logo
আপডেট : ১৪ নভেম্বর, ২০২২ ১০:৩৯
ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ করতে পারছেন না ৮০% ডায়াবেটিক রোগী
নিখিল মানখিন

ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ করতে পারছেন না ৮০% ডায়াবেটিক রোগী

নিখিল মানখিন: দেশের ৭৫ থেকে ৮০ শতাংশ ডায়াবেটিক রোগী ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ করতে পারছেন না বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা। তারা বলছেন, নীরব ঘাতক ডায়াবেটিসে আশঙ্কাজনক আক্রান্ত ও মারা যাওয়ার হার হ্রাসে সচেতনতামূলক কার্যক্রম দেশব্যাপী জোরালো করে তুলতে হবে।

 

ডায়াবেটিসের জটিলতায় সংঘটিত হৃদরোগ, কিডনি রোগ, চোখের রোগ, স্নায়ু রোগ, গর্ভকালীনসহ নানা দীর্ঘস্থায়ী জটিলতার শিকার হয়ে অকালে অসংখ্য মানুষের মৃত্যু ঘটছে। আবার সতর্ক থাকলে ডায়াবেটিসের ৭৫ শতাংশ ক্ষেত্রেই ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থা ঠেকিয়ে রাখা সম্ভব। কিন্তু একবার ডায়াবেটিস হয়ে গেলে আর এ রোগ থেকে মুক্তি পাওয়া যায় না বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা। দেশে এ পর্যন্ত করোনা রোগীদের মৃত্যুর কোমরবিডিটি হিসেবে দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে ডায়াবেটিস। এমন অবস্থার মধ্য দিয়ে আজ সোমবার পালিত হচ্ছে বিশ^ ডায়াবেটিস দিবস।

 


জাতীয় জনসংখ্যা গবেষণা ও প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠানের (নিপোর্ট) একটি জরিপে দেখা যায়, বাংলাদেশে মোট ডায়াবেটিস আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা এক কোটি ১০ লাখ। এর মধ্যে ১৮ থেকে ৩৪ বছর বয়সিদের সংখ্যা ২৬ লাখ আর ৩৫ বছরের বেশি বয়সিদের সংখ্যা ৮৪ লাখ। এদিকে, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের এপিডেমিওলজিক্যাল ৩০ সপ্তাহে রোগতাত্তি¡ক পর্যালোচনা বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, করোনা রোগীদের মৃত্যুর কোমরবিডিটিগুলোর মধ্যে ডায়াবেটিস ছিল ৫৩ শতাংশ।

 


বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ডা. শারফুদ্দিন আহমেদ ভোরের আকাশকে বলেন, নীরব ঘাতক ডায়াবেটিস আজ বাংলাদেশসহ সারাবিশ্বে রীতিমতো আতঙ্ক সৃষ্টি করেছে। ডায়াবেটিস রোগটি এখন আর অপরিচিত কোনো রোগ নয়। দিনে দিনে এর প্রকোপের পাশাপাশি বৃদ্ধি পাচ্ছে ডায়াবেটিসজনিত জটিলতা এবং মৃত্যুঝুঁকিও।

 

অথচ একটু সচেতন হলেই এ রোগ থেকে এবং ডায়াবেটিস হলেও এ রোগের জটিলতাকে সহজেই রুখে দেয়া সম্ভব। ডায়াবেটিস জটিলতার কারণে মানুষের হার্ট অ্যাটাক, স্ট্রোক, স্নায়ুরোগ, গর্ভকালীন জটিলতা ও কিডনি নষ্ট হয়ে যেতে পারে। অনেক সময় শরীরের অঙ্গ কেটেও ফেলতে হতে পারে।

 

দীর্ঘস্থায়ী ডায়াবেটিসের জটিলতায় অনেক মানুষ প্রতিবছর অকাল মৃত্যুতে নিপতিত হচ্ছে। নিয়মিত ডায়াবেটিস পরীক্ষা করানোসহ সুশৃঙ্খল জীবন প্রণালি বজায় রাখলে ডায়াবেটিসের নীরব আঘাত থেকে রেহাই পাওয়া সম্ভব বলে জানান অধ্যাপক ডা. শারফুদ্দিন আহমেদ।

 


বাংলাদেশ ডায়াবেটিক সমিতির (বাডাস) সভাপতি অধ্যাপক এ কে আজাদ খান ভোরের আকাশকে বলেন, সারাবিশ্বেই ডায়াবেটিস এখন মহামারি আকার ধারণ করেছে। এ রোগ আজীবনের। একবার হলে তা কখনো সারে না। তবে এ রোগ নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারলে সুস্থ স্বাভাবিক জীবনযাপন করা সম্ভব। তিনি বলেন, যথাযথ চিকিৎসা-শিক্ষা পেলে একজন ডায়াবেটিস রোগী চিকিৎসকের ওপর নির্ভরশীল না থেকে রোগকে ভালোভাবে নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারেন। এ রোগের যেসব ঝুঁকি আছে তা এড়িয়ে চলতে পারেন।

 


বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের এন্ডোক্রাইনোলজি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. শাহজাদা সেলিম ভোরের আকাশকে বলেন, বাংলাদেশে যেমন ডায়াবেটিক রোগীর সংখ্যা বেশি, তেমনি ডায়াবেটিস বৃদ্ধির হারও বেশি। ডায়াবেটিস রোগীর পরবর্তী আজীবনের সুস্বাস্থ্য নিশ্চিত করতে হলে রক্তের গøুকোজের মাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখা অতীব জরুরি। ডায়াবেটিস কন্ট্রোল পরিমাপের সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য পরীক্ষা হলো রক্তের এইচবিএ-১সি, যা ৩-৪ মাসের গড় হিসাব বোঝায়।

 

প্রায় সব ডায়বেটিস রোগীর জন্য গড়পড়তা এইচবিএ-১সি-এর লক্ষ্যমাত্রা হলো ৭ শতাংশ। কিন্তু সব মানুষই এ লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে কমবেশি ব্যর্থ। বাংলাদেশের বেলায় তা আরও হতাশাব্যঞ্জক। বাংলাদেশের ৭৫-৮০ শতাংশ ডায়াবেটিক রোগী নিয়ন্ত্রণ করতে পারছেন না। ডায়াবেটিস এমন একটি রোগ যেটিকে প্রতিরোধ করার যথেষ্ট সুযোগ আছে (প্রতি ২ জনে একজনের ক্ষেত্রে), কিন্তু একবার ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হলে বাকি জীবন ডায়াবেটিস নিয়েই কাটাতে হবে এবং প্রহর গুনতে হবে যে, কখন ডায়াবেটিস সংক্রান্ত জটিলতাগুলো দেখা দেয়।

 

তাই সর্বস্তরের মানুষকে সচেতনভাবে ডায়াবেটিস প্রতিরোধের কর্মযজ্ঞে নিজের সামর্থ্য অনুসারে অংশগ্রহণ করতে হবে। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে ডায়াবেটিস চিকিৎসা যেমন জরুরি, তার চেয়েও ডায়াবেটিস প্রতিরোধের সর্বাত্মক সুগভীর কর্মকাÐ চালানো দরকার বলে জানান ডা. শাহজাদা সেলিম।

 


লক্ষণ ও প্রতিরোধের উপায় : ডায়াবেটিসের বিভিন্ন লক্ষণ তুলে ধরে বাংলাদেশের ডায়াবেটিক সমিতির সভাপতি ড. এ কে আজাদ খান ভোরের আকাশকে বলেন, ডায়াবেটিস প্রধানত দুই ধরনেরÑ টাইপ-১ ও টাইপ-২। আমাদের দেশে ৯৫ শতাংশ রোগী টাইপ-২ ধরনের। টাইপ-১ হচ্ছে যাদের শরীরে একেবারেই ইনসুলিন তৈরি হয় না। তাদের ইনসুলিন বা পুরোপুরি ওষুধের ওপর নির্ভর করতে হয়।

 

সে জন্য সবসময় চিকিৎসকের পরামর্শে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে। টাইপ-২ ধরনের ডায়াবেটিসের ৭৫ শতাংশ ক্ষেত্রেই আগেভাগে সতর্ক থাকলে, শারীরিক পরিশ্রম করলে এবং খাদ্যাভ্যাস, জীবনযাপনে নিয়ন্ত্রণ আনলে ঠেকিয়ে রাখা সম্ভব। কিন্তু একবার ডায়াবেটিস হয়ে গেলে আর এই রোগ থেকে মুক্তি পাওয়া যায় না।

 

যেসব লক্ষণ দেখলে সতর্ক হতে হবে ঘন ঘন প্রস্রাব হওয়া ও পিপাসা লাগা দুর্বল লাগা, ঘোর ঘোর ভাব আসা, ক্ষুধা বেড়ে যাওয়া, সময়মতো খাওয়া-দাওয়া না হলে রক্তের শর্করা কমে হাইপো হওয়া, মিষ্টি জাতীয় জিনিসের প্রতি আকর্ষণ বেড়ে যাওয়া, কোনো কারণ ছাড়াই অনেক ওজন কমে যাওয়া, শরীরে ক্ষত বা কাটাছেঁড়া হলেও দীর্ঘদিনেও সেটা না সারা, চামড়ায় শুষ্ক, খসখসে ও চুলকানি ভাব, বিরক্তি ও মেজাজ খিটখিটে হয়ে ওঠা এবং চোখে কম দেখতে শুরু করা।

 


ঝুঁকির বিষয়ে তিনি বলেন, যাদের বাবা-মা, ভাইবোন বা ঘনিষ্ঠ আত্মীয়স্বজনের ডায়াবেটিস রয়েছে, তাদের এই রোগটিতে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বেশি। এ ছাড়া যারা নিয়মিত হাঁটাচলা বা শারীরিক পরিশ্রম করেন না, অলস বা অনিয়ন্ত্রিত জীবনযাপন করেন, তাদের এ রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বেশি।

 

এ ছাড়া নারীদের গর্ভাবস্থায় ডায়াবেটিস রোগ হতে পারে। যাদের হৃদরোগ রয়েছে, রক্তে কোলেস্টেরল বেশি, উচ্চ রক্তচাপ রয়েছে, তাদেরও এ রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি রয়েছে। যেসব শিশুর ওজন বেশি, যাদের বাবা-মা, ভাইবোন, দাদা-দাদি, নানা-নানি বা ঘনিষ্ঠ আত্মীয়স্বজনের ডায়াবেটিস রয়েছে, যাদের মায়ের গর্ভাবস্থায় ডায়াবেটিস হয়েছিল, সেসব শিশুর ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি রয়েছে।

 


ডায়াবেটিস প্রতিরোধের বিষয়ে ডা. এ কে আজাদ খান বলেন, আগাম সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। প্রতিদিন এক ঘণ্টা হাঁটতে হবে। শারীরিক পরিশ্রম করতে হবে। জীবনধারা পাল্টে দিতে হবে। ধূমপান ও মদ্যপান ছেড়ে দিতে হবে। মিষ্টি খাওয়া যাবে না। রক্তে চিনির মাত্রার ওপর নজর রাখতে হবে। বছরে অন্তত একবার লিপিট প্রোফাইল এবং রক্তে কোলেস্টেরলের মাত্রা পরীক্ষা করে দেখতে হবে।

 

ভোরের আকাশ/নি