ঢাকা: দেশের ডেঙ্গু পরিস্থিতি নিয়ে বেড়েছে উদ্বেগ। সব জেলায় ছড়িয়ে পড়েছে ডেঙ্গু রোগী। স্বাস্থ্যমন্ত্রী ও স্বাস্থ্য সচিব ইতোমধ্যে সতর্কতামূলক নির্দেশনা দিয়েছেন। ঘরে-বাইরে চলে এডিস মশার কামড়। গত দুই মাস ধরে দেশে ডেঙ্গু পরিস্থিতির অবনতি অব্যাহত রয়েছে। বর্তমানে দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রোগীর সংখ্যা তিন হাজার ছাড়িয়ে গেছে। আর ডেঙ্গুতে মোট মৃতের সংখ্যা দাঁড়াল ৯৯ জনে।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এডিস মশার লার্ভা নিধনে সফলতা না পাওয়ায় প্রাপ্তবয়স্ক মশার সংখ্যা আশঙ্কাজনক হারে বেড়েছে। যতই বলা হোক নাগরিক, সিটি করপোরেশন এবং স্থানীয় দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রশাসন এ ব্যাপারে সচেতন নয়। ডেঙ্গু শুরু হলে আমরা নানা কথা বলি। কিন্তু এডিস মশার প্রজনন ঠেকাতে কার্যকর ব্যবস্থা নেয়া হয় না। সবাই জানেন, স্বচ্ছ ও বদ্ধ পানিতে এডিস মশার প্রজনন হয়। কিন্তু আগাম কোনো প্রস্তুতি থাকে না বলে ক্ষোভ প্রকাশ করেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা।
স্বাস্থ্যমন্ত্রী ও স্বাস্থ্য সচিবের সতর্কবার্তা : মঙ্গলবার রাজধানীর একটি হোটেলে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক বলেছেন, এখন প্রত্যেক জেলায় ডেঙ্গুরোগী পাওয়া যাচ্ছে। হাসপাতালে তিন হাজারের বেশি রোগী ভর্তি আছে। আমরা চিকিৎসা দিয়ে যাচ্ছি। কিন্তু রোগীর সংখ্যা না কমলে মৃত্যুর সংখ্যা কমানো কঠিন। তাই মানুষকে সচেতন হতে হবে।
স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেন, ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে সিটি করপোরেশনের সঙ্গে যৌথভাবে কাজ করছি, যেন শিগগির পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনা যায়। এর বিকল্প নেই। যেসব এলাকায় মশা বেশি সেসব এলাকায় স্থানীয় প্রশাসনকে অ্যাকটিভ হতে হবে। যেন মশা কমে আসে, আক্রান্তের সংখ্যা কমে আসে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে যতটা সম্ভব সহযোগিতা করা হবে।
এদিকে সোমবার স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে ডেঙ্গু প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণবিষয়ক সভা শেষে স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের সচিব আনোয়ার হোসেন বলেন, প্রতিদিনই নতুন রোগী হাসপাতালে আসছে। হাসপাতালগুলোতে সিট না থাকলেও রোগীরা আসছে। কিন্তু আমরা তো তাদের ফেরত পাঠাতে পারি না। মেঝেতে হলেও তাদের জায়গা দিচ্ছি, চিকিৎসাসেবা দিচ্ছি।
স্বাস্থ্য সচিব বলেন, ডেঙ্গু রোগী বেড়ে যাওয়ায় দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে ডেঙ্গু চিকিৎসায় প্রয়োজনে আলাদা ইউনিট খুলতে হবে। বৃষ্টি আর কদিন থাকবে জানি না। যদি পরিস্থিতির উন্নতি হয়, তাহলে হয়তো ডেঙ্গু কমে যাবে। কিন্তু এখন ট্রেন্ড ওপরের দিকে। ২০১৯ সালে ভয়াবহ পরিস্থিতি হয়ে সারা দেশে একটা বিপর্যয়ের মধ্যে পড়েছিলাম আমরা, সেটা হতে দেয়া যাবে না। হাসপাতাল ব্যবস্থাপনায় আমরা সতর্ক থাকব।
এডিস মশা চার গুণ বেশি : স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে মশার ঘনত্ব নিয়ে যে প্রাক-মৌসুম জরিপ তা থেকে জানা গেছে, এই সময়ে এডিস মশার ঘনত্ব চারগুণ বেড়েছে। সম্প্রতি ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন এলাকায় স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার জাতীয় ম্যালেরিয়া নির্মূল ও এডিসবাহিত রোগ নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির আওতায় এডিস মশার মৌসুমকালীন জরিপ শেষ হয়েছে। এতে ঢাকায় প্রায় ৭৭.৯ শতাংশ কিউলেক্স মশা, বাকি ২২.১ শতাংশ এডিস মশা পাওয়া গেছে। এর আগে প্রাক-মৌসুম জরিপে ঢাকায় ৯৫ শতাংশের বেশি কিউলেক্স মশা আর পাঁচ শতাংশ এডিস মশা পাওয়া যায়। সেই তুলনায় ঢাকায় ডেঙ্গুর বাহক এডিস মশা চারগুণেরও বেশি বেড়েছে।
উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) ৪৮টি সাইট ও ৪০টি ওয়ার্ডে এবং ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) ৬২টি সাইট ও ৫৮টি ওয়ার্ডে করা স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের জরিপে তিন হাজার ১৫০টি বাড়ি থেকে নমুনা নেয়া হয়েছে বলে জানা গেছে। ডিএনসিসির ১৩টি ও ডিএসসিসির ১৯টি ওয়ার্ড অতি ঝুঁকিপূর্ণ এবং দুই সিটিতে ঝুঁকিপূর্ণ ওয়ার্ডের সংখ্যা মোট ৫৯টি। ঢাকা উত্তর সিটির ঝুঁকিপূর্ণ ওয়ার্ড ২৬টি আর দক্ষিণের ৩৩টি।
সচেতনতার বিকল্প নেই- জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা : জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ও কীটতত্ত্ববিদ অধ্যাপক ড. আবদুল আলিম জানান, গত এক মাসে বৃষ্টি এবং থেমে থেমে বৃষ্টি বেড়ে যাওয়ায় ডেঙ্গুর জন্য দায়ী এডিস মশা বেড়ে গেছে। টানা বৃষ্টিতে লার্ভা ভেসে যায়। কিন্তু থেমে থেমে বৃষ্টিতে স্বচ্ছ পানি জমে, যা এডিস মশার প্রজননের জন্য সহায়ক। সামনে এটা আরো বাড়বে। কমপক্ষে আরো এক মাস পরিস্থিতি আরো খারাপের দিকে যাবে।
প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত চিকিৎসক, মেডিসিন বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. এম আব্দুল্লাহ ভোরের আকাশকে বলেন, দেশের ডেঙ্গু পরিস্থিতি নিয়ে বেড়েছে উদ্বেগ। সব জেলায় ছড়িয়ে পড়েছে ডেঙ্গু রোগী। এটা ডেঙ্গুর মৌসুম। গত বছরও এ সময়ে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত ছিল। এবার থেমে থেমে বৃষ্টি বেশি হওয়ায় এডিস মশাও বেশি। আক্রান্তও বেশি হচ্ছে। তবে শিশুদের মধ্যে আক্রান্তের হার বেশি।
তিনি বলেন, সচেতনতার অভাবেই প্রতি বছর এভাবে ডেঙ্গু হানা দেয়। শিশুদের এই সময়ে হাত-পা ঢাকা জামা-কাপড় পরানো উচিত। তারা দিনে ঘুমালে মশারি টানিয়ে দেয়া উচিত। ডেঙ্গুর জন্য দায়ী এডিস মশা দিনে কামড়ায়। তখন অধিকাংশ শিশু স্কুলে থাকে। স্কুল থেকেও কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয় না। এখন করোনাও আছে। তাই করোনার টেস্ট করালে সঙ্গে ডেঙ্গুর টেস্টও করাতে হবে। জ্বর হলে অপেক্ষা না করে দ্রুত টেস্ট করালে ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী দ্রুত শনাক্ত করা যায়। ফলে ঝুঁকি কমে যায়। আর জ্বর হলে নিজের চিকিৎসা নিজে না করে দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। আমাদের ডেঙ্গু চিকিৎসায় কোনো সংকট নেই। তবে আবহাওয়া এবং সচেতনতার অভাবের কারণে ডেঙ্গু রোগী আরো বাড়বে বলে আশঙ্কা করছেন বলে জানান অধ্যাপক ডা. এবিএম আব্দুল্লাহ।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোল রুমের ইনচার্জ ডা. মো. জাহিদুল ইসলাম জানান, গত ২৪ ঘণ্টায় দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন নতুন ৯০০ জন এবং মারা গেছেন তিনজন। চলতি বছরে ১৮ অক্টোবর পর্যন্ত ডেঙ্গুতে মোট মারা গেছেন ৯৯ জন।
ডা. মো. জাহিদুল ইসলাম আরো জানান, ২৪ ঘণ্টায় ডেঙ্গুজ্বরে আক্রান্ত হয়ে ৯০০ জন নতুন রোগী দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। এর মধ্যে ঢাকায় ৫২৮ এবং ঢাকার বাইরে ৩৭২ জন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। বর্তমানে সারা দেশে সর্বমোট ৩ হাজার ২২৭ জন ডেঙ্গু রোগী হাসপাতালে ভর্তি রয়েছেন। এর মধ্যে ঢাকার বিভিন্ন হাসপাতালে ২ হাজার ১৪৮ এবং ঢাকার বাইরে এক হাজার ৭৯ জন ডেঙ্গু রোগী ভর্তি রয়েছেন।
এ বছর ১ জানুয়ারি থেকে ১৮ অক্টোবর পর্যন্ত দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি রোগীর সংখ্যা সর্বমোট ২৬ হাজার ৯৩৮ জন। এর মধ্যে ঢাকায় ভর্তি রোগীর সংখ্যা মোট ১৯ হাজার ৪৯৮ জন এবং ঢাকার বাইরে সারাদেশে ভর্তি রোগীর সংখ্যা মোট ৭ হাজার ৪৪০ জন। একই সময় সারাদেশে ছাড়প্রাপ্ত রোগীর সংখ্যা মোট ২৩ হাজার ৬১২ জন। এর মধ্যে ঢাকায় ছাড়প্রাপ্ত রোগীর সংখ্যা মোট ১৭ হাজার ২৯৫ জন এবং ঢাকার বাইরে সারাদেশে ছাড়প্রাপ্ত রোগীর সংখ্যা সর্বমোট ৬ হাজার ৩১৭ জন।
ভোরের আকাশ/আসা