চুয়াডাঙ্গায় খেজুর গাছ ঝোড়া ও চাঁচা-ছোলার পর শুরু হয়েছে খেজুর রস সংগ্রহ। দুপুরের পর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত গাছিদের গাছ থেকে রস আহরণ করতে দেখা যাচ্ছে। মাঠে মাঠে গাছ চাঁচা-ছোলা করে ভাঁড় (ছোট ছোট কলস) টানাতে এবং ভোর রাতে গাছ থেকে সেসব ভাঁড় নামিয়ে রস সংগ্রহ করতে দেখা যাচ্ছে।
গত বছরের তুলনায় চলতি বছর জেলার ৪ উপজেলায় ১৬ হাজার নতুন খেজুর গাছ থেকে চাষিরা রস সংগ্রহ করছেন বলে জেলা কৃষি অফিস সূত্রে জানা গেছে। তবে রস সংগ্রহ শুরু হলেও এখনো গাছ পুরোপুরি তৈরি না হওয়ায় চাহিদামতো রস পাচ্ছেন না চাষিরা।
গত মৌসুমে জেলায় আড়াই লাখ খেজুর গাছ খেকে রস সংগ্রহ করেছিলেন চাষিরা। চলতি মৌসুমে জেলার চার উপজেলায় মোট ২ লাখ ৬৬ হাজার খেজুর গাছ থেকে চাষিরা রস সংগ্রহ শুরু করেছেন।
চাষিরা জানান, আর দিন ১৫ গেলে তারা চাহিদামতো রস পাবেন। গাছগুলো চাহিদামতো রস দেয়া শুরু করলেই জমে উঠবে দেশের সর্ববৃহৎ চুয়াডাঙ্গার সরোজগঞ্জের খেজুর গুড়ের হাট। তখন বিগত বছরগুলোর মতো গুড় কিনতে বিভিন্ন জেলা থেকে আসবেন ব্যাপারিরা। বেচাকেনার জন্য এই হাটের ঐতিহ্য কয়েকশ বছরের।
জেলার সদর উপজেলার কুতুবপুর ইউনিয়নের সরোজগঞ্জে চুয়াডাঙ্গা-ঝিনাইদহ আঞ্চলিক মহাসড়ক ঘেঁষে স্থানীয় সরোজগঞ্জ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের মাঠে বসে এ হাট। সপ্তাহে সোমবার ও শুক্রবারের এ হাটে সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত চলে বেচাকেনা।
গত বছর (গত মৌসুমে) প্রতি সপ্তাহে প্রায় দুই কোটি টাকার গুড় বেচাকেনা হলেও চলতি (মৌসুমে) বছর গুড়ের দাম বেশি হওয়ায় এবার সপ্তাহে প্রায় আড়াই কোটি টাকার গুড় ও পাটালি বেচাকেনা হবে বলে ধারণা স্থানীয় ব্যবসায়ীদের।
মাটির ভাঁড় বা কলসে ১০ থেকে ২০ কেজি পর্যন্ত গুড় রাখা যায়। স্বাদে ও গন্ধে চুয়াডাঙ্গার গুড় অতুলনীয়। তাই সারা দেশেই এখানকার খেজুরের গুড় ও নলেন পাটালির চাহিদা বেশি।
হাটের প্রবেশপথের দুই ধারে বসে কৃষকেরা ধামা-কাঠায় করে তাদের বাড়িতে তৈরি পাটালি বিক্রি করেন। পাটালির দোকান পার হয়ে ভেতরে যত যাওয়া যায়, বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে ততই চোখে পড়ে সারি সারি সাজানো গুড়ের ভাঁড়। হাটের একাধিক স্থানে দাড়িপাল্লায় গুড় মেপে কিনে নিয়ে যায় ক্রেতারা।
স্থানীয়রা জানান, প্রতি বছর শীত মৌসুমে খেজুরের গুড় বেচাকেনা হয় এ হাটে। মৌসুমের প্রায় পুরোটা সময় হাজারো ক্রেতা-বিক্রেতার ভিড়ে জমজমাট থাকে এই হাট।
চুয়াডাঙ্গা সদরের বেলগাছি গ্রামের আলাউদ্দীন বিশ^াস জানান, এবার তিনি ২০০ গাছ কেটেছেন। এসব গাছ থেকে রস সংগ্রহের জন্য মাসিক ২০ হাজার টাকা বেতন দিয়ে একই গ্রামের বাচ্চু মন্ডলের ছেলে সাইফুল গাছিকে কাজে রেখেছেন।
তিনি জানান, এবারের মৌসুমে তিনি প্রায় সাড়ে চার লাখ টাকার পাটালি ও গুড় বিক্রি করবেন। সব খরচ বাদ দিয়ে তার এবারের মৌসুমে দেড় থেকে দুই লাখ টাকা আয় হবে বলে আশা করছেন।
দামুড়হুদার দেউলী গ্রামের গাছি আব্দুর রশিদ মোল্লা জানান, তিনি এবার ১৫০টা গাছ কেটেছেন (তুলেছেন)। এবার বাজারে সবকিছুর দাম বেশি হওয়ায় গুড়ের দামটাও বিগত বছরগুলোর তুলনায় অনেকটা বেশি হওয়ায় বেশ মোটা অংকের টাকা তিনি আয় করবেন।
সরোজগঞ্জ বাজার কমিটির সভাপতি এম আবদুল্লাহ শেখ জানান, এ হাট থেকে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় সরবরাহ করা হয় গুড়। গত মৌসুমে প্রতি হাটের দিন গড়ে ২৫০ টন খেজুর গুড় বিক্রি হয়েছে। যার মূল্য প্রায় ২ কোটি টাকা।
তিনি দাবি করেন, সরোজগঞ্জ হাটে বিক্রি হওয়া বেশিরভাগ গুড়ই এলাকার কৃষকেরা বাড়িতে যতেœর সঙ্গে তৈরি করেন। এতে চিনি বা কোনো রাসায়নিক কিছু নেই। কিছুটা খয়েরি রঙের হলেও এসব গুড় পুরোটাই খাঁটি।
জেলা কৃষি স¤প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্যমতে, এবারের মৌসুমে জেলায় ২ লাখ ৬৬ হাজারের মতো খেজুর গাছ থেকে কৃষকরা রস আহরণ (সংগ্রহ) করছেন। যার প্রায় অর্ধেকই সদর উপজেলায়। নভেম্বর থেকে মার্চ পর্যন্ত চলে গুড়ের মৌসুম। এই মৌসুমে গড়ে আড়াই হাজার টন গুড় উৎপাদিত হবে।
জেলা কৃষি স¤প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক সুভাস চন্দ্র জানান, মৌসুমে প্রতিটি গাছ থেকে গড়ে ১০ কেজি গুড় পাওয়া যায়। সে হিসেবে প্রতিবছর গড়ে ২ হাজার ৫০০ টন গুড় উৎপাদিত হয়।
ভোরের আকাশ/নি