নিখিল মানখিন: দেশের ডেঙ্গু পরিস্থিতির ধারাবাহিক অবনতি অব্যাহত রয়েছে। মোট মৃত্যুর বিবেচনায় ২০১৯ সালের ভয়াবহ ডেঙ্গু পরিস্থিতিও পেছনে পড়ে গেছে। জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, চিকিৎসাসেবা প্রদানে হিমশিম খাচ্ছে হাসপাতালগুলো। কিন্তু নানা কৌশলে এমন পরিস্থিতির দায় এড়িয়ে যাওয়ার ঘটনাও ঘটছে। মশা মারা স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের কাজ নয় বলে জানিয়ে দিয়েছেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক। আর শুধু মেয়র ও কাউন্সিলরদের একার পক্ষে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ সম্ভব নয় বলে অক্ষমতা প্রকাশ করেছেন ডিএনসিসি মেয়র আতিকুল ইসলাম। এমতাবস্থায় জনসচেতনতাই প্রধান রক্ষাকবচ বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।
গত ১৫ অক্টোবর রাজধানীর একটি অনুষ্ঠানে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে অক্ষমতার কথা জানিয়ে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) মেয়র আতিকুল ইসলাম বলেছেন, শুধু মেয়র ও কাউন্সিলরদের একার পক্ষে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ সম্ভব নয়।
মেয়র বলেন, সমাজের সর্বস্তরের মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণে সামাজিক আন্দোলনের মাধ্যমে এডিস মশা এবং ডেঙ্গুকে মোকাবিলা করতে হবে। এ জন্য আলেম সমাজের ভূমিকাও অনেক। নিজেদের বাসাবাড়ি, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কিংবা অফিস-আদালত কোথাও যাতে তিন দিনের বেশি পানি জমে না থাকে, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।
সম্প্রতি ঢাকার ধানমণ্ডিতে শেখ রাসেল গ্যাস্ট্রোলিভার হাসপাতাল ও ইনস্টিটিউট মিলনায়তনে শেখ রাসেলের জন্মদিন উপলক্ষে আলোচনায় স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক বলেন, ডেঙ্গু রোগীদের ব্যবস্থাপনায় কাজ চালিয়ে গেলেও এই রোগের বিস্তার ঠেকানোর ক্ষেত্রে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের কোনো হাত নেই। তিনি আরও বলেন, ডেঙ্গু পরিস্থিতি বৃদ্ধির জন্য স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের কোনো হাত থাকে না। স্বাস্থ্য খাত চিকিৎসা দিতে পারে, কিন্তু মশা মারার কাজ স্বাস্থ্য খাতের নয়।
ফ্রি টেস্টের নির্দেশনা স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের : ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব বাড়ায় দেশের সব সরকারি হাসপাতালে বিনামূল্যে এই ভাইরাসের সংক্রমণ পরীক্ষার নির্দেশ দিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক আবুল বাসার মোহাম্মদ খুরশীদ আলম সাংবাদিকদের বলেন, ডেঙ্গুর সুচিকিৎসা নিশ্চিতে সারা দেশের সরকারি হাসপাতালগুলোতে বিনামূল্যে ডেঙ্গু পরীক্ষার নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। বিভিন্ন হাসপাতালে এই নির্দেশনা বাস্তবায়ন হয়েছে। ডেঙ্গু পরিস্থিতি কবে নিয়ন্ত্রণে আসবে, তা ভালো বলতে পারবেন কীটতত্ত্ববিদরা। তবে চিকিৎসার দিক থেকে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কোনো ঘাটতি নেই। উপজেলা-জেলা পর্যায়ে চিকিৎসার ব্যবস্থা রয়েছে। ডেঙ্গু পরীক্ষার ফল সরকারি হাসপাতালে বিনামূল্যে দেয়া হচ্ছে। প্রাথমিক পর্যায়ে ডেঙ্গু শনাক্ত না হওয়ায় এবং হাসপাতালে দেরিতে আসায় ডেঙ্গুতে মৃত্যুঝুঁকি বাড়ছে বলে মনে করেন এই চিকিৎসক। উদ্বেগজনক পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে স্থানীয় সরকার ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তর একসঙ্গে কাজ করছে বলে জানান মহাপরিচালক।
মামলার ভয় দেখিয়েও কাজ হচ্ছে না : কারও বাড়িতে এডিস মশার লার্ভা পাওয়া গেলে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া হবে বলে জানিয়েছেন ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মো. সেলিম রেজা। তিনি সাংবাদিকদের বলেন, বর্তমানে সারা দেশেই ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে অক্টোবরেও থেমে থেমে বৃষ্টি হচ্ছে, কিছুক্ষণ পরেই আবার রোদ হচ্ছে। এসব কারণেও ডেঙ্গু রোগের বাহক এডিস মশা বাড়ছে। আমরা যে কেউ ডেঙ্গু আক্রান্ত হতে পারি। সবাইকে এডিস মশা নিধনে সচেতন হতে হবে। সিটি করপোরেশন নিয়মিত মশা নিধনে কাজ করছে। নগরবাসীকেও দায়িত্ব নিতে হবে। কারও বাড়িতে এডিসের লার্ভা পেলে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া হবে।
তিনি বলেন, ডিএনসিসি ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে আন্তরিকভাবে কাজ করে যাচ্ছে। জনগণের সহযোগিতা পেলে ডেঙ্গু সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব। মূলত বাসাবাড়িতেই এডিস মশার জন্ম হয়। নিজেদের বাড়ির ফ্রিজ, এসি, ফুলের টব, অব্যবহৃত টায়ার, ডাবের খোসা, চিপসের খোলা প্যাকেট, বিভিন্ন ধরনের খোলাপাত্র, ছাদ কিংবা অন্য কোথাও যেন পানি জমে না থাকে, সেদিকে সতর্ক দৃষ্টি রাখতে হবে। কিন্তু জরিমানা ও মামলা দিয়েও কাজ হচ্ছে না বলে আক্ষেপ প্রকাশ করেন মো. সেলিম রেজা।
জনসচেতনতাই রক্ষাকবচ : বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিসিন অনুষদের সাবেক ডিন, প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত চিকিৎসক অধ্যাপক ডা. এবিএম আব্দুল্লাহ ভোরের আকাশকে বলেন, ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে কাজ করছে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন। জরিমানা ও মামলা দিয়েও জনসচেতনতা বাড়ানো যাচ্ছে না। এডিস মশা প্রজননের অনুকূল পরিবেশ পাওয়া যাচ্ছে বাসাবাড়ি ও নির্মাণাধীন স্থাপনাগুলোতে। এক্ষেত্রে নগরবাসীকেই সচেতন হতে হবে। নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচি এবং নগরবাসীর সচেতনতার সমন্বয় ঘটলেই ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব কমানো সম্ভব বলে মনে করেন ডেঙ্গু রোগ বিশেষজ্ঞ ডা. এবিএম আব্দুল্লাহ।
সচেতনতার ওপর দিয়ে স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদের (স্বাচিপ) মহাসচিব অধ্যাপক ডা. এম এ আজিজ ভোরের আকাশকে বলেন, রাজধানীতে ডেঙ্গু পরিস্থিতির অবনতি ঘটেছে- এটাই বাস্তবতা। দোষারোপের জায়গা থেকে বেরিয়ে এসে নিজ নিজ অবস্থান থেকে কাজ করতে হবে। তিনি বলেন, প্রতিটি বাসাবাড়িতে প্রবেশ করে এডিস মশার প্রজননস্থল খুঁজে বের করা খুবই কঠিন কাজ। এক্ষেত্রে বাসাবাড়ির লোকজন সচেতন ভূমিকা রাখতে পারেন।
ভোরের আকাশ/আসা