খুলনা: খুলনা বিভাগীয় সমাবেশে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া আগামী সংসদ নির্বাচন হতে দেয়া হবে না। বর্তমান সরকার সুষ্ঠু নির্বাচনের ভয় পায় উল্লেখ করে তিনি বলেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে ভোট হলে আওয়ামী লীগ ১০টি আসনও পাবে না।
শনিবার বিকেলে খুলনা মহানগরীর সোনালী ব্যাংক চত্বরে আয়োজিত বিভাগীয় গণসমাবেশে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন। এদিকে এ সমাবেশকে কেন্দ্র করে পথে পথে নেতাকর্মীদের বাধা দেয়া হয়েছে বলে অভিযোগ বিএনপির। সমাবেশের দুদিন আগে থেকে পরিবহন ধর্মঘটের পাশাপাশি লঞ্চও বন্ধ করে দেয়া হয়। তারপরও এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে বিশাল জনসমাগম নিয়ে সমাবেশ সফল হয়েছে বলে দাবি করেছে বিএনপি। বড় ধরনের কোনো সংঘাতময় পরিস্থিতি সৃষ্টি না হলেও সমাবেশ শেষে গন্তব্যে ফেরার সময় বিএনপি নেতাকর্মীদের ওপর হামলারও অভিযোগ রয়েছে।
বিএনপি মহাসচিব বলেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন করতে সরকার ভয় পায়। সরকারের উদ্দেশে তিনি বলেন, আপনারা অবিলম্বে পদত্যাগ করুন। সংসদ বিলুপ্ত করে নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করুন। কারণ আপনাদের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন হতে পারে না। গাইবান্ধায় প্রমাণ হয়েছে দলীয় সরকারের অধীনে ডিসি-এসপিরা নির্বাচন কমিশনের কথা শোনে না।
মির্জা ফখরুল বলেন, ২০১৪ সালে বিনাভোটে ক্ষমতায় এসেছে আওয়ামী লীগ। আর ২০১৮ সালে আগের দিন রাতে ভোট হয়েছে। এবারো আগামী সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে সরকার আরো একটি ষড়যন্ত্র লিপ্ত। তারা রাষ্ট্রযন্ত্রকে ব্যবহার করে ক্ষমতা টিকে থাকতে চায়। কিন্তু এবার কোনো ষড়যন্ত্র মানবে না দেশের মানুষ। তিনি বলেন, দুদিন ধরে বাস বন্ধ ও নৌপরিবহন বন্ধ করে দিয়েছে। কিন্তু এত কিছুর পরও গণতন্ত্রের লড়াইয়ের যে সংগ্রাম, তাতে বাধা দিতে পারেনি সরকার। প্রশাসনকে ব্যবহার করে জনগণকে দমিয়ে রাখা যায় না। আজকে সেটা আবার প্রমাণ হয়েছে। খুলনার এ সমাবেশে নতুন করে নতুন করে বলীয়ান হয়েছে বিএনপি।
মির্জা ফখরুল বলেন, আওয়ামী লীগ সংবিধান ও মানবাধিকার লঙ্ঘন করেছে। বিচার বিভাগের সম্পূর্ণ দলীয়করণ করেছে। স্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে নষ্ট করে দিয়েছে। মানুষ সেবা পায় না। বিদ্যুতের উন্নয়নের নামে লুটপাট করেছে। নিত্যপণ্যের দাম বৃদ্ধিতে মানুষ এখন ভয়াবহ কষ্টে আছে। চাকরি দেয়ার নামের এখন চলছে বাণিজ্য। তিনি বলেন, জনগণের অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে এ সরকারের পতন করতে হবে। বাংলাদেশের জন্য আমরা ১৯৭১ সালে যুদ্ধ করেছিলাম। আমরা সেই গণতান্ত্রিক বাংলাদেশকে ফিরে পেতে চাই। যার জন্য দরকার আন্দোলন আর আন্দোলন। কঠোর আন্দোলনের মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা ফিরিয়ে আনতে হবে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন হলে বিএনপি ক্ষমতায় আসবে জানিয়ে তিনি বলেন, আগামী দিনে সাবেক তিনবারের প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়াকে মুক্ত করতে হবে। তারেক রহমানকে দেশে ফিরিয়ে আনতে হবে। ভবিষ্যতে যদি রাষ্ট্রক্ষমতার গেলে তরুণ যুবকদের জন্য কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা, চাকরির ব্যবস্থা ও ন্যায়বিচারের ব্যবস্থা করা হবে। আর যারা মেগা প্রযুক্তির নামে মেগা দুর্নীতি তদন্তে কমিশন গঠন করবে বিএনপি। মির্জা ফখরুল বলেন, গত কয়েকদিনে সব মিলিয়ে ৫ শতাধিক নেতাকর্মী গ্রেপ্তার করা হয়েছে। কেশবপুরে ও চুকনগরে গুলি করা হয়েছে কয়েকজন কর্মীকে। এছাড়া খুলনার বিভাগের বেশিরভাগ জায়গায় হামলা চালানো হয়েছে সমাবেশমুখী নেতাকর্মীদের ওপর।
জ্বালানি তেল ও নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি, দলীয় কর্মসূচিতে গুলি করে নেতাকর্মীদের হত্যার প্রতিবাদ, নির্বাচনকালীন নির্দলীয় নিরপক্ষে সরকার ও খালেদা জিয়ার মুক্তির দাবিতে বিভাগীয় (দলের সাংগঠনিক বিভাগ) পর্যায়ে সমাবেশ করছে বিএনপি। ইতোমধ্যে চট্টগ্রাম ও ময়মনসিংহ বিভাগীয় সমাবেশ সম্পন্ন করেছে দলটি। এ গণসমাবেশে দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার জন্য আসন ফাঁকা রাখে বিএনপি। গণসমাবেশে সভাপতিত্ব করেন মহানগর বিএনপির আহ্বায়ক এসএম শফিকুল আলম মনা। সমাবেশে বক্তব্য রাখেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন, গয়েশ্বর চন্দ্র রায়, ড. আব্দুল মঈন খান, ভাইস চেয়ারম্যান আব্দুল আউয়াল মিন্টু, শামসুজ্জামান দুদু, নিতাই রায় চৌধুরী, তথ্যবিষয়ক সম্পাদক আজিজুল বারী হেলাল, সাংগঠনিক সম্পাদক (ভারপাপ্ত) অনিন্দ্য ইসলাম অমিত, যুবদলের সভাপতি সুলতান সালাউদ্দিন টুকু, ছাত্রদল সভাপতি কাজী রওনকুল ইসলাম শ্রাবণসহ বিএনপি ও অঙ্গ সংগঠনের নেতারা উপস্থিত ছিলেন।
এদিকে গণপরিবহন বন্ধ করে দেয়ায় সমাবেশের তিন দিন আগে থেকে বিভাগের কয়েকটি জেলার নেতাকর্মীরা খুলনা যেতে শুরু করেন। বিশেষ করে খুলনা থেকে দুরের জেলা কুষ্টিয়া, মেহেরপুর, মাগুরা, ঝিনাইদহ, চুয়াডাঙ্গা ও যশোরের কয়েকটি এলাকার বিএনপি নেতাকর্মীরা এ তালিকায় ছিলেন। সমাবেশের অংশগ্রহণকারীদের একটা বড় অংশ শুক্রবারের মধ্যে খুলনায় উপস্থিত নিশ্চিত করে বিএনপি। দূরের জেলা থেকে খুলনায় যাওয়া এসব নেতাকর্মীরা হোটেল-রেস্টুরেন্ট বন্ধের আশঙ্কায় শুকনো খাবার ও পানি সঙ্গে নিয়ে সমাবেশে যোগ দেন। পরিকল্পনা অনুযায়ী খুলনার আশপাশের জেলা বিশেষ করে নড়াইল, সাতক্ষীরা, বাগেরহাট ও যশোরের একাংশের নেতাকর্মীরা শুক্রবার রাত ও শনিবার সকালের মধ্যে সমাবেশে স্থলে পৌঁছান।
জানা গেছে, গণপরিবহন ও লঞ্চও বন্ধ করে দেয়ায় নেতাকর্মীরা নসিমন, করিমন (ব্যাটারিচালিত ভ্যান) নিয়ে বিভিন্ন বাইপাস রুটে খুলনামুখী হয়। শুক্রবার থেকে বিভিন্ন রুটে আসা বিএনপি নেতাকর্মীদের পথরুদ্ধ করছে আওয়ামী লীগ ও তার অঙ্গ সংগঠনের নেতাকর্মীরা। চালানো পুলিশ তল্লাশিও। গ্রেপ্তার করা হয় বিভিন্ন স্থানে।
এদিকে শনিবার সমাবেশে খুলনা ও আশাপাশের জেলা থেকে সমাবেশে যোগ দিতে চাওয়া নেতাকর্মীদের নানাভাবে হয়রানি করার অভিযোগ করেছে বিএনপি। দুপুর ১২টায় খুলনা রেলস্টেশনে গণসমাবেশে আসা নেতাকর্মীদের সঙ্গে পুলিশের পাল্টাপাল্টি ধাওয়া হয়। কয়েকজন কর্মীকে আটকের ঘটনায় বিএনপির নেতাকর্মীদের সঙ্গে পুলিশের এ ঘটনা ঘটে। খুলনা মহানগর বিএনপির আহ্বায়ক এসএম শফিকুল আলম মনা বলেন, পথে পথে নেতাকর্মীদের বাধা দেয়া হচ্ছে। তাদের আটক করা হচ্ছে। ট্রেনে যারা সমাবেশে এসেছেন, তাদের ওপর হামলা চালানো হয়েছে। গণসমাবেশে যোগ দিতে যাওয়ার পথে সাতক্ষীরার বাইপাস মোড়ে বিএনপি নেতাকর্মীদের বাধা দেয় পুলিশ। সকাল ৭টার দিকে বিএনপির নেতাকর্মী বহনকারী দুটি ট্রাককে ফিরিয়ে দেয়া হয়। এছাড়া বিভিন্ন স্থান থেকে নৌকায় করে সমাবেশে যোগ দিতে চাইলে স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরা বাধা দেয়। এভাবে পথে পথে নেতাকর্মীদের বাধা দেয়া হলে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। এদিকে সমাবেশ শেষে গন্তব্যে ফেরার সময় খুলনা নগরীর শিববাড়ী মোড়সহ বিভিন্ন স্থানে আওয়ামী লীগ কর্মীরা কয়েকটি স্থানে হামলা চালায় বলে দাবি করেছে বিএনপি।
ভোরের আকাশ/আসা