logo
আপডেট : ১৫ নভেম্বর, ২০২২ ১২:২০
হিসাব কষে চলছে জীবন
সংসার খরচ কমাতে খাদ্য তালিকায় কাটছাঁট
মুস্তাফিজুর রহমান নাহিদ

সংসার খরচ কমাতে খাদ্য তালিকায় কাটছাঁট

মুস্তাফিজুর রহমান নাহিদ: মো. বদরুল আলম (ছদ্ম নাম)। চাকরি করেন একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে। দুই সন্তান ও স্বামী-স্ত্রী মিলে পরিবারে মোট সদস্য সংখ্যা চার। করোনাভাইরাস আসার আগে বেশ ভালোই চলছিল যাপিত জীবন। সংসার চালিয়ে তখন কিছু সঞ্চয়ও ছিল।

 

কিন্তু করোনা আসার পরই ধীরে ধীরে চিত্র বদলাতে থাকে। পূর্বের প্রতিষ্ঠান থেকে চাকরিচ্যুত হন। তখনই সংসারে মন্দার হাওয়া লাগে। বর্তমানে কর্মরত অন্য একটি প্রতিষ্ঠানে। বেতন আগের চেয়ে কম। কিন্তু সংসার খরচ বেড়েছে প্রায় দ্বিগুণ। ফলে সংসার চালাতে হিমশিম খাচ্ছেন তিনি।

 

পূর্বে সপ্তাহে তিন দিন গরুর মাংস খেতেন, খেতেন দেশি বড় মাছ। প্রথমে সঞ্চয় ভেঙে খেয়েছিলেন, এখন সঞ্চয় শেষ। বাধ্য হয়েই খাদ্য তালিকা ছোট করেছেন তিনি। কমিয়ে দিয়েছেন সন্তানদের চাহিদা পূরণ।
এ তো গেল বদরুল আলমের কথা।

 

একই অবস্থা দেশের মধ্যবিত্ত ও নিন্মবিত্ত মানুষের। সরকারের সব রকমের চেষ্টা থাকার পরও লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে পণ্যের দাম। বাড়ছে খরচ। ফলে সঞ্চয় দূরের কথা, জীবন চালাতেই বেগ পাচ্ছেন তারা। প্রতিদিনই খরচের অঙ্ক কষে চালাতে হচ্ছে জীবন। মধ্যবিত্ত ও নিবিত্ত ছাপিয়ে এর ছোঁয়া লেগেছে উচ্চবিত্তদের গায়ে। এখন তারাও হিসাব কষে জীবন চালাচ্ছেন। তবুও খরচের নাগাল টানা যাচ্ছে না।


এ বিষয়ে কথা বললে শহিদুল আলম নামে এক ব্যক্তি বলেন, আমি নিন্মমধ্যবিত্ত মানুষ। গত এক বছরে বাসা ভাড়া বেড়েছে ১০০০ টাকা। সন্তানদের স্কুলে যাওয়া-আসার জন্য আগে দিনে রিকশাভাড়া লাগত ১০০ টাকা। এখন লাগে ১৪০ থেকে ১৫০ টাকা।

 

একইভাবে সবজি, চাল, ডাল, তেল, চিনি, মরিচসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যে আট হাজার টাকার স্থলে ১৪ হাজার টাকার বেশি লাগছে। বেড়েছে অফিসে যাওয়া-আসার খরচ। কিন্তু আমার আয় এক বছর আগে যা ছিল, এখনো তা-ই আছে। ফলে সংসারের অনেক প্রয়োজনীয় খরচ কমাতে হয়েছে। বাধ্য হয়ে খাদ্য তালিকা ছোট করে ফেলেছি। আগে প্রতি সপ্তাহে একবার গরুর গোশত কেনা হতো, এখন সেটা পারছি না। বাচ্চারা মাসে দু-একবার মাংস খেতে পারছে। মাছও আগের চেয়ে কম কেনা হচ্ছে। একইভাবে সংসারের অন্যান্য জিনিস ক্রয়েও কাটছাঁট করেছি।

 


ভুক্তভোগীদের সঙ্গে আলাপ করে জানা যায়, সবাই-ই এখন হিসাব করে চলছেন। যিনি আগে মাসে পাঁচ কেজি রান্নার তেল ব্যবহার করতেন, এখন সেই তেল দিয়ে আরও কিছুদিন চালানোর চেষ্টা করছেন। যার মাসে ৬টি কাপড় কাঁচা সাবান লাগত, এখন তা কমিয়ে চারটিতে নিয়ে এসেছেন। কমে গেছে শপিং।

 

মেনুতেও এসেছে পরিবর্তন। মাংসের বদলে সবজিকে প্রাধান্য দিচ্ছেন বেশিরভাগ মানুষ। কিন্তু সবজির বাজারেও আগুন। ফলে এখানেও হিসাবি হতে হচ্ছে। এ বিষয়ে কথা হলে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক গৃহিণী বলেন, সংসারের সব খরচই কমিয়েছি। এমনকি বাচ্চার হাউস টিউটরকেও ছেড়ে দিয়েছি। নিজেই পড়াচ্ছি। শুধু কমাতে পারছি না চাল-আটার খরচ।

 


এদিকে বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) সাম্প্রতিক এক গবেষণায় বলা হয়েছে, চালের দাম বাড়লে গরিব মানুষ মাছ-মাংস, ডাল, ফলমূলের মতো পুষ্টিকর খাবার খাওয়া কমিয়ে দেন। পক্ষান্তরে শাক-সবজি খাওয়া বাড়িয়ে দেন। এসব মানুষ যত খরচ করেন, তার এক-তৃতীয়াংশ খরচ হয় চাল কিনতে। তাই চালের দাম কমবেশি হলে তার প্রভাব গরিব মানুষের ওপর বেশি পড়ে।

 


অন্যদিকে স্বস্তি নেই পেঁয়াজ-মরিচের বাজারেও। এক মাস আগে দেশি পেঁয়াজের কেজি ছিল ৪০-৪৫ টাকা। বর্তমানে ৫৫-৬০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে। আমদানি করা চীনা রসুনের দর বেড়ে ১৩০-১৪০ টাকা হয়েছে। মাসখানেক আগেও দাম ছিল ১১০-১৩০ টাকা। আবার গত মাসে মানভেদে আদার কেজি ছিল ৯০-১৮০ টাকা। আর বর্তমানে বিক্রি হচ্ছে ১৯০-২০০ টাকা কেজি দরে। মসুর ডালের দামও বাড়ছে। গত সপ্তাহে বড় দানার মসুর ডালের কেজি ছিল ৯৮-১০৫ টাকা। আর চলতি সপ্তাহে তা বিক্রি হচ্ছে ১০৫-১১০ টাকায়।

 


একইভাবে দীর্ঘদিন আটার বাজারেও মিলছে না স্বস্তি। খোলা কিংবা মোড়কজাত যে কোনো আটাই বর্তমানে ৬০ টাকার নিচে নেই। বর্তমানে মোড়কজাত প্রতি কেজি আটা বিক্রি হচ্ছে ৬২-৬৬ টাকায়। ময়দার দামও বাড়তি। কিছুদিন আগে খোলা ময়দার কেজি ৬৫-৬৮ টাকা হলেও বর্তমানে বিক্রি হচ্ছে ৭০-৭৫ টাকায়। একইভাবে খোলা চিনিই বিক্রি হয়েছে ১১০-১১৫ টাকায়।

 

অথচ এক মাস আগেও এই চিনি ৯০-৯৫ টাকায় বিক্রি হয়েছে। আবার সয়াবিন তেলের সরবরাহ কমে যাওয়ায় এক লিটারের বোতলজাত সয়াবিন তেল ১৮০-১৮৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। যদিও বোতলের গায়ে লেখা দাম হচ্ছে ১৭৮ টাকা। তবে স্বস্তির খবর রয়েছে দু-তিনটি পণ্যে। গত মাসে প্রতি হালি ডিম বিক্রি হয় ৪৭-৫০ টাকায়। বর্তমানে বিক্রি হচ্ছে ৪৫-৪৬ টাকায়। তা ছাড়া ব্রয়লার মুরগি গত মাসে ১৭০-১৮০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হলেও গতকালের দাম ছিল ১৬০-১৭০ টাকা।

 


এ বিষয়ে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, অনিশ্চিত বাজার পরিস্থিতি ও মূল্যস্ফীতির কারণে নিত্যপণ্যের সরবরাহ স্বাভাবিক রাখা কঠিন। বর্তমান প্রেক্ষাপট মেনে নেয়ারও সময় এসেছে। তিনি বলেন, বর্তমান প্রেক্ষাপটে এখন সরকারের উচিত অত্যাবশ্যকীয় খাদ্যপণ্য চিহ্নিত করে সেগুলোর সরবরাহ স্বাভাবিক রাখতে যা যা করণীয়, তা নিশ্চিত করা। একই সঙ্গে অভ্যন্তরীণ খাদ্যপণ্যের উৎপাদন বাড়াতে উদ্যোগ নিতে হবে।

 


এদিকে, বিষয়টিতে দৃষ্টি রেখেছে সরকার। সাধারণ মানুষের স্বার্থেই বেঁধে দেয়া হচ্ছে কিছু পণ্যের দাম। সম্প্রতি বিটিটিসির পক্ষ থেকে নয়টি পণ্যের ওপর একটি প্রতিবেদন উপস্থাপন করা হয়। এতে দেখানো হয়, আন্তর্জাতিক বাজারে এক বছরে গমের দাম বেড়েছে ৮ শতাংশ। অথচ দেশের বাজারে খোলা আটা ও ময়দা ৬৭ শতাংশ, প্যাকেট আটা ৬৪ শতাংশ এবং প্যাকেট ময়দা ৫৯ শতাংশ বেড়েছে।

 


এ ছাড়া দেশের বাজারে চিনির দাম এক বছরে বেড়েছে ১৫ শতাংশ। অথচ আন্তর্জাতিক বাজারে অপরিশোধিত চিনির দাম কমেছে প্রায় ১১ শতাংশ। একইভাবে এক বছরে আন্তর্জাতিক বাজারে মসুর ডালের দাম কমেছে প্রায় ১৪ শতাংশ। অথচ দেশের বাজারে তা বেড়েছে মানভেদে ২৯ থেকে ৩৯ শতাংশ। এমএস রডেরও একই অবস্থা। এক বছরে স্টিল স্ক্র্যাপের দাম কমেছে ১৪ শতাংশ।

 

দেশের বাজারে ৬০ গ্রেডের রড ১৫ শতাংশ এবং ৪০ গ্রেডের রড ১৬ শতাংশ বেড়েছে। এ ছাড়া সিমেন্টের দাম বেড়েছে এক বছরে ৩১ শতাংশ। এসব পণ্যের দর বেঁধে দেয়ার চিন্তা করছে সরকার।

 

ভোরের আকাশ/নি