logo
আপডেট : ৯ নভেম্বর, ২০২২ ১৯:১০
হাইপোক্সিমিয়া জনিত অকালমৃত্যু রোধে মেডিকেল অক্সিজেনের প্রাপ্যতা নিশ্চিত গুরুত্বপূর্ণ
নিউমোনিয়া নিয়ে আসা শিশুর প্রায় ৪২ শতাংশই ভোগে হাইপোক্সিমিয়ায়
নিজস্ব প্রতিবেদক

নিউমোনিয়া নিয়ে আসা শিশুর প্রায় ৪২ শতাংশই ভোগে হাইপোক্সিমিয়ায়

সারা বিশ্বে প্রতি বছর প্রায় ৭ কোটি ৩০ লক্ষ মানুষ হাইপোক্সিমিয়ায় আক্রান্ত হয়, যার মধ্যে ৩ কোটি ২ লক্ষই শিশু। বাংলাদেশের স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রের অবকাঠামো অনুযায়ী, মাধ্যমিক স্তরের স্বাস্থ্য সেবাকেন্দ্রে নিউমোনিয়া নিয়ে আসা শিশুর প্রায় ৪২ শতাংশই হাইপোক্সিমিয়ায় ভোগে।

 

শনিবার মেডিকেল অক্সিজেন নিরাপত্তা বিষয়ে গবেষণালব্ধ ফলাফল ভিত্তিক মতবিনিময় অধিবেশনে বক্তারা এ তথ্য জানান।

 

আগামী শনিবার, ১২ নভেম্বর বিশ্ব নিউমোনিয়া দিবস উদযাপিত হবে। দিবসটি সামনে রেখে বুধবার আইসিডিডিআর,বি এবং ডেটা ফর ইমপ্যাক্ট ((D4I) যৌথভাবে আইসিডিডিআর,বি-র মহাখালী ক্যাম্পাসে সাংবাদিকদের সাথে এ অধিবেশনের আয়োজন করে।

 

এসময় বাংলাদেশের সামগ্রিক অক্সিজেন পরিস্থিতির ওপর আলোকপাত করা হয়। পাশাপাশি মেডিক্যাল অক্সিজেন নিরাপত্তাসহ বাংলাদেশের সামগ্রিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করতে স্বল্প মুল্যে উদ্ভাবনের উপরও গুরুত্ব আরোপ করা হয়।

 

বক্তারা জানান, আমাদের চারপাশের বাতাসে অক্সিজেনের পরিমান ২১ শতাংশ , এবং আমাদের শ্বাস প্রশ্বাসের জন্য বাতাসে মাত্র ১৯.৫ শতাংশ অক্সিজেনের প্রয়োজন পরে। কিন্তু যাদের রক্তে অক্সিজেনের স্বল্পতা রয়েছে তাদের জন্য এটি প্রযোজ্য নয়, এই স্বাস্থ্য সমস্যাটির মেডিকেলীয় নাম হাইপোক্সিমিয়া।

 

আইসিডিডিআর,বি এর এসোসিয়েট সায়েন্টিস্ট ড. আহমেদ এহসানুর রহমান বলেন, হাইপোক্সিমিয়ায় আক্রান্ত যে কোন রোগীর জন্য চিকিৎসা হিসাবে অক্সিজেন থেরাপি প্রয়োজন। হাইপোক্সিমিয়া বিভিন্ন কারণে হতে পারে, মূলত নিউমোনিয়া, ম্যালেরিয়া, সেপসিস, যক্ষ্মা, ক্রনিক অবস্ট্রাকটিভ পালমোনারি ডিজিজ বা সিওপিডি, হৃদরোগ এবং হাঁপানি ইত্যাদির কারণে যে শ্বাসকষ্ট হয় তা অন্যতম।

 

বাংলাদেশ হেলথ ফ্যাসালিটি সার্ভে ২০১৭ এর তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে এক চতুর্থাংশেরও কম স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রে কম্প্রেসেড গ্যাস সিস্টেম, বহনযোগ্য অক্সিজেন কন্সেন্ট্রেটর ও তরল অক্সিজেন সিস্টেম এই তিনটি অক্সিজেন উৎসের যেকোনো একটি বিদ্যমান। যার মধ্যে ১৩ শতাংশ স্বাস্থ্য সেবাকেন্দ্রে অক্সিজেন কনসেনট্রেটর বিদ্যমান ছিল, মাত্র ২১ শতাংশ স্বাস্থ্য সেবাকেন্দ্রে ফ্লো মিটারসহ অক্সিজেন ভর্তি সিলিন্ডার পাওয়া গিয়েছিল। মাত্র ৬ শতাংশ স্বাস্থ্য সেবাকেন্দ্রে অক্সিজেন সরবরাহ বা বিতরণের ব্যবস্থা এবং পালস অক্সিমিটার ছিল।

 

২০২০ সালের এপ্রিল-মে মাসে পরিচালিত আইসিডিডিআর,বি-র পরিচালিত আরেকটি গবেষণায় দেখা গেছে যে বাংলাদেশের ৬০টি জেলা হাসপাতালের মধ্যে ৭২ শতাংশ হাসপাতালে পালস অক্সিমেট্রি যন্ত্রটি রয়েছে এবং মাত্র ৭ শতাংশ ক্ষেত্রে আর্টারিয়াল ব্লাড গ্যাস এনালাইসিস (রক্তে অক্সিজেন, কার্বন-ডাই অক্সাইড এর পরিমান, অক্সিজেন এর ঘনত্ব, এসিড-ক্ষার এর ব্যালান্স ইত্যাদি পরিমাপ করবার পরীক্ষা) করার ব্যবস্থা রয়েছে।

 

অক্সিজেন নিরাপত্তা প্রদানের জন্য অক্সিজেনের অন্যান্য উৎসের ক্ষেত্রে, ১৮ শতাংশ হাসপাতালে অক্সিজেন কন্সেন্ট্রেটর যন্ত্র, ২ শতাংশ হাসপাতালে বাল্ক স্টোরেজ ট্যাঙ্কে তরল অক্সিজেন ছিল, এবং ৩ শতাংশ হাসপাতালে একটি অক্সিজেন প্ল্যান্ট ছিল।

 

সেন্ট্রাল ও সাব-সেন্ট্রাল পাইপিং শুধু ১৭ শতাংশ জেলা হাসপাতালে বিদ্যমান ছিল এবং ২০ শতাংশ জেলা হাসপাতালে পরিদর্শনের দিনে ফ্লো-স্প্লিটার উপস্থিত ছিল। এক-চতুর্থাংশ জেলা হাসপাতালে নন-ইনভেসিভ ভেন্টিলেশন সহ লো-ফ্লো অক্সিজেন থেরাপি দেওয়ার ব্যবস্থা ছিল, যেখানে মাত্র ৭ শতাংশ জেলা হাসপাতাল নন-ইনভেসিভ এবং ইনভেসিভ দু ধরণের ভেন্টিলেশনের সাথেই বেসিক অক্সিজেন থেরাপি প্রদান করতে পারে। তবে, কোভিড-১৯ মহামারীজনিত কারণে অক্সিজেনে অস্বাভাবিক চাহিদার ভিত্তিতে এবং সরকারের প্রয়োজনীয় কার্যক্রমের ফলে হাসপাতালগুলোর গুলোর হয়তো অনেক উন্নয়ন হয়েছে। অক্সিজেন প্ৰাপ্যতা নিশ্চিত করা খুব গুরুত্বপূর্ণ।

 

আলোচনায় আইসিডিডিআর,বি-র জ্যেষ্ঠ বিজ্ঞানী ড. মোহাম্মাদ যোবায়ের চিস্তি ইথিওপিয়ার হাসপাতালে হাইপোক্সিমিয়া চিকিৎস্য তার উদ্ভাবন বাবল সিপ্যাপ ট্রায়াল সম্পর্কে আপডেট প্রদান করেন। তিনি কেন্দ্রগুলোয় অক্সিজেন নিরাপত্তা নিশ্চিতের ওপর জোর দেন। তিনি বলেন, ‘শিশুরা তাদের শ্বাসকষ্টের কথা প্রকাশ করতে পারে না বড়দের মতো করে, তাদের অমানবিক কষ্টকে মানবিকতার সাথে গুরুত্ব দিতে হবে।’

 

২০২৪ সালে প্রকাশিত হতে যাওয়া মেডিকেল অক্সিজেন সিকিউরিটি সংক্রান্ত বিশ্বের অন্যতম প্রভাবশালী দ্যা ল্যানসেট গ্লোবাল হেলথ কমিশনের ঘোষণার মাধ্যমে অধিবেশনটি সমাপ্ত হয়। বাংলাদেশ এই কমিশনের সহ-সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করবে এবং আইসিডিডিআর,বি এর সিনিয়র ডিরেক্টর ডা. শামস এল আরেফিন কমিশনারদের একজন হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন। আশা করা হচ্ছে যে, এই কমিশন হাইপক্সেমিয়া নামক এই বিশাল বোঝার উপর দৃষ্টিপাত করবে, কিভাবে অক্সিজেন অ্যাক্সেসকে সংজ্ঞায়িত এবং পরিমাপ করতে হবে, কোন অক্সিজেন দ্রবন কোন কোন পরিস্থিতিতে সবচেয়ে ভাল কাজ করে এবং কিভাবে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সদিচ্ছা জাগরণের মাধ্যমে কাঙ্খিত পরিবর্তন আনয়ন সম্ভব- তা নিয়েও কাজ করবে। এই কমিশন স্বাস্থ্য সেবার সকল স্তরে, একদম বাড়ি থেকে হাসপাতাল পর্যন্ত, সকল বয়সের তথা নবজাতক থেকে বৃদ্ধ পর্যন্ত, যে সকল শারীরিক সমস্যায় হাইপক্সেমিয়ার ঝুঁকি রয়েছে এবং যে উপায়ে অক্সিজেনের এক্সেস বৃদ্ধির মাধ্যমে স্বাস্থ্য ব্যবস্থা আরও শক্তিশালী হবে, তার সব কিছু নিয়েই কাজ করবে। কমিশনটির সহ-সভাপতি হিসেবে আরও যারা দায়িত্ব পালন করবেন - উগান্ডার মেকেরের বিশ্ববিদ্যালয় এবং অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্ন বিশ্ববিদ্যালয় এবং মারডক চিলড্রেনস রিসার্চ ইনস্টিটিউট (MCRI)।

 

অধিবেশনের উপস্থাপনা করেন আইসিডিডিআর,বি এর এসোসিয়েট সায়েন্টিস্ট ড. আহমেদ এহসানুর রহমান এবং আলোচক হিসেবে উপস্থিত ছিলেন আইসিডিডিআর,বি এর নিউট্রিশন এন্ড ক্লিনিক্যাল সার্ভিসেস বিভাগের সিনিয়র সায়েন্টিস্ট (হাসপাতাল) ডা. মোহাম্মাদ জোবায়ের চিশতি।

 

উপস্থিত ছিলেন ড. কান্তা জামিল, সিনিয়র রিসার্চ, মনিটরিং, ইভালুয়েশন অ্যান্ড লিনিং অ্যাডভাইজার, ইউএসএআইডি (USAID); এবং ড. ফিদা মেহরান।

 

অন্যান্যদের মধ্যে অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন সিনিয়র ডিরেক্টর ডা. শামস এল আরেফিন, আইসিডিডিআর,বি এর হেড অব রিসার্চ ড. কামরুন নাহার, কান্ট্রি লিড অফ ডাটা ফর ইমপ্যাক্ট ডা. মিজানুর রহমান, ডাটা ফর ইমপ্যাক্ট এর নলেজ ম্যানেজমেন্ট অ্যান্ড কমিউনিকেশন স্পেশালিস্ট সুস্মিতা খান ।

 

অনুষ্ঠানটির যৌথ আয়োজক আইসিডিডিআর,বি এবং ডেটা ফর ইমপ্যাক্ট, নর্থ ক্যারোলিনা বিশ্ববিদ্যালয়, চ্যাপেল হিল- এর একটি ডাটা পরিচালিত উদ্যোগ; যা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থা (ইউএসএআইডি) দ্বারা সমর্থিত।

 

২০২৪ সালে মেডিকেল অক্সিজেন নিরাপত্তা বিষয়ক ‘দ্য ল্যানসেট গ্লোবাল হেলথ কমিশনে’ বাংলাদেশের সহ-সভাপতি হওয়ার ঘোষণার মাধ্যমে অধিবেশনটির সমাপ্তি ঘটে।

 

ভোরের আকাশ/আসা