ঢাকা: বহুল প্রতীক্ষিত নড়াইলে দেশের প্রথম ছয় লেনের মধুমতী সেতু জাতীয় ক্ষেত্রেই নয়, আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রেও ভূমিকা রাখবে। প্রকল্পসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিসহ যোগাযোগ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সেতুটি চালু হওয়ায় দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলের মানুষের দ্রুত সড়ক যোগাযোগ সুবিধা বাড়ার পাশাপাশি অঞ্চলভিত্তিক শিল্পায়ন বাড়াবে। সেতুটি রাজধানী ঢাকা পর্যন্ত ১৩০ কিলোমিটারেরও বেশি দূরত্ব কমানোর পাশাপাশি অন্তত ১০ জেলার মানুষ কম সময়ে বিভিন্ন এলাকায় যাতায়াত করতে পারবেন। এটি দেশের বৃহত্তম স্থলবন্দর বেনাপোল, যশোর থেকে ঢাকা পর্যন্ত ভ্রমণের সময়ও কমিয়ে দেবে। সেইসঙ্গে দেশের অর্থনীতিতেও বিশেষ ভূমিকা পালন করবে বলেও মনে করেন তারা।
গত সোমবার ভার্চুয়ালি যুক্ত হয়ে দুটি সেতুর উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। উদ্বোধনী বক্তব্যে সেতু দুটি দেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে বলেও আশা প্রকাশ করেন প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলেন, ‘আমি মনে করি, যোগাযোগের ফলে আমাদের অবহেলিত অঞ্চলগুলো উন্নত হবে।’ সারা দেশে একটি যোগাযোগ নেটওয়ার্ক গড়ে তোলার লক্ষ্য নিয়ে আমরা কাজ করেছি জানিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, ‘এখন আমরা দাবি করতে পারি, বাংলাদেশের সব জেলার মধ্যে একটা সম্পর্ক হয়, সেই কাজটি আমরা করতে সক্ষম হয়েছি।’
জানা গেছে, জাপান ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন এজেন্সির (জাইকা) অর্থায়নে ৯৬০ কোটি টাকা ব্যয়ে মধুমতী নদীর ওপর ৬৯০ মিটার দীর্ঘ মধুমতী সেতু নির্মিত হয়েছে, যা স্থানীয়ভাবে কালনা সেতু নামে পরিচিত। এটি নড়াইল, গোপালগঞ্জ, খুলনা, মাগুরা, সাতক্ষীরা, চুয়াডাঙ্গা, যশোর এবং ঝিনাইদহ জেলাকে সংযুক্ত করেছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১৫ সালের ২৪ জানুয়ারি গোপালগঞ্জ জেলার কাশিয়ানী উপজেলা এবং নড়াইলের লোহাগড়া উপজেলার মধ্যে মধুমতী সেতুর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। এ অঞ্চলের মানুষ এখন পাটুরিয়া-দৌলতদিয়া ফেরিঘাট হয়ে ঢাকা-যশোর-বেনাপোল মহাসড়ক ব্যবহার করে, যার অর্থ তারা যশোর থেকে ঢাকায় পৌঁছাতে আরো ১৩০ কিলোমিটার বেশি ভ্রমণ করে। প্রকল্পের কর্মকর্তাদের মতে, সেতুটি এশিয়ান হাইওয়ের একটি অংশ যা রাজধানীকে দেশের বৃহত্তম বেনাপোল স্থলবন্দরসহ দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের সঙ্গে সংযুক্ত করবে।
সেতু চালুর পর এর সুবিধা প্রসঙ্গে কালনা সেতুর প্রকল্প ব্যবস্থাপক এবং সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তর নড়াইলের নির্বাহী প্রকৌশলী আশরাফুজ্জামান বলেন, ‘ছয় লেনের এ সেতু এশিয়ান হাইওয়ের ওপর অবস্থিত। সড়ক যোগাযোগের ক্ষেত্রে এটি সিলেটের তামাবিল হয়ে ঢাকা, ভাঙ্গা, নড়াইল, যশোর, বেনাপোল, কলকাতা পর্যন্ত সরাসরি ভূমিকা রাখবে। তবে এতদিন কালনা পয়েন্টে মধুমতী নদী ধারা বিছিন্ন ছিল। কালনা সেতু চালু হওয়ায় এটি শুধু জাতীয় ক্ষেত্রেই নয়, আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রেও ভূমিকা রাখবে। এছাড়া ভারত, কলকাতা, আসামসহ দেশের মধ্যে সাতক্ষীরার ভোমরা স্থলবন্দর, বেনাপোল ও নোয়াপাড়া নদীবন্দরের মধ্যে যোগাযোগের মাইলফলক রচিত হবে। এছাড়া নড়াইলের লোহাগড়ায় রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চল (ইপিজেড) চালুসহ ব্যবসা-বাণিজ্যের সম্প্রসারণ ও ব্যাপক কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে।’ ঢাকা থেকে ফরিদপুরের ভাঙ্গা পর্যন্ত এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণ করা হলেও ভাঙ্গা থেকে বেনাপোল পর্যন্ত এ ধরনের সড়ক নির্মিত হয়নি। ফলে এক্সপ্রেস ওয়ের সুফল পাচ্ছে না দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের বড় একটি অংশ। ভাঙ্গা থেকে নড়াইল-যশোর-বেনাপোল পর্যন্ত বর্তমানে দুই লেন সড়ক চালু রয়েছে।
এ অংশে এক্সপ্রেস ওয়ে সড়ক নির্মাণের বিষয়টি প্রকল্পাধীন বলে জানান কালনা সেতুর প্রকল্প ব্যবস্থাপক আশরাফুজ্জামান। তিনি বলেন, ‘কালনা সেতু চালু হওয়ায় যানবাহনের চাপ বেড়ে যাবে। তাই আপাতত যশোরের মনিহার সিনেমা হল চত্বর থেকে নড়াইলের কালনাঘাট পর্যন্ত ৫২ কিলোমিটার সড়ক প্রশস্ত করার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। বর্তমানে সড়কটি ১৮ ফুট প্রশস্ত থাকলেও তা বাড়িয়ে ২৪ ফুট করা হবে। দরপত্রের কাজ শেষ পর্যায়ে রয়েছে।
দরপত্র অনুমোদন হলে দুই সপ্তাহের মধ্যে ওয়ার্ক অর্ডার দেব জানিয়ে তিনি বলেন, নড়াইল অংশে প্রায় ৪৭ কোটি এবং যশোর অংশে ৩২ কোটি টাকা ব্যয়ে সড়ক প্রশস্ত করা হবে। এক বছরের মধ্যে কাজ শেষ করা হবে। এ লক্ষ্যে সড়কের দুই পাশে গাছ কাটার কাজ শুরু হয়েছে।’
লোহাগড়া উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি সিকদার আব্দুল হান্নান রুনু বলেন, ‘সরকারের উন্নয়ন ধারাবাহিকতার বড় সাফল্য পদ্মা সেতু। সেইসঙ্গে কালনা সেতুও। সড়ক পথে যোগাযোগের ক্ষেত্রে এ অঞ্চলের মানুষের নদনদীর আর কোনো প্রতিবন্ধকতা রইল না। ফলে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে অবদান রাখবে কালনা সেতু।
যশোর জেলা পরিবহন সংস্থা শ্রমিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক ও বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের খুলনা বিভাগীয় আঞ্চলিক কমিটির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক সেলিম রেজা মিঠু বলেন, ‘কালনা সেতু চালু হওয়ায় যশোর, বেনাপোল, সাতক্ষীরা, মেহেরপুর, মাগুরাসহ পাশের জেলাগুলোর সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা বদলে যাবে। রাজধানী ঢাকার সঙ্গে যোগাযোগ আরো সহজ হলো। বিআরটিএ সাবেক চেয়ারম্যান ও যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ আইয়ুবুর রহমান খান বলেন, পদ্মা সেতু উদ্বোধনের পর গোটা দেশের সড়ক পথের যোগাযোগ ব্যবস্থা হাতের নাগালে এনে দিয়েছে। কালনা সেতু এর গতিকে আরো ত্বরান্তিত করল, যা দেশের অর্থনীতিতে অবদান রাখবে। তেমনি স্থানীয়ভাবে এখন শিল্পায়নের পাশাপাশি কর্মসংস্থান বাড়বে। আন্তর্জাতিক সড়ক যোগাযোগ নেটওয়ার্কে সেতুটি বিশেষ ভূমিকা রাখায় দেশ অর্থনৈতিকভাবে আরো বেশি লাভবান হবে।
ভোরের আকাশ/আসা