logo
আপডেট : ১৬ অক্টোবর, ২০২২ ১৬:১৫
বাসরুট রেশনালাইজেশন প্রকল্পে ঘাটে ঘাটে ধাক্কা

বাসরুট রেশনালাইজেশন প্রকল্পে ঘাটে ঘাটে ধাক্কা

বিশেষ প্রতিনিধি

ছয় বছর আগে ২০১৫ সালে সরকার রাজধানীতে বাসরুট রেশনালাইজেশনের উদ্যোগ নেয়। উদ্দেশ্য ছিল নগরবাসীকে ভয়াবহ যানজট ও গণপরিবহনের অসুস্থ প্রতিযোগিতার কারণে সৃষ্ট দুর্ঘটনা থেকে পরিত্রাণ দেয়া। মূলত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের তৎকালীন মেয়র আনিসুল হক এ উদ্যোগ নিয়েছিলেন। সিদ্ধান্ত ছিল রেশনালাইজেশন পদ্ধতি বাস্তবায়নের মাধ্যমে রাজধানীর ৩৮৬ রুট ৪২টিতে এবং ৩০০ বাস কোম্পানির পরিবর্তে ২২টি বাস কোম্পানিতে নামিয়ে আনা।

 


ওই সিদ্ধান্তের আলোকে রাজধানীর গণপরিবহনে শৃঙ্খলা ফেরাতে ২০১৮ সালের ৯ সেপ্টেম্বর ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়রের নেতৃত্বে বাসরুট রেশনালাইজেশন কমিটি গঠন করা হয়। এ কমিটি ঢাকা শহরের বাসরুটগুলোকে ৪২টি রুটে পুনর্বিন্যাস করে। কিন্তু আজ পর্যন্তু মাত্র তিনটি রুটে বাস চালু করা গেছে।

 


২০২১ সালের ২৬ ডিসেম্বর একটি রুটে পাইলট কার্যক্রম উদ্বোধন করে বাসরুট রেশনালাইজেশন করে কমিটি। একটি রুট উদ্বোধনের ১০ মাস পর গত ১৩ অক্টোবর নতুন আরো দুই রুটে চালু হলো নগর পরিবহন। প্রকল্প-সংশ্লিষ্টরা বলছেন, যানবাহনের অভাব, পরিবহন মালিক ও শ্রমিক সমিতির বিরোধিতা, সরকারি অর্থায়ন সংকট, প্রকল্পের পরিধি বৃদ্ধিসহ নানা কারণে বাস্তবায়নে ধীরগতি হচ্ছে। প্রকল্প বাস্তবায়নে ঘাটে ঘাটে ধাক্কার মধ্যে ছয় বছরে মাত্র তিনটি রুট আলোর মুখ দেখল। ফলে সড়কে বিশৃঙ্খলা রোধ ও যানজট কমানোর চ্যালেঞ্জ থেকেই গেল।

 


বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটির (বিআরটিএ) হিসাব অনুযায়ী রাজধানীতে নিবন্ধিত বাস ও মিনিবাসের সংখ্যা এক লাখ ৩০ হাজারের বেশি! নিবন্ধিত ১৯ ধরনের যানবাহন মিলিয়ে নগরীতে চলছে ১৯ লাখ ২১ হাজারের বেশি গাড়ি। তবে পরিবহন মালিক সমিতির নেতারা বলছেন, মোটা দাগে রেজিস্ট্রেশন থাকলেও রাস্তায় চলাচলের উপযোগী বাসের সংখ্যা ১২ হাজারের বেশি নয়। ৩৮৬টি রুটে বিশৃঙ্খলভাবে এসব বাস চলছে। তারা বলছেন, বিআরটিএর শুরু থেকে এখন পর্যন্ত নিবন্ধিত বাসের সংখ্যা এক লাখ ৩০ হাজারের মতো। কিন্তু ২২-২৩ বছর আগে নিবন্ধিত গাড়িও রয়েছে বিআরটিএর তালিকায়, যা এখন আর রাস্তায় চলে না। এ কারণেই ঢাকায় চলাচলকারী বাসের পরিসংখ্যানের তথ্যে তফাৎ রয়েছে বিআরটিএ এবং মালিক সমিতির হিসাবে।

 


আয়োজকরা জানিয়েছেন, বাসরুট রেশনালাইজেশন বাস্তবায়নের লক্ষ্যে প্রাথমিকভাবে ৯টি ক্লাস্টার (৯টি ভিন্ন ভিন্ন রঙের) প্রস্তাবনা দেয়া হয়। এর মাঝে সবুজ ক্লাস্টারে বর্তমানে চলমান মোট ৫৪টি রুটকে সমন্বয় করে আটটি রুটে পরিণত করা হয়েছে, যার রুট নম্বর ২১ থেকে ২৮। এর মধ্যে ২১ নম্বর রুটটি বর্তমানে পাইলট রুট হিসেবে চলছে। এরই অংশ হিসেবে ২২ নম্বর রুটে অভি মটর্সের ৫০টি নতুন বাস এবং ২৬ নম্বর রুটে ২০১৯ সালের পর রেজিস্ট্রেশনকৃত বিআরটিসির দ্বিতল ৫০টি বাস সেবা চালু হয়েছে। ইতোমধ্যে প্রায় ৭০টি যাত্রী ছাউনি (বাস স্টপেজ) তৈরি করা হয়েছে।

 


প্রকল্প বাস্তবায়নে ধীরগতির কারণ হিসেবে বাসরুট রেশনালাইজেশন কমিটির সদস্য বুয়েটের অধ্যাপক ড. এস এম সালেহ উদ্দিন বলেন, ‘প্রথমত আমাদের গণপরিবহনে শৃঙ্খলার উদ্যোগ আগে কখনো নেয়া হয়নি। এতে এ উদ্যোগ বাস্তবায়নে নানা সমস্যা ও সংকটের মুখোমুখি হতে হচ্ছে। এর মধ্যে অন্যতম পরিবহন পরিকল্পনা ও ভূমি ব্যবহারের কোনো নীতিমালা ছিল না। আমরা নতুন করে সব তৈরি করছি। রাজধানীতে সড়ক রয়েছে ৮ শতাংশ। অথচ আদর্শ রাজধানীতে কমপক্ষে ২৫ শতাংশ সড়ক থাকার কথা। তাও আমাদের মাথায় রাখতে হচ্ছে। এ ছাড়া পার্কিং স্পেস সংকট, টার্মিনাল ও যাত্রীছাউনি নেই। একই সঙ্গে একটা বাসডিপো তৈরি হয়নি রাজধানীতে।’

 


তিনি বলেন, দেশে বাস উৎপাদন হয় না। আমরা আমদানিনির্ভর। তবে দেশে গাড়ির বডি তৈরি করা হয়। সেখানেও কারিগরি দিক দিয়ে একটু পিছিয়ে আছি। নতুন গাড়ি আমদানি করতে হলে একটা গাড়ির দাম পড়বে ৪০-৪২ লাখ টাকা। আর যদি বডি ছাড়া গাড়ি এনে দেশে তৈরি করি, তাহলে দাম পড়বে ৩০-৩২ লাখ টাকা। কিন্তু আমরা এক মাসে ১০০ গাড়ির বডি তৈরি করতে পারি না। এসব কারণে আমাদের কার্যক্রমের গতি কিছুটা কম।
গত বছরের ২৬ ডিসেম্বর ঘাটারচর থেকে কাচপুর পর্যন্ত নতুন ২১ নম্বর রুটে প্রথম ঢাকা নগর পরিবহনের যাত্রা শুরু হয়। সে সময় মোট ৫০টি সবুজ রঙের বাস দিয়ে চালু হয়েছিল সেবাটি।

 


২২ নং রুট হলো- ঘাটারচর, ওয়াশপুর, বসিলা, বসিলা সিএনজি স্ট্যান্ড, মোহাম্মদপুর বাসস্ট্যান্ড, টাউন হল, আসাদগেট, ফার্মগেট, কারওয়ান বাজার, বাংলামটর, শাহবাগ, কাকরাইল, ফকিরাপুল, মতিঝিল, টিকাটুলি, কাজলা, কোনাপাড়া এবং স্টাফ কোয়ার্টার। এ ছাড়া টিকটুলি থেকে কাজলা পর্যন্ত ফ্লাইওভারের ওপর দিয়ে বাস চলাচল করবে।

 


২৬ নম্বর রুট হলোÑ ঘাটারচর, ওয়াশপুর, বসিলা, বসিলা সিএনজি স্ট্যান্ড, মোহাম্মদপুর বাসস্ট্যান্ড, টাউন হল, আসাদগেট, সোবহানবাগ, কলাবাগান, সায়েন্সল্যাব, নিউ মার্কেট (নীলক্ষেত), আজিমপুর, পলাশী, চাঁনখারপুল, পোস্তগোলা, পাগলা (কদমতলী থানা) পর্যন্ত। এ ছাড়া এই রুটে চাঁনখারপুল থেকে পোস্তগোলা পর্যন্ত ফ্লাইওভারের ওপর দিয়ে বাস চলাচল করবে।

 


এ বিষয়ে ঢাকা পরিবহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষের (ডিটিসিএ) ডেপুটি ট্রান্সপোর্ট প্ল্যানার ধ্রুব আলম বলেন, ২২ নম্বর রুটের বাসগুলো চলতে শুরু করেছে। ২৬ নম্বর রুটের বিআরটিসির বাসগুলো একেবারে নতুন না হলেও ২০১৯ সালের পরে কেনা ৫০টি বাস দিয়ে চালু করা হবে। প্রতিটি বাসে ড্রাইভারসহ ৭৫টি আসন রয়েছে।

 


গত ১৩ অক্টোবর রাজধানীর মোহাম্মদপুর বেড়িবাঁধ চার রাস্তার মোড়ে নগর পরিবহনের দুটি রুটের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেন, পরিবহনে শৃঙ্খলা আমাদের জন্য একটি চ্যালেঞ্জ, এই চ্যালেঞ্জ অতিক্রম করতেই হবে। সিটি করপোরেশনের যে উদ্যোগ, এই উদ্যোগকে আমরা স্বাগত জানাই। এই উদ্যোগ সফল করতে হবে। সিটি করপোরেশনের এ কাজে সহযোগিতা করতে হবে।

 


নতুন দুটি রুটে বাস উদ্বোধনের পর বাসরুট রেশনালাইজেশন কমিটির সভাপতি ও ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপস বলেছেন, এখন থেকে নতুন বাসই ঢাকা শহরে নামবে। কোনো পুরোনো বাস নামার আর সুযোগ থাকবে না। এখন থেকে ২০২২, ভবিষ্যতে ২০২৩ যখনই একেকটি যাত্রাপথ শুরু করা হবে, তখন নতুন বাস দিয়েই সেই যাত্রাপথ শুরু করা হবে। তিনি বলেন, এখন থেকে ঢাকা শহরে নতুন বাস নামবে। পুরোনো বাস নামার আর কোনো সুযোগ নেই। আমরা নতুন বাস দিয়েই যাত্রাপথ শুরু করব। বাস রেশনালাইজেশনের ২১, ২২ ও ২৩ এই তিনটি যাত্রাপথ শুরু করতে নগর কর্তৃপক্ষকে অনেক প্রতিকূলতা পোহাতে হয়েছে বলেও জানান মেয়র তাপস। তিনি বলেন, আগামী নভেম্বরে আরেকটি রুট চালু হবে।

 


২০০৪ সালে ঢাকার জন্য করা ২০ বছরের পরিবহন পরিকল্পনায় ‘বাসরুট রেশনালাইজেশন’ বা বাসরুট ফ্র্যাঞ্চাইজ চালু করার পরামর্শ দেয়া হয়। বিশেষ এ ব্যবস্থার মূল লক্ষ্য হচ্ছে লক্কড়ঝক্কড় বাস তুলে নেয়া। এই রুট রেশনালাইজেশন হলে লক্কড়ঝক্কড় বাস তুলে ২০১৯ এবং এর পরে ২০২১ সালের মডেলের বাস চালাতে হবে। ভাড়া নেয়া হবে ডিজিটাল পদ্ধতিতে। পরিবহন মালিকরা রুটে বাস দিয়ে সরাসরি ভাড়া পাবেন না। তারা মাস শেষে ঢাকা পরিবহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে নির্ধারিত হারে ভাড়া নেবেন। চালক ও বাসের স্টাফরা হবেন নিয়োগপ্রাপ্ত। ট্রিপভিত্তিক ও চুক্তিভিত্তিক কোনো বাস চলবে না। আর ঢাকা থেকে মিনিবাস উঠে যাবে।

 


প্রকল্প বাস্তবায়নে বাস মালিক সমিতির বিরোধী প্রসঙ্গে জানতে চাইলে সড়ক পরিবহন সমিতির মহাসচিব খন্দকার এনায়েত উল্যাহ বলেন, আমরা প্রকল্প সংশ্লিষ্টদের সহযোগিতা করার চেষ্টা করছি। কিন্তু সরকারের পক্ষ থেকে মালিকদের অল্প সুদে ঋণ দেয়ার কথা থাকলেও তা হচ্ছে না। তাই নতুন বাস নামাতে মালিকদের কষ্ট হচ্ছে। বাস না থাকলে বিভিন্ন রুটে আমরা কিভাবে বরাদ্দ দেব। তাই প্রকল্প বাস্তবায়নে বিলম্ব হচ্ছে।

 


নতুন দুটি রুটের (২২ ও ২৬ নম্বর রুট) মধ্যে ২২ নম্বর রুট হচ্ছে-কেরানীগঞ্জের ঘাটারচর থেকে ওয়াশপুর, বছিলা, মোহাম্মদপুর বাস স্ট্যান্ড, মোহাম্মদপুর টাউন হল, আসাদ গেট, ফার্মগেট, কারওয়ান বাজার, বাংলামোটর, শাহবাগ, কাকরাইল, ফকিরাপুল, মতিঝিল, টিকাটুলী, সায়েদাবাদ, যাত্রাবাড়ী, কোনাপাড়া হয়ে ডেমরা স্টাফ কোয়ার্টার পর্যন্ত। ২৬ নম্বর রুট হচ্ছে ঘাটারচর থেকে ওয়াশপুর, বছিলা, মোহাম্মদপুর টাউন হল, আসাদ গেট, সোবহানবাগ, কলাবাগান, সায়েন্স ল্যাব, নিউমার্কেট, আজিমপুর, পলাশী, চাঁনখারপুল, মেয়র হানিফ উড়ালসড়ক হয়ে পোস্তগোলা, পাগলা (কদমতলী থানা) পর্যন্ত।

 


এর আগে গতবছর ২৬ ডিসেম্বর চালু হয় ২১ নম্বর রুট। এই রুটে ঘাটারচর থেকে মোহাম্মদপুর, জিগাতলা, প্রেসক্লাব, মতিঝিল, যাত্রাবাড়ী হয়ে কাঁচপুর পর্যন্ত ঢাকা নগর পরিবহনের বাস সেবা শুরু করে।