logo
আপডেট : ১৭ অক্টোবর, ২০২২ ১৮:৫১
রাজধানীতে টেকা দায়, গাঁয়ের ডাক শুনতে পাচ্ছেন মধ্যবিত্তরা
মুস্তাফিজুর রহমান নাহিদ

রাজধানীতে টেকা দায়, গাঁয়ের ডাক শুনতে পাচ্ছেন মধ্যবিত্তরা

‘বাঁচতে হলে লাঙল ধর রে/আবার এসে গাঁয়’ শেখ ফজলুল করিমের এ কবিতা কিংবা বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘দিঘির সেই জল শীতল কালো/তাহারই কোলে গিয়ে মরণ ভালো/পুরোনো সেই সুরে কে যেন ডাকে দূরে’- এ লেখনীর মতো রাজধানীর মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্তরা গাঁয়ের ডাক শুনতে পাচ্ছেন। নিত্যপ্রয়োজনীয় সামগ্রীর পাহাড়সম দাম; লাগামহীন বাড়ি ভাড়া বৃদ্ধি; গ্যাস, বিদ্যুৎ ও তেলের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি; সর্বোপরি আয় না বাড়ায় শহরে টিকতে পারছেন না ভুক্তভোগীরা। পরিবার নিয়ে জীবন চালাতে হিমশিম খাচ্ছেন। এ পরিস্থিতিতে শহরে ছেড়ে গ্রামে ফেরার জন্য তৈরি হচ্ছেন মধ্যবিত্তরা। করোনার মধ্যেই এ পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে, যা এখনো চলছে।

 


রাশেদুল ইসলাম (ছদ্মনাম)। বাড়ি কুষ্টিয়ার কুমারখালী। ছাত্রজীবনে ঢাকা এসেছিলেন। এরপর চাকরি, বিয়ে; অতঃপর স্ত্রী ও দুই সন্তান নিয়ে সুখেই সংসার করছিলেন। চাকরি ছিল একটি প্রাইভেট কোম্পানিতে। করোনার ধাক্কায় তার চাকরি চলে যায়। পরে দিনের পর দিন সঞ্চয় ভেঙে খাচ্ছিলেন। শেষ পর্যন্ত টিকতে পারে ঢাকা ছেড়েছেন। বিষয়টি নিয়ে কথা বলতে গেলে আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েন রাশেদুল। বলেন, ‘বাধ্য হয়েই ঢাকা ছেড়ে চলে যেতে হলো। ইচ্ছা ছিল সন্তানদের ঢাকায় রাখব, ভালো স্কুলে পড়াব। কিন্তু পরিস্থিতি উল্টো, ঢাকায় থাকলে বাচ্চাদের মুখে অন্ন তুলে দেয়াই মুশকিল হবে। তাই চলে যাচ্ছি। ঢাকায় আর ফেরার ইচ্ছে নেই। সন্তানরা বড় হলে যদি ঢাকায় আসতে চায়, আসবে। আমার ঢাকায় থাকার ইচ্ছা ফিকে হয়ে গেছে।

 

একই বিষয়ে কথা হয় রফিক মিয়া নামে এক রিকশাচালকের সঙ্গে। তিনি ফার্মগেট-নাখালপাড়া এলাকায় রিকশা চালান। তিনি বলেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে অনেকে আর রিকশায় উঠতে চান না। খরচ বাঁচাতে অনেকে হেঁটে যান। কারণ তাদেরও খরচ বেড়েছে। অন্যদিকে আমাদেরও সংসার খরচ বেড়েছে। বাড়িতে তিন ছেলেমেয়ে, স্ত্রী এবং বাবা রয়েছে। তাদের খরচ একা চালাতে হয়। এর মধ্যে আবার সমিতির কিস্তি দিতে হয়। সব মিলিয়ে অবস্থা খুব খারাপ। এখন আর পারছি না। ভাবছি এ মাসের শেষদিকে গ্রামের বাড়ি পঞ্চগড়ে ফিরে যাব। সেখানে গিয়ে একটা কিছু করতে হবে। কপালে যা আছে, তাই হবে! এ তো গেল রাশেদুল ইসলাম বা রফিক মিয়ার কথা। তাদের মতো অবস্থা আরো অনেকের। বেঁচে থাকার নেশায় গ্রামে ফিরে যাচ্ছেন তারা।

 


জীবনযাত্রার অত্যধিক ব্যয়ের সবচেয়ে বড় প্রভাব পড়েছে নিম্ন ও মধ্যবিত্ত পরিবারগুলোর ওপর। সর্বময় চেষ্টা করেও তারা থাকতে পারছেন না শহরে। এরই মধ্যে কর্মহীন হয়ে পড়া, চাকরিতে বেতন না পাওয়া এবং বাড়ি ভাড়া পরিশোধের বিড়ম্বনাসহ আরো বিভিন্ন সমস্যার সঙ্গী হয়েছেন তারা। গত এক বছরে সংসারের ব্যয় অনেক বেড়েছে। পক্ষান্তরে বাড়েনি আয়। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির পদতলে জনজীবন পিষ্ট হয়ে পড়েছে। দেয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়ায় বাধ্য হয়ে গ্রাম থেকে আসা মানুষকে সেই গ্রামেই ফিরে যেতে হচ্ছে। জীবনযাত্রার ব্যয় বাড়ার কারণে দৈনন্দিন পারিবারিক চাহিদা মেটাতে পরিবারপ্রধানদের যেন জীবন যায়-যায়। কোথায় গিয়ে দাঁড়াবেন, কী করবেন, কী খাবেন, কীভাবে দিন কাটবে- এ যেন সবার কাছে এখন অচেনা এক প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে। দিশাহারা হয়ে কান্নায় ভেঙে পড়া মধ্যবিত্তরা পড়েছেন বিপাকে।

 

তারা আরো বলছেন, কারো কাছে যেতে পারেন না, বলতে পারেন না; না পারেন বাসাবাড়িতে কাজ করতে। তাই ঢাকার বাসা ছেড়ে দিয়ে স্ত্রী-সন্তানকে গ্রামে পাঠাতে বাধ্য হয়েছেন অনেকেই। সম্প্রতি উন্নয়নশীল বিশ্বে দারিদ্র্যের হার করোনা মহামারির চেয়ে দ্রুত বেড়েছে। করোনার ধাক্কা সামলে বিশ্বের ছোট-বড় সব দেশেই কমবেশি অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার শুরু হয়। পুনরুদ্ধার প্রক্রিয়া শুরু হওয়ার পরপরই আন্তর্জাতিক বাজারে নিত্যপণ্য ও শিল্পের কাঁচামালের দাম বাড়তে থাকে। এর সঙ্গে গত ফেব্রুয়ারি মাসে ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ আন্তর্জাতিক পণ্যবাজারকে আরো উসকে দেয়। বাংলাদেশকেও আন্তর্জাতিক বাজার থেকে বাড়তি দামে পণ্য ও কাঁচামাল কিনতে হচ্ছে। এতে আমদানি খরচ বেড়েছে। ডলারের মূল্যবৃদ্ধির ফলে আমদানি খরচ আরো বেড়েছে। এছাড়া দেশের বাজারে জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোয় উৎপাদন ও পরিবহন ব্যয় বেড়েছে। ফলে নিত্যপণ্যের দাম প্রতিনিয়ত বাড়ছেই। অনেক এলাকার বাসিন্দাদের গ্যাস ও পানির কষ্ট জীবনকে অসহনীয় করে তুলেছে।

 


বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্যানুযায়ী, গত অর্থবছরের শেষ মাস জুনে দেশে সার্বিক মূল্যস্ফীতি হয়েছে ৭.৫৬ শতাংশ। আর ওই মাসে মজুরি বেড়েছে ৬.৪৭ শতাংশ। গত বছরের জুনে যে পণ্য বা সেবা ১০০ টাকায় পাওয়া যেত, সেই পণ্য বা সেবা পেতে এখন ১০৭ টাকা ৫৬ পয়সা খরচ করতে হচ্ছে। অন্যদিকে যে দিনমজুর-শ্রমিক বা অন্য পেশার মানুষ গত বছরের জুনে তার শ্রমের বিনিময়ে ১০০ টাকা পেয়েছেন, চলতি বছরের জুনে তারা পেয়েছেন ১০৬ টাকা ৪৭ পয়সা। অর্থাৎ বছর ঘুরে আয় বেড়েছে। কিন্তু তাতে খুব একটা লাভ হয়নি। উল্টো ১০৬ টাকা ৪৭ পয়সা আয়ের বিপরীতে এখন খরচ করতে হচ্ছে ১০৭ টাকা ৫৬ পয়সা। করোনার প্রথম দিকের সময়ে মানুষ ধারকর্জ করেছে বা সঞ্চয় ভেঙে জীবন চালিয়েছে। এখন কিন্তু সে অবস্থাও নেই। করোনার দীর্ঘ অভিঘাতে মানুষের আয় কমে গেছে। কিন্তু বাজার খরচ কমেনি। এমন পরিস্থিতিতে বাজারে প্রয়োজনীয় খাদ্যপণ্যের দাম অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যাওয়ায় চাপে রয়েছেন ভোক্তারা। মহামারি রূপ নেয়া করোনা থেকে রেহাই পেতে রীতিমতো যুদ্ধ করছে বিশ্ববাসী। এর প্রভাবে বৈশ্বিক অর্থনীতি ধসে পড়েছে। মহামারি করোনার সংক্রমণে কাজ হারিয়েছেন অসংখ্য মানুষ। ফলে এমন অবস্থায় নিম্ন ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির প্রায় সব মানুষেরই নাভিশ্বাস উঠেছে জীবন চালাতে। যার প্রভাব পড়েছে বাংলাদেশেও। কয়েক মাসে সবজির দাম দ্বিগুণ থেকে তিনগুণ হয়ে গেছে। আয় কমে গেছে অনেকের। আয় কমে গেছে রিকশা ও অটোরিকশাচালকদের। খাদ্যদ্রব্যসহ বিভিন্ন জিনিসের দাম বেড়েছে। এখন কোনোমতে খেয়ে বেঁচে আছেন। আগে যে মধ্যবিত্ত কিংবা নিম্নমধ্যবিত্ত রিকশা ও অটোরিকশায় চড়ত, এখন তারা টাকা বাঁচাতে বাসে যাতায়াত করছেন।

 


দেশের নিম্নবিত্ত, দিনমজুর-শ্রমিকসহ বেসরকারি পেশাজীবীদের ব্যয় বেড়েছে প্রায় দেড়গুণ। সেই হারে আয় বাড়েনি। সাধারণ মানুষের জীবনধারণের ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় কিছু ক্ষেত্রে তারা ব্যয় সংকোচন করছেন। ফলে শ্রমিক শ্রেণির অনেক ক্ষেত্রে আয় আরো কমেছে। মানুষের সঞ্চয় কমছে। ব্যক্তির ভবিষ্যৎ, আর্থিক নিরাপত্তা অনিশ্চিত হয়ে পড়ছে। গ্রামে গেলে অন্তত ঘর ভাড়াটা লাগবে না। মূলত এজন্যই ঢাকা ছাড়ছেন সাধারণ মানুষ।

 

প্রসঙ্গত, মানুষের মৌলিক মানবিক চাহিদাগুলোর মধ্যে অন্নের প্রয়োজন সবার ওপরে। কিন্তু খাদ্যদ্রব্য, চাল, ডাল, তেল, লবণ, মরিচ, পেঁয়াজ, রসুন, মাছ, তরকারি, চিনি, দুধ ইত্যাদি নিত্যদিনের প্রয়োজনীয় জিনিসের মূল্যের অস্বাভাবিক ঊর্ধ্বগতি জনজীবনের গতিকে অচল ও আড়ষ্ট করে তোলে।

 

এদিকে বিআইডিএসের সাম্প্রতিক জরিপে বলা হচ্ছে, করোনায় ১ কোটি ৬৪ লাখ মানুষ নতুন করে গরিব হয়েছে, দারিদ্র্যসীমার নিচে নেমে গেছে। তাই এখন দেশে গরিব মানুষের সংখ্যা ৫ কোটির বেশি। সামনের দিনে এ সংখ্যা আরো বাড়বে বলে মনে করে সংস্থা দুুটি। ফলে করোনা-পরবর্তী সময়ে মানুষের কাজের সুযোগ বাড়াতে হবে। বিশেষ করে নিম্ন ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষকে কাজ দিতে না পারলে দারিদ্র্যসীমার ভয়াবহতার দিকে এগিয়ে যাবে। এতে আমাদের সব ধরনের উন্নয়ন কার্যক্রমই বাধাগ্রস্ত হবে। বাংলাদেশে প্রায় ১৬ কোটি মানুষের ৪ কোটি পরিবারের মধ্যে নিম্নবিত্ত ২০ আর উচ্চবিত্ত ২০ শতাংশ। মাঝের যে ৬০ শতাংশ এরা নিম্ন, মধ্য ও উচ্চমধ্যবিত্ত।

 

ভোরের আকাশ/আসা