তবে বৃহস্পতিবার চিনির দাম বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে তা কার্যকর করে ফেলেছেন তারা। এ বিষয়ে শান্তিনগর বাজারের এক দোকানের বিক্রয়কর্মী মুরাদ জানান, ক্রেতা সন্তুষ্টির জন্য পুরোনো মালের দাম কমিয়ে রাখা হচ্ছে। তবে নতুন মাল এখনো বাজারে এসে পৌঁছায়নি। আগের মাল শেষ না হওয়ায় নতুন মালের ওয়ার্ডার দেয়া হচ্ছে না। এমন মন্তব্য প্রায় সব দোকানির। তবে ভিন্ন চিত্রও আছে এলাকাভেদে। তেলের দাম সম্পর্কে দক্ষিণ বনশ্রীর খুচরা মুদি ব্যবসায়ী মো. মাসুদ বলেন, দাম কমার পর থেকে আমরা তেলের দাম কম রাখছি। কিন্তু নতুন দামের বোতল আমরা এখনো হাতে পাইনি। নতুন রেটের বোতল রোববার বা সোমবার এলাকাগুলোয় আসবে বলে জানিয়েছেন কোম্পানিগুলোর ডিলাররা। দাম কমলে আমাদের বেচাকেনা বাড়ে, এতে ভালো লাভ হয়। তিনি বলেন, এলাকার খুচরা দোকানগুলোয় এক লিটারের সয়াবিন তেলের বোতল গায়ের রেট আছে ১৯২ টাকা। এ ১ লিটারের ১৯২ টাকার বোতল নতুন দামেই বিক্রি করছি ১৭২ টাকায়। ২ লিটারের সয়াবিন তেলের গায়ের মূল্য আছে ৩৮৪ টাকা এটা বিক্রি করছি ৩৪৪ টাকা। তবে কোম্পানি ও পরিবেশকের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, দাম কমার সিদ্ধান্ত সঠিকভাবে বাস্তবায়ন হয়েছে। ব্যবসায়ীদের সততার অভাবে তা কার্যকরা করা যাচ্ছে না।
ভোজ্যতেলের দাম কমানোর বিষেয় মেঘনা গ্রুপের সিনিয়র সহকারী মহাব্যবস্থাপক তাসলিম শাহরিয়ার বলেন, ‘যেদিন দাম কমিয়েছি, সেদিনই ডিলার বা পরিবেশক পর্যায়ে পুরোনো মালের মূল্যের সঙ্গে নতুন মালের মূল্য সমন্বয় করে ডিসকাউন্ট (মূল্য চাড়) ঘোষণা দিয়েছি। আমাদের দিক থেকে কোনো সমস্যা নেই। খুচরা ব্যবসায়ীরা কেন এমনটি করছে, বলতে পারছি না। যাই করুক, দুয়েকদিনের মধ্যে এ অবস্থার অবসান হবে। সঠিক দামে সাধারণ মানুষ পণ্য পাবেন, এমনটাই আশা করি। কারণ আমি নিজেই একজন ভোক্তা।’
এ প্রসঙ্গে কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান বলেন, ‘আমাদের দেশের সাধারণ ব্যবাসয়ীদের এটাই ধর্ম। যখন বৃদ্ধি পায় তখন কম দামে কিনে বেশি দামে বিক্রি করে। আর কমলে কামাতে চায় না। এজন্য তাদের বাধ্য করতে হবে। এটি আইন দ্বারা, না হয় ক্রেতার বিরত থাকার মাধ্যমে করতে হবে।’ তিনি বলেন, ‘প্রথম বিষয়টি অত্যান্ত গুরুত্বপূর্ণ। যদি আইন প্রয়োগ করা না হয়, অভিযান করা না হয়, তাহলে এরা লাইনে (সঠিক) আসবে না। এদের বাধ্য করতে হবে। বাজার অভিযান বাড়াতে হবে। নইলে মূল্য কমার সুবিধা ভোক্তারা পেতে অনেক দেরি হয়ে যাবে।’ ‘এছাড়া অন্য একটি উপায় হলো, ক্রেতাকে সঠিক দামে পণ্য কিনতে হবে। যদি বিক্রেতা তা’ দিতে না চায়, তবে একযোগে সেই পণ্য ক্রয় থেকে বিরত থাকতে হবে। সেই ধৈর্য থাকতে হবে। কিন্তু আমাদের তো সেই ধৈর্য নেই। যে কারণে অসাধু ব্যবসায়ীরা সুবিধা নিয়ে থাকে’, যোগ করেন তিনি।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, ৪ অক্টোবর থেকে প্রতি লিটার খোলা সয়াবিন তেলের নতুন দাম ১৫৮ টাকা। আর ৫ লিটারের বোতলজাত সয়াবিন তেলের দাম ৮৮০ টাকা। ১ লিটার বোতল সয়াবিন তেলের ১৭৮ টাকা। তবে তা সঠিকভাবে দোকানে এখনো পাওয়া যাচ্ছে না। জানা গেছে, বিশ^বাজারে ভোজ্যতেলের দামতে থাকায় এর আগে ১৭ জুলাই সয়াবিন ও পাম তেলের দাম কমায় তেল বিপণনকারী কোম্পানিগুলো। এরপর গত ২৩ আগস্ট আবার সয়াবিনের দাম লিটারপ্রতি ৭ টাকা বৃদ্ধি করার দেড় মাসের ব্যবধানে আবার দাম কমানো হয়।
এদিকে শুক্রবার রাজধানীর বাজার গিয়ে দেখা গেছে, শীত মৌসুমের সবজি বাজারে আসতে শুরু করলেও এখনো চড়া দামে বিক্রি হচ্ছে, শাক-সবজি। শীতের সবজির মধ্যে গত সপ্তাহের তুলনায় সিমের দাম ২০ টাকা কমে হয়েছে ১২০ টাকা। শসার দাম কমে বিক্রি হচ্ছে ৪০-৫০ টাকা কেজিতে। চালকুমড়া, ফুলকপি এবং বাঁধাকপি প্রতি পিস ৪০ থেকে ৫০ টাকার মধ্যে বিক্রি হচ্ছে। ঢ্যাঁড়শ, ধুন্দুল, এবং পটোল প্রতি কেজি ৬০ টাকা করে বিক্রি হচ্ছে। করলা, বরবটি, কাঁকরোল, ঝিঙা প্রতি কেজি ৮০ টাকা করে বিক্রি হচ্ছে। পেঁপে ৩০ টাকা করে বিক্রি হচ্ছে। প্রতি কেজি টমেটো ১২০-১৪০ টাকা করে বিক্রি হচ্ছে। কাঁচামরিচ এবং ধনেপাতা প্রতি কেজি ১০০-১২০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। খিলগাঁও বাজারের সবজি বিক্রেতা ফজলে রাব্বী বলেন, শীত এলে সবজির দাম অনেকটা কমতে পারে। তবে এখন ডিজেল তেলের দাম বাড়ায় পরিবহন খরচ বেড়ে গেছে। তাই সবজির দাম চাইলেও কমানো যাচ্ছে না। আমিষের বাজারে দেখা গেছে, মুরগির ডিম প্রতি ডজন ১৪৫ টাকা এবং হাসের ডিমের ডজন ২০৫ থেকে ২১০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। অন্যদিকে ব্রয়লার মুরগির দাম কেজিতে ১০ টাকা বেড়ে ১৮০ টাকায় কেজি বিক্রি হচ্ছে। এছাড়া লেয়ার মুরগির কেজি ৩০০ এবং সোনালি মুরগি ৩২০ টাকা কেজিতে বিক্রি হচ্ছে। মাছ-মাংসের দাম অপরিবর্তিত রয়েছে।
ভোরের আকাশ/ইএস/জেএস/