logo
আপডেট : ৯ নভেম্বর, ২০২২ ১৮:১২
ঘরে-বাইরে নজর বাড়িয়েছে আওয়ামী লীগ
নিখিল মানখিন

ঘরে-বাইরে নজর বাড়িয়েছে আওয়ামী লীগ

জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে ঘরে-বাইরে নজর বাড়িয়েছে আওয়ামী লীগ। দল গোছানোর পাশাপাশি বিশ্বের প্রভাবশালী দেশগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ ও আলোচনার মাত্রা বাড়িয়েছে কয়েকগুণ। এ লক্ষ্যে দলীয় কোন্দল সৃষ্টির কারণ উদ্ঘাটন ও নিরসন, দলের বিভিন্ন পর্যায়ের কমিটিগুলোতে অনুপ্রবেশকারী ঠেকানো এবং শরিক দলগুলো গোছানোর কার্যক্রম হাতে নিয়েছে দলটি। পাশাপাশি দেশের অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপির প্রতিটি পদক্ষেপের চুলচেরা বিশ্লেষণ করা হচ্ছে বলে আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের নেতারা জানিয়েছেন।

 

রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, এক যুগের বেশি সময় ধরে একটানা ক্ষমতায় থাকার কারণে আওয়ামী লীগ দল ও সরকার যেন একাকার হয়ে গেছে। বিভিন্ন সময় দলীয় বৈশিষ্ট্যের ওপর সরকারি ক্ষমতার প্রভাব পরিলক্ষিত হওয়ার অভিযোগও উঠেছে। শুধু তাই নয়, আওয়ামী লীগ এবং সহযোগী ও ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠনগুলোর বিভিন্ন পর্যায়ের কমিটিতে নিজেরা সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের পদ বাগিয়ে নিয়ে দলের মধ্যে কোন্দল সৃষ্টি করার অভিযোগ রয়েছে অনেক মন্ত্রী-এমপির বিরুদ্ধে। এভাবে সরকার ও দল- দুটির কর্তৃত্বই একই ব্যক্তির হাতে চলে যাওয়ায় অনেক ত্যাগী জ্যেষ্ঠ নেতৃত্বের অপমৃত্যু ঘটছে। আর উপজেলা নির্বাচনে দলীয় প্রতীক ব্যবহার এবং ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে প্রার্থী মনোনয়নের ব্যবস্থা থাকায় অনেক যোগ্য ও মনোনয়নবঞ্চিত নেতাকর্মীর মনে জন্ম দিয়েছে তীব্র ক্ষোভ। এর মধ্যে দলীয় বিভিন্ন পর্যায়ে চলমান কমিটি গঠনের কারণেও পদবঞ্চিতদের মনে অসন্তোষ দেখা দিয়েছে। এভাবে নানা কারণে তৃণমূল পর্যায়ে দলীয় কোন্দলের তীব্রতা রয়ে গেছে।

 

আওয়ামী লীগ এবং সহযোগী ও ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠনগুলোর উপজেলা ও ইউনিয়ন কমিটিতে অন্তর্ভুক্ত করার আগে প্রার্থীদের জীবনবৃত্তান্ত ও তা যাচাই-বাছাই করার চর্চা না থাকার অভিযোগ দীর্ঘদিনের। এলাকা নিয়ন্ত্রণকারী কতিপয় দলীয় নেতা (সংসদ সদস্য ও উপজেলা আওয়ামী লীগ নেতা) নিজেরা গোপন আলোচনায় মুখে মুখে নাম উচ্চারণ ও তালিকা করে ওপরের সংশ্লিষ্ট দপ্তরে পাঠিয়ে দেয়া হয়। ফলে প্রার্থীদের সঠিক পরিচয় জানানোর তেমন সুুযোগ থাকে না।

 

এ বিষয়ে আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের নেতারা ভোরের আকাশকে বলেন, ঘরে-বাইরে নজর বাড়িয়েছে আওয়ামী লীগ। দলীয় কোন্দল নিরসনের কাজ অব্যাহত রয়েছে। বড় দলে কোন্দল থাকবেই। তবে ক্ষতিকর পর্যায়ে যেতে দেয়া যাবে না। পর্যায়ক্রমে দল এবং তার সহযোগী ও ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠনগুলোর সম্মেলন ও কাউন্সিল অব্যাহত রয়েছে। আওয়ামী লীগে যোগ্য নেতার অভাব নেই। কমিটিতে সবাইকে অন্তর্ভুক্ত করার সুযোগও থাকে না। যারা মূল দলের কমিটিতে সুযোগ পাবেন না, তাদের সহযোগী ও ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠনগুলোর সামনের সারির পদ দেয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে। দলীয় সূত্র আরো জানায়, দলে অনুপ্রবেশকারীর বিষয়টি অনেক আগেই নজরে এসেছে। ইউনিয়ন কমিটিতে অনুপ্রবেশকারী রুখে দেয়ার দায়িত্ব পড়েছে উপজেলা কমিটির নেতাদের ওপর। আর উপজেলা কমিটির প্রার্থীদের বিষয়টি দেখবেন জেলা ও বিভাগীয় পর্যায়ে দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতারা। নিজ নিজ পর্যায় থেকে সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করলেই অনুপ্রবেশের সুযোগ থাকবে না বলে মনে করেন আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের নেতারা।

 

ঘরের পাশাপাশি বিরোধী দল এবং বিশ্বের প্রভাবশালী দেশগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ ও আলোচনার মাত্রা কয়েকগুণ বাড়িয়েছে আওয়ামী লীগ। স্বাধীনতার সপক্ষের রাজনৈতিক দলগুলোকে দলে টানার চেষ্টা করছে ক্ষমতাসীদের ১৪ দলীয় জোট।

 

২০০৮ সালের জাতীয় নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগ স্বাধীনতার সপক্ষের দল ও বামপন্থি দলের সমন্বয়ে একটি ১৪ দলীয় জোট গঠন করে। ১৪ দলীয় জোট গঠন করে সরকার ক্ষমতায় এলেও সরকারে ছোট দলগুলোকে সুযোগ কম দেয়ায় ২০১৮ সালের নির্বাচনের পর আওয়ামী লীগের সঙ্গে জোটের শরিক দলগুলোর সম্পর্কের অবনতি হয়। এমনকি সরকারের বিপক্ষে তারা প্রকাশ্যে কথা বলে। সম্প্রতি ১৪ দলীয় জোটের বড় আকারের মিলন হয়েছে গত ৩০ অক্টোবর। ওই দিন রাজধানীর কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (জাসদ) প্রতিষ্ঠার ৫০ বছর পূর্তি উপলক্ষে আয়োজিত সমাবেশে অংশ নেয়া আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে ১৪ দলের শরিক দলগুলোর অনেক শীর্ষ নেতা ঐক্যবদ্ধ থাকার প্রতিশ্রুতি দেন। সমাবেশে প্রধান অতিথির বক্তব্যে শরিক দলগুলোর নেতাদের উদ্দেশ করে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেন, আপনারা ঠিক থাকুন। ভুলত্রুটি রাজনীতিতে আপনাদেরও আছে। আমরা ভ্রান্ত, সে কথাও আমি বলব না। কিন্তু আজ বাঙালি জাতির অস্তিত্বের প্রশ্ন। যারা বাংলার মানুষের ভাগ্য নিয়ে ছিনিমিনি খেলতে চায়, তারা আবারো ক্ষমতায় আসবে ?

 

মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের শক্তির সবাইকে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বৃহত্তর ঐক্য গড়ে তোলার আহ্বান জানিয়ে ওবায়দুল কাদের বলেন, আমরা যদি ঐক্যবদ্ধ থাকি, এ দেশে আমাদের কেউ হারাতে পারবে না। ঐক্যবদ্ধ থাকলে আমরাই বিজয়ের বন্দরে পৌঁছে যাব। এ সময় ১৪ দল ঐক্যবদ্ধ আছে বলেও দাবি করেন ওবায়দুল কাদের।

 

জাতীয় সংসদের প্রধান বিরোধী দল জাতীয় পার্টি ২০০৮, ২০১৪ ও ২০১৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নির্বাচনী অংশীদার ছিল। তবে এখন আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টির মধ্যে সম্পর্কে টানাপোড়েন প্রকাশ্যে চলে আসছে। কারণ আওয়ামী লীগ মনে করছে, জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জিএম কাদের বিএনপির সঙ্গে ভেতরে ভেতরে সরকার পতনের আন্দোলনে যুক্ত হয়ে ইন্দন দিচ্ছে। ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীরা এখন জাতীয় পার্টিসহ ১৪ দলীয় জোটের সদস্য দলগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নে কাজ করছে বলে আওয়ামী লীগের দলীয় সূত্রে জানা গেছে।

 

সম্প্রতি ১৪ দলের প্রধান সমন্বয়ক ও মুখপাত্র আমীর হোসেন আমু সাংবাদিকদের বলেন, বিএনপি যদি সরকার পতনের আন্দোলন করে করুক, আমরাও ১৪ দল নেতাকর্মীরা মাঠে আছি। এদিকে, বিএনপিকে রাজপথে মোকাবিলা করার প্রকাশ্য ঘোষণা দিয়েছে আওয়ামী লীগ। চুলচেরা বিশ্লেষণ করা হচ্ছে বিএনপির প্রতিটি পদক্ষেপের।

 

গত ৫ অক্টোবর কুমিল্লায় দলীয় অনুষ্ঠানে বিএনপিকে উদ্দেশ করে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেন, আওয়ামী লীগও বসে থাকবে না। আপনাদের সঙ্গে খেলা হবে, মোকাবিলা হবে, ফাইনাল খেলা হবে ডিসেম্বরে, রাজপথে। তিনি বলেন, খেলা হবে। খেলা হবে আন্দোলনে, নির্বাচনে, ভোট চুরির বিরুদ্ধে, ভোট জালিয়াতির বিরুদ্ধে, দুর্নীতির বিরুদ্ধে। যারা ১৭ কোটি মানুষের ভাগ্য নিয়ে ছিনিমিনি খেলে, ভুয়া ভোটার বানানোর বিরুদ্ধে খেলা হবে বলে জানান ওবায়দুল কাদের।

 

দল গোছানোর পাশাপাশি বিশ্বের প্রভাবশালী দেশগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ ও আলোচনার মাত্রা বাড়িয়েছে কয়েকগুণ। সাম্প্রতিক সময়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলো বাংলাদেশের ওপর যে চাপ প্রয়োগ করছে, সেই চাপ নিরসনের জন্য নানা উদ্যোগ বাস্তবায়ন করে যাচ্ছে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকার। চলতি বছরের সেপ্টেম্বরে ভারত সফর করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এর আগে আওয়ামী লীগের কয়েকজন শীর্ষ পর্যায়ের নেতা ভারত ও রাশিয়া সফর করেছেন। জেনেভায় জাতিসংঘ মিশনের স্থায়ী প্রতিনিধি, অস্ট্রেলিয়ায় হাইকমিশনার ও ডেনমার্কে রাষ্ট্রদূত পদে পরিবর্তন আনা হয়েছে। সরিয়ে দেয়া হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূতকে। অক্টোবরে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ৭৭তম অধিবেশনে অংশগ্রহণ করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ওই সময় তিনি দেশের বাইরে ১৮ দিন ছিলেন। জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে বাংলায় ভাষণ দেন প্রধানমন্ত্রী। জাতিসংঘের হাই লেভেল মিটিং চলাকালে ৮টি উচ্চপর্যায়ের সভা ও সাইড ইভেন্ট ছাড়াও কয়েকটি রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধানের সঙ্গে ১২টি দ্বিপক্ষীয় বৈঠক এবং যুক্তরাষ্ট্রের ব্যবসায়ীদের সঙ্গে বৈঠকে অংশ নেন। জাতিসংঘে বাংলাদেশের স্থায়ী মিশনের বঙ্গবন্ধু হলরুমে সংবাদ সম্মেলনে সাধারণ অধিবেশনে অংশগ্রহণ এবং সফলতার কথা তুলে ধরেন। এভাবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বর্তমান সরকারের আমলে দেশের প্রশংসনীয় উন্নয়নচিত্র নানাভাবে আন্তর্জাতিক নেতাদের সামনে তুলে ধরেন।

 

ভোরের আকাশ/আসা