logo
আপডেট : ৯ অক্টোবর, ২০২২ ০৯:৫১
গ্যাস সিলিন্ডারে বাড়তি দাম, ধাপে ধাপে কারসাজি
- নির্ধারিত মূল্যে পাচ্ছেন না কেউ -২০০ টাকা বাড়তি দিতে হচ্ছে গ্রাহকদের -একে অপরের ওপর দায় চাপানোর চেষ্টা -অভিযোগ না পেলে ব্যবস্থা নেয়া যায় না : বিইআরসি -বাজার তদারকির পরামর্শ
ইফ্ফাত শরীফ

গ্যাস সিলিন্ডারে বাড়তি দাম, ধাপে ধাপে কারসাজি

ঢাকা: সরকার নির্ধারিত এলপিজি সিলিন্ডারের দাম বর্তমানে এক হাজার দুইশ টাকা হলেও মাঠের চিত্র একেবারেই ভিন্ন। গত তিন দিন ঢাকাসহ দেশের একাধিক জেলায় খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, তিন ধাপে এলপিজি সিলিন্ডার পৌঁছায় গ্রাহক পর্যায়ে। ধাপে ধাপে কারসাজির কারণেই সরকার নির্ধারিত দামে গ্রাহকরা গ্যাস কিনতে পারছেন না। প্রতি সিলিন্ডারে বাড়তি ২০০ টাকা গুনতে হচ্ছে।

 

এ জন্য অবশ্য খুচরা বিক্রেতা, ডিলারসহ কোম্পানিগুলো একে অপররের কাঁধে নানা কায়দায় দোষ চাপানোর চেষ্টা করছেন। আর বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি) বলছে, কেউ অভিযোগ না করলে গ্রাহকরা প্রতারিত হলেও তাদের কিছু করার থাকে না। 

 

উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান থেকে সিলিন্ডার ডিলার পর্যন্ত বিক্রি হয় এক হাজার ১৮০ থেকে ১২শ টাকায়। ডিলারদের থেকে খুচরা পর্যায়ে স্থানীয় ব্যবসায়ীদের কাছে ১০৫ টাকা কেজি হিসেবে গ্যাস বিক্রি হয়। সে হিসেবে দোকানির ১২ কেজির সিলিন্ডার গ্যাস কিনতে দাম পড়ে এক হাজার ২৬০ থেকে ১ হাজার ২৮০ টাকা পর্যন্ত। সবশেষ গ্রাহকদের এই সিলিন্ডার এক হাজার ৪০০ টাকায় কিনতে হচ্ছে। অর্থাৎ সরকারি পর্যায়ে নির্ধারিত দামের ২০০ টাকা বেশি গুনতে হচ্ছে ক্রেতাদের। এ নিয়ে সাধারণ মানুষ ও গ্যাস সিলিন্ডার ব্যবহারকারীরা ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন।

 

সরকারের পক্ষ থেকে গত ২ অক্টোবর বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি) সংবাদ সম্মেলন করে ১২ কেজির এলপিজির দাম ১ হাজার ২০০ টাকা নির্ধারণ করে দেয়। অক্টোবর মাসে প্রতি কেজি এলপিজির দাম নির্ধারণ করা হয়েছে ১০১ টাকা ১ পয়সা, যা সেপ্টেম্বর মাসে ছিল ১০২ টাকা ৮৮ পয়সা, এর আগে আগস্ট মাসে ছিল ১০১ টাকা ৬২ পয়সা।

 

এই হিসাবে অক্টোবর মাসে ১২ কেজির দাম পড়বে ১ হাজার ২০০ টাকা, যা সেপ্টেম্বর মাসে ছিল ১ হাজার ২৩৫ টাকা। আর আগস্ট মাসে ছিল ১ হাজার ২১৯ টাকা। তবে মাঠ পর্যায়ে এই দামের কোনো বাস্তবায়ন নেই এবং তদারকিরও ব্যবস্থা নেই।

 

প্রতি মাসে সিলিন্ডার গ্যাসের পেছনেই আড়াই থেকে তিন হাজার টাকা চলে যায়। এতে দিন দিন জীবন চালানোই কষ্টকর হয়ে যাচ্ছে। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধগতির মধ্যে সামান্য আয়ে খুব হিসাব করে সংসার চালাতে হয়। ব্যবসায়ীরা প্রতিনিয়ত যেন বেপরোয়া হয়ে উঠছে, যে যার ইচ্ছামতো দাম রাখছে। নিয়মনীতির কোনো তোয়াক্কাই করছেন না তারা। বাসায় রান্নার জন্য এপলিজি গ্যাস সিলিন্ডারের ডেলিভারি নেয়ার সময় আক্ষেপ করে কথাগুলো বলছিলেন দক্ষিণ বনশ্রীর বাসিন্দা গৃহিণী ইসরাত জাহান নীলা।

 

রান্নার জন্য প্রতি মাসে ১২ কেজির কমপক্ষে ২টি এলপিজি গ্যাস সিলিন্ডার প্রয়োজন হয় তার। দক্ষিণ বনশ্রীর জে ব্লকের ১২/৪ নম্বর রোডের মোহাম্মদিয়া ট্রেডার্স নামক একটি প্রতিষ্ঠান থেকে প্রতিমাসে এই সিলিন্ডার সংগ্রহ করেন তিনি।

 

তিনি অভিযোগ করে বলেন, আমি কোনো মাসেই সরকারের দেয়া দামে সিলিন্ডার গ্যাস পাচ্ছি না। প্রতি মাসে বিভিন্ন সংবাদে শুনি, সরকার নাকি এলপিজি সিলিন্ডারের দাম নির্ধারণ করে দেয়। শুনেছি অক্টোবর মাসে গ্যাসের দাম নাকি এক হাজার ২০০ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। আমি ৩ অক্টোবর এক হাজার ৪০০ টাকা দিয়ে ‘ইউনি’ ব্র্র্যান্ডের এলপিজি সিলিন্ডার গ্যাস কিনেছি।

 

২০০ টাকা বেশি রাখাতে আমি দোকানিকে বলি রিসিট দেয়ার জন্য। দোকানি রিসিটে লিখে দেয় গ্যাসের মূল্য এক হাজার ৩৫০ টাকা এবং বাসা পর্যন্ত ডেলিভারি চার্জ ৫০ টাকা, সর্বমোট এক হাজার ৪০০ টাকা। তবে অতিরিক্ত টাকা রাখার পরও বোঝার উপায় নেই, সিলিন্ডারের মধ্যে সঠিক ওজনের গ্যাস আছে কিনা। কখনোই ওজন করে দোকানদার সিলিন্ডার দেন না বলে অভিযোগ এই গৃহিণীর।

 

দাম কেন বেশি রাখল এ ব্যাপারে জানতে চাইলে খুচরা বিক্রেতা মোহাম্মদিয়া ট্রেডার্সের মালিক মো. মনির ইসলাম বলেন, ‘সরকারি রেটে সিলিন্ডার গ্যাস দেয়া সম্ভব নয়। সরকারি রেটে আমি নিজেই কিনতে পারি না, আপনাকে দেব কী করে!’

 

তিনি বলেন, আমার দোকানে আমি ‘ইউনি, জিএমআই, ডেল্টা’ ব্র্যান্ডের সিলিন্ডার রাখি। সেপ্টেম্বরে যখন সিলিন্ডারের দাম ছিল ১২৩৫ টাকা তখন আমার কিনতে হয়েছে ১২৮০ টাকা করে। ডিলাররা আমাদের বেশি দামে দিচ্ছে। ডিলারদের জিজ্ঞাসা করলে তারা বলে পরিবহন খরচ বেড়েছে, তাই দাম  বেশি। আমাদের বেশি দামে কিনতে হয়। আর লাভ ছাড়া তো আমাদের বিক্রি করা সম্ভব নয়।

 

খুচরা দোকান পর্যন্ত এলপিজি সিলিন্ডারের দাম কত রাখা হয়, এ ব্যাপারে জানতে চাইলে ইউনি গ্যাসের (রামপুরা, দক্ষিণ বনশ্রী, ত্রিমোহনী ও মেরাদিয়ে এলাকার) মার্কেটিং ম্যানেজার নূর মোহাম্মদ মুঠোফোনে কোনো জবাব দেননি। সরকারি সংস্থা বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি) নির্ধারিত দামের চেয়ে ১৫০ থেকে ২০০ টাকা বেশি মূল্য দিয়ে প্রতি মাসে এই গৃহিণীর মতো বেশিরভাগ ভোক্তাই গ্যাস সিলিন্ডার সংগ্রহ করেন। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, অতিরিক্ত দাম দিয়ে গ্যাস সংগ্রহ করতে হচ্ছে ঢাকাবাসীসহ দেশের সবখানেই। বিভিন্ন জেলা পর্যায়ে এলপিজি গ্রাহকদের সঙ্গে কথা বলে এমনই তথ্য পাওয়া গেছে।

 

গত ৫ অক্টোবর অতিরিক্ত দাম দিয়ে সিলিন্ডার গ্যাস কিনেছেন কুমিল্লা জেলার মুরাদনগরের শাহাগদা গ্রামের বাসিন্দা মো. শরীফ রেজাউল করিম ছিদ্দিকী। তিনি এক হাজার ৩৫০ টাকা দিয়ে ‘টোটাল’ নামক ব্র্যান্ডের সিলিন্ডার কিনেন। রেজাউল যে দোকান থেকে সিলিন্ডারটি কিনেছেন সে দোকানির সঙ্গে কথা হলে নাম প্রকাশ না করার শর্তে তিনি বলেন, আমরা কখনোই সরকারের দেয়া রেটে সিলিন্ডার কিনতে পারি না। বসুন্ধরা, যমুনা ও টোটাল কোনো ডিলারই আমাদের বিক্রির রশিদ দেয় না। যদি দাম নিয়ে কিছু বলতে যাই, তাহলে তারা সাপ্লাই বন্ধের হুমকি দেয়। তাই কিছু বলি না, আর গ্রামের সাধারণ গ্রাহকরাও প্রয়োজন মেটাতে বাড়তি দামে গ্যাস কিনছেন।

 

এদিকে বিইআরসি বলছে, গ্রাহকদের কাছে রান্নায় ব্যবহৃত এলপিজি সিলিন্ডার গ্যাস পৌঁছে দেয়া পর্যন্ত সরকারি রেট সব ব্যবসায়ীকে মানতে হবে। নিয়ম অনুযায়ী সিলিন্ডার ওজন করে দেয়ার কথা। আর ওজন দেয়ার ফলে ধারণা করা যেতে পারে, সিলিন্ডারে যে পরিমাণ গ্যাস থাকার কথা, তা আছে কিনা। সিলিন্ডারের দোকানে মূল্য তালিকা টাঙানোর নির্দেশ দেয়া আছে সরকারের পক্ষ থেকে।

 

বাজারে এলপিজির দাম কমিশনের নির্ধারিত দামে বিক্রি হয় না বলে অভিযোগ করা হলে নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিইআরসির একজন শীর্ষ কর্মকর্তা ভোরের আকাশকে বলেন, ‘দাম নির্ধারণ করার আগে আমরা কোম্পানিগুলোর সঙ্গে কথা বলে সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকি। নির্ধারিত দামে গ্রাহক পর্যন্ত পাওয়ার কথা। বেশি দাম রাখার ব্যাপারে লিখিত অভিযোগ না পেলে কোনো উদ্যোগ নিতে পারি না। কমিশনের আইনেও এটা করা যায় না। অন্য কোম্পানিগুলোর মতো স্বপ্রণোদিত হয়ে আমরা অভিযান পরিচালনা করতে পারি না। অধিকাংশ সময় সরকারের পক্ষ থেকে বেঁধে দেয়া এই নিয়ম মেনে চলা হয় না। ফলে গ্রাহকদের প্রতারিত হওয়ার আশঙ্কা থেকে যায় বলেও মনে করেন এই কর্মকর্তা। 

 

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক গ্যাসের এক ডিলার ভোরের আকাশকে জানান, কোম্পানির ভ্যাটসহ এলপিজি সিলিন্ডার গ্যাস সরবরাহ করে। ডিলারকে ১০৫ টাকা কেজিতে গ্যাস কিনতে হয়। এই হিসাবে দোকানির ১২ কেজির সিলিন্ডার গ্যাস কিনতে দাম পড়ে সর্বোচ্চ এক হাজার ২৮০ টাকা পর্যন্ত। ভ্যাট ধরার কারণে গ্যাসের দাম বেড়ে যায় বলেও জানান তিনি। আর সরকার দাম কমালে কোম্পানিগুলো পাত্তা দেয় না। কোম্পানিরা ডলারের রেট বেড়েছে বলে অজুহাত দেখায়। 

 

খুচরা বিক্রেতা এবং গ্রাহক পর্যায়ে গ্যাসের দাম কত রাখা হয়, এ সংক্রান্ত বিষয়ে জানতে কথা হয় বসুন্ধরা এলপিজি গ্যাসের ডিভিশনাল সেলস মেনেজার (কুমিল্লা) মো. জাহিদের সঙ্গে। তিনি বলেন, গ্রাহক কত করে সিলিন্ডার গ্যাস কিনছে সেটা আমাদের জানা নেই। এটা আমাদের দেখারও বিষয় না। আমরা ডিলারদের সাপ্লাই দিই, ডিলাররা খুচরা বিক্রেতাদের কাছে ১১৮০ থেকে ১২০০ টাকার মধ্যে বিক্রি করে। সরকারের দেয়া রেটের মধ্যেই খুচরা দোকানি পর্যন্ত গ্যাস পৌঁছে দিই। পরে খুচরা ব্যবসায়ীরা গ্রাহককে ১৪০০ টাকায়- না ১৫০০ টাকায় বিক্রি করলÑ তা আমাদের জানার বিষয় নয়।

 

এ বিষয়ে জানতে চাইলে বসুন্ধরা এলপিজি গ্যাসের এই ডিভিশনাল সেলস ম্যানেজার বলেন, সিলিন্ডারের দাম নির্ধারণে আমাদের কর্মচারীদের কোনো ভূমিকা নেই। দাম কত নির্ধারণ হবে তা কোম্পানির হায়ার অথরিটি সরকারের প্রতিনিধিদের সঙ্গে কথা বলে নির্ধারণ করেন। সে নির্দেশনা অনুযায়ী আমরা খুচরা দোকানিদের কাছে ১২শ টাকার মধ্যে বিক্রি করি।

 

ভোরের আকাশ/ইএস/