এম বদি-উজ-জামান: বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায়ের বিরুদ্ধে করা জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের অভিযোগের মামলা দ্রুত নিষ্পত্তির জন্য নিন্ম আদালতকে নির্দেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট। গত ৩ নভেম্বর এ নির্দেশ দেয়া হয়েছে। এর ঠিক দুদিন আগে গত ১ নভেম্বর দলটির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান ও তার স্ত্রী জোবায়দা রহমানের বিরুদ্ধে নিন্ম আদালত থেকে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করা হয়েছে। এ ছাড়া সম্প্রতি বিএনপির স্থায়ী কমিটির দুই সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন ও মির্জা আব্বাস, কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির রংপুর বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদক সাবেক উপমন্ত্রী অধ্যক্ষ আসাদুল হাবিব দুলুর বিরুদ্ধে দুদকের মামলা সচল করার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।
দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম রাজনৈতিক দল বিএনপি যখন রাজপথ সরগরম করছে, ক্ষমতাসীন সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন জোরদার করছে, ঠিক সেই মুহূর্তে বিএনপির একের পর এক নেতার বিরুদ্ধে মামলা সচলের আদেশ আসছে। বিএনপি নেতাদের বিরুদ্ধে করা মামলা বছরের পর বছর পড়ে থাকায় সেগুলো সচল করতে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) উদ্যোগের প্রেক্ষাপটেই আদালত থেকে আদেশ আসছে। রাজনৈতিক কর্মসূচি জোরদারের সময় দুদকের এই উদ্যোগের প্রেক্ষাপটেই বিএনপির পক্ষ থেকে প্রশ্ন তোলা হচ্ছে। তবে বিএনপির বক্তব্যকে অবান্তর ও রাজনৈতিক বলছেন দুদকের আইনজীবী।
বিএনপি সূত্রে জানা যায়, ২০০৯ থেকে ২০২২ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত মোট মামলার সংখ্যা ১ লাখ ১১ হাজার ৭৪টি। মোট আসামি ৩৯ লাখ ৭৫ হাজার ৫১ জন।
দুদকের আইনজীবী অ্যাডভোকেট খুরশীদ আলম খান ভোরের আকাশকে বলেন, বিএনপিকে রাজনৈতিকভাবে টার্গেট করে মামলা সচলের কোনো বিষয় নেই। দীর্ঘদিন ধরে পড়ে থাকা কিছু রিট মামলা এবং কিছু লিভ টু আপিল আবেদনের ওপর শুনানির উদ্যোগ নিয়েছি। ১০ বছর ধরে তাদের রিট পিটিশন পড়ে আছে, আড়াই বছর ধরে লিভ টু আপিল পড়ে আছে। যারা রিট করেছেন, লিভ টু আপিল করেছেন, তারা শুনানির কোনো উদ্যোগ নিচ্ছিলেন না। এ কারণেই দুদক নিজেই এখন এসব মামলা শুনানির উদ্যোগ নিচ্ছে। তিনি বলেন, দুর্নীতির মামলাগুলো ত্বরিত নিষ্পত্তি চায় দুদক। এ কারণে আমরা শুনানির উদ্যোগ নিয়েছি। সবকিছু হচ্ছে আইনি প্রক্রিয়ায়। দুর্নীতির অভিযোগ ওঠা ব্যক্তিদের রাজনৈতিক পরিচয় দেখা হয় না।
এ বিষয়ে বিএনপিপন্থি আইনজীবীদের সংগঠন জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফেরামের কেন্দ্রীয় মহাসচিব ব্যারিস্টার কায়সার কামাল ভোরের আকাশকে বলেন, গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার, বেগম খালেদা জিয়ার মুক্তি ও সুষ্ঠু নির্বাচনের দাবিতে বিএনপির আন্দোলনে যখন মানুষের ঢল নামছে, ঠিক তখন সরকার বিএনপি নেতাদের বিরুদ্ধে পুরোনো মামলা সচল করছে। নতুন নতুন মামলা দায়ের করছে। বিএনপি নেতৃত্বাধীন গণমানুষের আন্দোলনকে দমন করতেই সরকার এ পথ বেছে নিয়েছে। তিনি বলেন, সরকার এ ক্ষেত্রে দুদককে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছে।
গয়েশ্বরের বিরুদ্ধে মামলা : গয়েশ্বর চন্দ্র রায়ের বিরুদ্ধে জ্ঞাত আয়বহির্ভূতভাবে দুই কোটি ৮৬ লাখ টাকার সম্পদ অর্জনের অভিযোগে ২০০৯ সালের ৫ জানুয়ারি রাজধানীর রমনা থানায় মামলা করে দুদক। এ মামলায় একই বছরের ৫ জুলাই আদালতে অভিযোগপত্র দেয় দুদক। পরে মামলা বাতিল চেয়ে হাইকোর্টে আবেদন করেন গয়েশ্বর চন্দ্র রায়। হাইকোর্ট ২০১০ সালের ৬ আগস্ট মামলাটির কার্যক্রমের ওপর স্থগিতাদেশ দেন। একই সঙ্গে মামলা বতিল প্রশ্নে রুল জারি করেন। প্রায় এক যুগ মামলাটির বিচারকাজ বন্ধ থাকার পর সম্প্রতি এই রুল শুনানির জন্য উদ্যোগ নেয় রাষ্ট্রপক্ষ। এ অবস্থায় শুনানি শেষে গত ৩ নভেম্বর রুল খারিজ করে মামলা দ্রুত নিষ্পত্তির জন্য নিন্ম আদালতকে নির্দেশ দেন হাইকোর্ট।
তারেক ও তার স্ত্রীর বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা : জ্ঞাত আয়বহির্ভূতভাবে ৪ কোটি ৮১ লাখ ৫৩ হাজার ৫৬১ টাকার সম্পদ অর্জন ও সম্পদের তথ্য গোপন করার অভিযোগের মামলায় ঢাকার মহানগর সিনিয়র বিশেষ জজ আদালত থেকে গত ১ নভেম্বর তারেক রহমান ও তার সহধর্মিণী জোবায়দা রহমানের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করা হয়েছে। এর আগে গত ২৬ জুন হাইকোর্ট বেঞ্চ তারেক রহমানকে পলাতক ঘোষণা করেন। আদেশে এ মামলার ওপর দেয়া স্থগিতাদেশ প্রত্যাহার করে সংশ্লিষ্ট নিন্ম আদালতকে যত দ্রুত সম্ভব বিচার কার্যক্রম সম্পন্ন করার নির্দেশ দেয়া হয়। এ ছাড়া ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিমকে রায়ের কপি পাওয়ার ১০ দিনের মধ্যে মামলার রেকর্ড ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালতে পাঠাতে বলা হয়। এরও আগে গত ১৩ এপ্রিল আপিল বিভাগ জোবায়দা রহমানকে পলাতক হিসেবে ঘোষণা দেন।
জ্ঞাত আয়বহির্ভূতভাবে ৪ কোটি ৮১ লাখ ৫৩ হাজার ৫৬১ টাকার সম্পদ অর্জন ও সম্পদের তথ্য গোপন করার অভিযোগে তারেক রহমান, তার স্ত্রী জোবায়দা রহমান ও শাশুড়ি সৈয়দা ইকবাল মান্দ বানুর বিরুদ্ধে ২০০৭ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর রাজধানীর কাফরুল থানায় মামলা করে দুদক। মামলায় তারেক রহমানকে অবৈধভাবে সম্পদ অর্জন ও সম্পদের তথ্য গোপনে সহযোগিতার অভিযোগ আনা হয় জোবায়দা রহমান ও সৈয়দা ইকবাল মান্দ বানুর বিরুদ্ধে। এ মামলায় ২০০৮ সালের ৩১ মার্চ দুদক অভিযোগপত্র দেয়। এরপর জরুরি ক্ষমতা অধ্যাদেশ ও মামলার বৈধতা চালেঞ্জ করে হাইকোর্টে পৃথক রিট আবেদন করেন তারেক রহমান ও তার স্ত্রী। এ আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে হাইকোর্ট ২০০৮ সালেই রুল জারি করেন। একই সঙ্গে মামলার কার্যক্রম স্থগিত করেন। এই রুল শুনানির উদ্যোগ নেয় দুদক।
খন্দকার মোশাররফের মামলা : জ্ঞাত আয়বহির্ভূতভাবে ১২ কোটি টাকার সম্পদ অর্জন এবং দুদকের কাছে তিন কোটি টাকার সম্পদের তথ্য গোপনের অভিযোগে ২০০৮ সালের ১০ জানুয়ারি খন্দকার মোশাররফ হোসেনের বিরুদ্ধে রমনা মডেল থানায় মামলা করে দুদক। ওই বছরের ১৭ সেপ্টেম্বর অভিযোগপত্র দাখিল করা হয়। এ মামলা বাতিল চেয়ে খন্দকার মোশাররফ হাইকোর্টে আবেদন করলে আদালত ২০১২ সালের ১৬ অক্টোবর তা খারিজ করে দেন। এ রায়ের বিরুদ্ধে খন্দকার মোশাররফ আপিল বিভাগে আবেদন করেন। আপিল বিভাগ ২০১৪ সালের ২১ মে তার আবেদন খারিজ করে দেন। এরপর ওই আদেশ পুনর্বিবেচনার জন্য রিভিউ আবেদন করেন। ২০১৭ সালের ১৭ জুলাই এ আবেদন খারিজ করেন আপিল বিভাগ। এরপর নিন্ম আদালতে তার বিরুদ্ধে বিচারিক কার্যক্রম শুরু হয়। এ অবস্থায় খন্দকার মোশাররফ মামলার পুনর্তদন্ত চেয়ে নিন্ম আদালতে আবেদন করেন। এ আবেদনও ২০১৮ সালে আপিল বিভাগ ও হাইকোর্টে খারিজ হয়। এরপর নিন্ম আদালতে সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু হয়। এ অবস্থায় একজন সাক্ষীকে পুনরায় জেরা করার অনুমতি চেয়ে নিন্ম আদালতে আবেদন করেন। ওই আবেদন খারিজ হলে হাইকোর্টে আবেদন জানান ড. মোশাররফ হোসেন। হাইকোর্ট তার আবেদন গ্রহণ করে সাক্ষীকে পুনরায় জেরা করার অনুমতি দেন। হাইকোর্টের এ আদেশের বিরুদ্ধে আপিল বিভাগে আবেদন করে দুদক। গত ১৯ এপ্রিল হাইকোর্ট বিভাগের সিদ্ধান্ত বাতিল করেন আপিল বিভাগ। এরপর নিন্ম আদালতে এ মামলায় আবার সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু হয়।
এ ছাড়া খন্দকার মোশাররফ হোসেন ও তার স্ত্রী বিলকিস আক্তারের বিরুদ্ধে নয় কোটি ৫৩ লাখ ৯৫ হাজার ৩৮১ টাকা পাচারের অভিযোগে ২০১৪ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি দুদক বাদী হয়ে রমনা মডেল থানায় মামলা করে। একই বছরের ১৪ আগস্ট অভিযোগপত্র দাখিল করা হয়। এ মামলায় নি¤œ আদালতে সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু হলে গত বছর ২ ডিসেম্বর বিচারিক আদালতে আবেদন করেন খন্দকার মোশাররফ। এই আবেদনও আপিল বিভাগ, হাইকোর্ট ও নিন্ম আদালতে খারিজ হয়েছে।
মির্জা আব্বাসের আবেদন খারিজ : জ্ঞাত আয়বহির্ভূতভাবে ৫ কোটি ৯৭ লাখ ১৩ হাজার ২৩৪ টাকার সম্পদ অর্জন এবং দুদকের কাছে ৩৩ লাখ ৪৮ হাজার ৫৮১ টাকার সম্পদের তথ্য গোপনের অভিযোগে ২০০৭ সালের ১৬ আগস্ট রমনা থানায় মামলা করা হয়। এ মামলায় তদন্ত শেষে ২০০৮ সালের ১৪ মে অভিযোগপত্র দাখিল করে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। ওই বছরের ১৬ জুন সংসদ ভবন সংলগ্ন এমপি হোস্টেলে স্থাপিত বিশেষ জজ আদালতে মির্জা আব্বাসের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠনের মাধ্যমে বিচার শুরু হয়। মামলাটি বর্তমানে ঢাকার বিশেষ জজ আদালত-৬-এ সাক্ষ্যগ্রহণ পর্যায়ে রয়েছে। এই মামলা বাতিল চেয়ে হাইকোর্টে আবেদন করেন মির্জা আব্বাস। ২০১৮ সালের ১১ নভেম্বর হাইকোর্ট এবং গত ২৫ অক্টোবর আপিল বিভাগ মির্জা আব্বাসের আবেদন খারিজ করে দেন।
দুলুর দুর্নীতি মামলা শুনানির উদ্যোগ : জ্ঞাত আয়বহির্ভূতভাবে এক কোটি ৬১ লাখ টাকা সম্পদ অর্জনের জন্য ২০০৯ সালের ২১ জানুয়ারি লালমনিরহাট সদর থানায় অধ্যক্ষ আসাদুল হাবিব দুলুর বিরুদ্ধে মামলা করে দুদক। এ মামলায় ওই বছরই অভিযোগপত্র দেয় দুদক। এরপর মামলাটি বাতিলের আবেদন জানালে হাইকোর্ট ২০১০ সালে বিচারিক কার্যক্রম স্থগিত করেন। একই সঙ্গে রুল জারি করেন। সম্প্রতি এই রুল শুনানির উদ্যোগ নিয়েছে দুদক।
ভোরের আকাশ/আসা